মুসলমান জাতির ধর্মের নাম ইসলাম। ইসলাম মানবজাতির একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। বিশ্বজগতের সৃষ্টি, ধ্বংস, ইহকাল-পরকালের সব প্রয়োজনীয় বিষয়ে সুন্দরভাবে ইসলামে বর্ণনা করা হয়েছে। মানবজীবনের এমন কোনো দিক নেই, যা ইসলামে আলোচনা করা হয়নি। ইসলাম একটি আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ আনুগত্য করা, আত্মসমর্পণ করা, শান্তির পথে চলা। ব্যাবহারিক অর্থে আল্লাহ তায়ালা ও রাসুল (স.)-এর আনুগত্য স্বীকার করার নাম ইসলাম। ইসলাম শব্দটি সিলমুন মূল ধাতু থেকে নির্গত। সিলমুন অর্থ শান্তি।
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে তৃতীয় স্তম্ভ হচ্ছে সাওম বা রমজান। সাওম আরবি শব্দ, এর বহুবচন সিয়াম—ফারসি প্রতিশব্দ রোজা। রোজার আভিধানিক অর্থ, পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা, আত্মসংযম এবং কঠোর সাধনা করা ইত্যাদি। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায়, সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় নিয়তের সঙ্গে যাবতীয় পানাহার ও ইন্দ্রিয় তৃপ্তি থেকে বিরত থাকার নাম সাওম বা রোজা। অন্য অর্থে—‘রমদ, ধাতুর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, দহন, প্রজ্বলন, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে-ভস্ম করে ফেলা’। রমজানে মানুষের যাবতীয় কুপ্রবৃত্তি, নফসের দাসত্ব, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমান নারী-পুরুষের ওপর রোজা ফরজ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘সাওম আমার জন্য, আর আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব (বুখারি)। মহানবি (স.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও সওয়াবের আশায় রমজান মাসে রোজা রাখে, আল্লাহ তায়ালা তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেন (বুখারি)।
আরবি বর্ষপঞ্জির নবম মাসের নাম রমজান। এ মাসে মুমিন- মুসলমানগণ গুনাহ মাফ করে, মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় সব পাপকর্ম থেকে বিরত থাকেন। রোজা মানুষের দৈহিক-মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নের জন্য অতিগুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষণ। ইসলামে রোজা পালনের বিধান এসেছে নামাজের পর দ্বিতীয় হিজরির ১০ শাবান মদিনায়। রমজানের রোজায় মুমিন বেশি করে নামাজ আদায় করে চরিত্র গঠনে এক সুবর্ণ সুযোগ। একমাত্র রোজা সঠিকভাবে পালনের মাধ্যমে মুমিন মুত্তাকি হতে পারেন।
এ মাসে মুমিনের নেক কাজের প্রতিযোগিতা দেখে মহান আল্লাহ ফেরেশতাদের কাছে গৌরব প্রকাশ করেন। রমজান মাসে পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি কুরআন তেলাওয়াত এবং মহানবি হজরত মুহাম্মদ (স.) দুরুদ পাঠ, নফল নামাজসহ ইবাদত বন্দগি করে থাকেন। রমজানের এক মাসের রোজা ১০ মাসের সমতুল্য। রোজার পানাহারের সঙ্গে চোখ-মুখ, হাত-পা-কানসহ শরীরের সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে পাপকাজ থেকে বিরত রেখে ভালো কাজে মগ্ন থাকার বড় এক সুযোগ। মহানবি হজরত মুহাম্মদ (স.) বলেন, সাওম বা রোজা মুমিনের ‘জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণের ঢালস্বরূপ’ (বুখারি ও মুসলিম)। রোজা লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, ক্রোধ-ক্ষোভ, অত্যাচার থেকে বিরত এবং স্রষ্টার সৃষ্টির প্রতি দয়া প্রদর্শন করতে রমজানই শিক্ষা দেয়। রমজানের প্রথম ১০ দিন রহমত, পরের ১০ দিন বরকত এবং শেষ ১০ দিন নাজাত। শেষের ১০ দিন ইতেকাফ করতে হয়। রমজান মাসে লাইলাতুল কদরের রাত হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। ইতেকাফের ফজিলত সম্পর্কে, মহানবি হজরত মুহাম্মদ (স.) বলেন, যে ব্যক্তি রমজানের শেষ ১০ দিন ইতেকাফ করবে, সে ব্যক্তি দুটি হজ ও দুটি ওমরাহ হজের সমপরিমাণ সওয়াব পাবে। রমজান মাসে এক রাকায়াত নফল নামাজ আদায় করলে সত্তর রাকায়াতের নেকি পাওয়া যায়। রমজানের শেষ দশকে সুবে কদরের রাতে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র আল কোরআন নাজিল করেন।
