২৫ আগস্ট ২০১৭ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা জনগণ চাপের মুখে জোরপূর্বক দেশত্যাগে বাধ্য হয়। তারা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হাতে সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচার জন্য পালিয়েছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এই অঞ্চল জুড়ে পালিয়ে গেলেও তাদের বেশির ভাগই অস্থায়ীভাবে বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলায় বসবাস শুরু করে। এটি বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য একটি ট্র্যাজেডি যে, ছয় বছর পূর্ণ হতে চলল আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা এবং মিয়ানমারকে তাদের প্রত্যাবাসনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করার অনুরোধ সত্ত্বেও সমস্যাটি অব্যাহত রয়েছে।
এতদিনেও মিয়ানমার একজন রোহিঙ্গাকেও তাদের দেশে ফিরে যেতে দেয়নি, অথবা নেয়নি। বরং প্রত্যাবর্তনকে ঘিরে মাঝেমধ্যেই নাটক বানানো হয়েছে। বাংলাদেশি প্রশাসনের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের ধারণা মিয়ানমার কখনোই খুব একটা আশা করেনি। বাংলাদেশ সরকারের নিরন্তর প্রচেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক সমালোচনার ফলস্বরূপ ২৩ নভেম্বর, ২০১৭ তারিখে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি ১৯ দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেই ব্যবস্থা অনুসারে, মিয়ানমার প্রাথমিকভাবে ৩ হাজার ৪৫০ রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসন করতে চায়, যাদের সাতটি দলে বিভক্ত করা হবে।
নাগরিকত্বের সমস্যা নিয়ে আপস কখনোই চূড়ান্ত হয়নি। মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে গাম্বিয়ার আনা একটি অভিযোগ বর্তমানে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে বিচারাধীন। অং সান সু চিসহ তাদের সব আইনজীবী সেই মামলার শুনানির সময় ‘রোহিঙ্গা’ নাম ব্যবহার বা তাদের নাগরিকত্ব উল্লেখ করা এড়িয়ে গেছেন। অবাক হলেও সত্য, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও হয়নি মতের পরিবর্তন।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এসব মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য ভাসানচর ও কক্সবাজারে রোহিঙ্গা আশ্রয়ণ প্রকল্প নির্মাণ করা হয়েছে। রোহিঙ্গারা যাতে সব ধরনের সুযোগসুবিধা পায়, তার নিশ্চয়তা দিতে বাংলাদেশ সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে গেছে। মিয়ানমারের পক্ষ থেকে সেই প্রচেষ্টায় সামান্যই সায় দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বলিষ্ঠ ভূমিকা অনেক বিতর্কের বিষয়। ১৮ জুন, ২০২১-এ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ মিয়ানমারের বিষয়ে একটি প্রস্তাবে ভোট দেয়, যা গণতান্ত্রিক সমস্যা, জরুরি অবস্থা, রাজনৈতিক বন্দি এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারসহ দেশটির অনেক বিষয়কে কভার করে। তবে এই রেজুলেশনে রোহিঙ্গা ইস্যুটির কোনো সুরাহা হয়নি।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের টানা প্রক্রিয়ার ফলে ক্যাম্পে প্রায়ই হত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, মাদক পাচার এবং অন্যান্য বেআইনি কাজ করা হয়। শিবিরগুলোতে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী তত্পরতা চালাচ্ছে। কক্সবাজার জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ২ হাজার ৫০০টিরও বেশি মামলায় ৫ হাজার জনেরও বেশি ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এখন সক্রিয় সন্ত্রাসী গ্রুপ সংগঠন রয়েছে। এসব সংগঠনকে সমর্থন দিতে মিয়ানমারের বেশ কয়েকটি দল পর্দার আড়ালে কাজ করছে বলে জানা গেছে। রোহিঙ্গাদের দেশত্যাগের বিরুদ্ধে কথা বলায় মুহিবুল্লাহকে (মাস্টার মুহিবুল্লাহ) ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে রাত সাড়ে ৮টার দিকে হত্যা করা হয়েছিল।
বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টিকে বিশ্বব্যাপী প্রাধান্য পেতে সহায়তা করছে। বিশ্বরাজনীতিতে অস্থিরতা এবং মিয়ানমারের অলস মনোভাবের কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়েছে। নাগরিকত্বের ব্যবহার স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসন এবং মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বসবাসের পরিস্থিতি এই বিলম্বের কিছু রাজনৈতিক যুক্তি।
১৯৮২ সালের বার্মা নাগরিকত্ব আইনে সামরিক সরকার কর্তৃক রোহিঙ্গাদের নিষিদ্ধ করেছিল। ঐ সময় থেকে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানায়। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কাজে লাগিয়ে এই প্রত্যাবাসনে সুবিধা করছে মিয়ানমার। নাগরিকত্ব আইনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে কখনো মনোযোগ পায়নি। রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কারণে তাদের ফেরত পাঠানোর সবশেষ দুইটি প্রচেষ্টা এ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে। নভেম্বর থেকে চুক্তির আলোকে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি মোকাবিলায় একই বছরের ১৯ ডিসেম্বর ঢাকায় দুই দেশের যৌথ ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়। তালিকা যাচাইয়ের জন্য মিয়ানমার তখন বিলম্বের রাজনীতি শুরু করে। ২০১৮ সালে প্রত্যাবর্তনের প্রথম প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। ২০১৯ সালে একটি চীনা-সমর্থিত প্রত্যাবাসন পরিকল্পনার ব্যর্থতাকে দায়ী করে বলা হয়েছিল যে, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বসবাসের অবস্থা তাদের প্রত্যাবর্তনের জন্য অনুপযুক্ত। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার প্রতিস্থাপনের পর রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে আলোচনা স্থবির হয়ে পড়ে।