রোজার ধর্মীয় গুরুত্বের সঙ্গে সামাজিক ও মানবিক অনেক গুরুত্ব জড়িত। মুসলিম বিশ্বে রমজান মাসে আলাদা এক আমেজ সৃষ্টি হয়। মুসলমান রাষ্ট্রগুলোতে হোটেল-রেস্তোরাঁ ও বাসাবাড়িতে পানাহার বন্ধ থাকে। অন্যসব ধর্মের লোকেরা রমজান মাসে রোজাকে শ্রদ্ধা করে কারো সামনে পানাহার করেন না বরং তারা সতর্কভাবে চলাফেরা করেন। হারাম কাজ করা, হারাম খাওয়া, গিবত গাওয়া, পরনিন্দাসহ সব মন্দকাজ পরিত্যাগ করার শিক্ষা দেয় রমজান। সৃষ্টির প্রতি দয়া, সহানুভূতিশীল আচরণ, সদাচার, দানশীলতা ও সৃষ্টির কল্যাণে রমজান। রমজানের একটি ফরজ আদায় করলে অন্য সময়ের ৭০টি ফরজের সমান সওয়াব লাভ করা যায়। রমজানের সবচেয়ে উত্তম কাজ হলো, অনাহারি প্রতিবেশীদের খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়া।
একজন রোজাদারকে ইফতার করালে মহান আল্লাহ, যিনি ইফতার করালেন, তাকে হাউজে কাউসারের পানি পান করাবেন। সিয়াম সাধনায় সংযমের পরীক্ষা হয়। সেই পরীক্ষা ও প্রশিক্ষণ মুমিনের দেহ ও মনের পবিত্রতা অর্জন করে দেয়। ইমাম হজরত গাজ্জালি (র.) বলেন, ‘ দৈহিক কৃচ্ছ্র ও সংযমের সঙ্গে যখন অন্তরের সাধনা যুক্ত হয়, তখন আদর্শ সংযমের চেতনা শ্রেষ্ঠতার প্রতিফলিত হয়, রমজানের সিয়াম সাধনায়।’
মাহে রমজানের সিয়াম সমষ্টিগত আন্তর্জাতিক ইবাদত। রমজান মাসে দুই-তিন দিন সময়ের ব্যবধান থাকলেও সারা বিশ্বব্যাপী একই সঙ্গে পালিত হয় রমজান। সামাজিক বন্ধন, সম্প্রতি-ভ্রাতৃত্ববোধ ও বিশ্বে আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে রোজা গুরুত্বপূর্ণ এক নিয়ামত। মুসলিম বিশ্বে পুরো মাসটি যেন রহমতের ফুলধারায় অভিষিক্ত হয়ে ওঠে। রোজায় বিশ্বের বড় বড় ধনী ব্যক্তি, রাজা-বাদশাহ-আমির একসঙ্গে ইফতার, সেহরি, তারাবি, জুমা ও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন। এমন সাম্যের ছবি ভেসে উঠে সমগ্র দুনিয়ায়। তা দেখে অন্য ধর্মের লোকেরাও উত্সাহিত হয়ে ইসলামের আনুগত্য স্বীকার করেন।
এ মহাবিশ্বটি চির সত্যের ওপর দণ্ডায়মান। সত্য ও বিশ্বাসের মধ্যে মানুষ তার মনুষ্যত্বকে অর্জন করে। মিথ্যা ও অসত্যকে বিতাড়িত করে, সত্য চিরদিন মাথা উঁচু করে থাকার স্বীকৃতি দেয় রমজান। এক মাস রোজা পালনে ১১ মাস সৎ আমলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে মুসলমান।
মুসলিম বিশ্বে রমজানের আগেই জিনিস পত্রের দাম স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ রাখার ব্যবস্থা করে বিভিন্ন দেশ। আমাদের দেশের ঘটনা বিপরীত। কিছু নামধারী মুসলমান খাই খাই, নাই নাই বলে চিৎকার করেন। তারা রমজান মাসে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি ও ওজনে কম দিয়ে মুনাফা অর্জন করে। অবৈধ টাকার মালিকরা একসঙ্গে বাজার থেকে সবকিছু কিনে নিয়ে মজুত করে রাখেন। সাধারণ মানুষ এমন ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারির জন্য বাজারে ঢুকতেই পারেন না। দুর্নীতিবাজরা একসঙ্গে বাজারের সব মাছ-মাংস, তেলসহ নিত্যপণ্য কিনে বাজারে আগুন লাগায়। তারা জানে, রমজান লোক দেখানো ইবাদত নয়, কিন্তু মানে না অহংকারের কারণে। গত বছর নিজে একজন ধর্মভীরু লেবাসের লোক দেখে বিশ্বাস করে তার কাছ থেকে এক কেজি মাংস কিনে অন্য দোকানে গিয়ে ওজন করে ৭০০ গ্রাম পেয়েছিলাম। আমার নিজের লজ্জা হলেও বিক্রেতা লজ্জিত হননি। অথচ তিনি সব সময় নামাজে গিয়ে সামনের কাতারে দাঁড়ান। দেশে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ওজনে কম দেওয়ার অভ্যাস রীতিমতো নীতিতে পরিণত হয়েছে। অথচ ইসলাম তা কোনোমতেই সমর্থন করে না। এ ধরনের বর্ণচোরা বকধার্মিক ব্যক্তিরা রমজানের রোজা রেখে মুত্তাকি হওয়ার সুযোগ ইসলামে নেই।
সত্যবাদিতা শুধু মুখে বলা নয়। জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য—ইসলাম তা শিক্ষা দেয়। সত্য থেকে বিচ্যুতি হলে মানুষের নৈতিক অবক্ষয় ও মহৎ গুণাবলির তিরোধান ঘটে। এতে দেশে অশান্তির সৃষ্টি হয়, লোভে পাপ, পাপে বিবেকের বিলুপ্তি ঘটে। একমাত্র খোদাভীতিই মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দেখায়। কোনো মুসলমান যেন, পবিত্র রমজান মাসে বিবেক বিক্রি করে নিজের স্বার্থের জন্য রোজাদারদের কষ্ট না দেয়, রমজান তা সতর্ক করে দিয়েছে। কারণ রমজান মাসে সব মহত্ কাজ স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপনে এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।