২০২৩ সালে চীন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা ছাড়াই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে মধ্যস্থতার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেয়। ইতিমধ্যে কূটনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা চলছে। তবে, আবারও দুইটি বিষয় বাদ সেধেছে এই প্রক্রিয়ায়। প্রথমটি রোহিঙ্গাদের সম্মতি এবং দ্বিতীয়টি প্রত্যাবর্তনের স্থান। রোহিঙ্গাদের অনুমোদন প্রথম এবং প্রত্যাবর্তনের স্থান দ্বিতীয়। এলাকাটি বসবাসের উপযোগী কি না, তা নির্ধারণের এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে চলতি বছরের মে মাসে এক দল রোহিঙ্গা প্রথম বারের মতো রাখাইন রাজ্যে যান। কক্সবাজার ক্যাম্পে ফিরে আসার পর তাদের মধ্যে কেউ কেউ সেখানকার পরিবেশ দেখে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, অন্যরা আপত্তি জানিয়েছে বলে জানা গেছে। পুরো পরিবারকে একসঙ্গে পৈতৃক গ্রামে ফিরে আসার দাবি করা হচ্ছে। শুরুতে মিয়ানমারের উত্তর মংডু এবং আশপাশের এলাকায় প্রত্যাবাসন শিবির বা মডেল গ্রামের প্রস্তাব করা হয়েছিল।
রোহিঙ্গাদের তাদের গ্রামে ফেরত পাঠানো হবে, নাকি মডেল গ্রামে ফেরত পাঠানো হবে, তা নিয়ে মিয়ানমার নতুন রাজনীতির জন্ম দিয়েছে। ঠিক একইভাবে রোহিঙ্গা পরিবারের সব সদস্যকে একত্রে নেওয়া হবে কি না, তা স্পষ্ট নয়। আবার আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অস্থিরতার কারণে এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হতে পারে কি না, তা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের জন্য পুনর্বাসন কর্মসূচি চালু করার মার্কিন পরিকল্পনার আলোকে। যা-ই হোক, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত সমস্ত রাজনৈতিক বিরোধ দূরে সরিয়ে রাখা, মানবিক ইস্যুতে গভীরভাবে চিন্তা করা এবং অবিলম্বে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সমর্থন করা।
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, কারণ ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা এখানে ছয় বছর ধরে অবস্থান করছে। একটি পাইলট প্রকল্পের আওতায় একটি ছোট দলকে রাখাইনে প্রত্যাবাসনের চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশ চায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এ ব্যাপারে সহায়তা করুক। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটি অংশ কক্সবাজারের ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের নিয়ে রাজনীতি করছে। এ কারণে তাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং বৃহত্ শক্তিগুলো রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে জান্তাকে চাপ দিতে তেমন কিছু করেনি। জান্তার আগে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও গণতান্ত্রিক সরকারকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এবং অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে রাজি করাতে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশ গত ছয় বছর ধরে দ্বিপাক্ষিক, ত্রিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিকভাবে একটি কার্যকর সমাধানের চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশ আগ্রহের সঙ্গে এই উদ্যোগটি কার্যকর করতে চায়, কারণ কিছু না হওয়ার চেয়ে কিছু ভালো। দ্বিপাক্ষিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কানেকটিভিটি এবং অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে বাংলাদেশকে নিজেই সমস্যার সমাধান করতে হবে। বাংলাদেশ যখন রোহিঙ্গাদের তাদের জন্মস্থানে প্রত্যাবাসনের জন্য চেষ্টা করছে, তখন এনজিওগুলো তার সময়ের সবচেয়ে নির্যাতিত সম্প্রদায়ের জন্য যথেষ্ট কাজ করছে না।
UNHCR, HRW এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো অ্যাডভোকেসি নেটওয়ার্ক মিয়ানমারের ওপর কার্যকর চাপ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। এনজিওগুলোর মতো বিশ্বসম্প্রদায়ও মিয়ানমারকে কার্যকরভাবে চাপ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ক্রমহ্রাসমান তহবিল, ক্রমবর্ধমান শিবিরের অবস্থা, ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাহীনতা এবং স্বাগতিক সম্প্রদায়ের ওপর উদ্বাস্তুদের প্রতিকূল প্রভাব বাংলাদেশকে একটি আক্রান্ত বিষয়ে পরিণত করেছে, যা বোঝা কমানোর জন্য পথ খুঁজছে, যেখানে এর আন্তর্জাতিক অংশীদাররা শুধু একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে তাদের আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন করছে। এই সংকট আঞ্চলিক নিরাপত্তাকেও অস্থিতিশীল করে তুলছে। উল্লেখ্য, রোহিঙ্গাদের জন্য সাহায্যের পরিমাণ প্রতিদিনই কমছে। বর্তমান ইউক্রেনের সংঘাতে গোটা বিশ্বই কাঁপছে। যদিও ইউক্রেনে যুদ্ধের ফলে রোহিঙ্গা মানবিক ইস্যুটি বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে। অথচ প্রত্যাবাসনের সময় রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার জন্য একটি বাহ্যিক গ্যারান্টি প্রদানের জন্যও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব রয়েছে।