গোলাম রাব্বানী ছোটন, যিনি এখন বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের কোচ। যার হাত ধরে এবার ২০২২ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। এর আগেও বাংলাদেশের বয়সভিত্তিক নারী দলের প্রধান কোচের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।খেলোয়াড়ি জীবনেও তিনি ছিলেন দক্ষ একজন ডিফেন্ডার। ফকিরেরপুল এবং আরামবাগের হয়ে তিনি রক্ষণভাগ সামাল দিয়েছেন। ১৯৮৩-৮৪ মৌসুমে বাংলাদেশি ক্লাব বাসাবোর হয়ে খেলার মাধ্যমে তিনি তার জ্যেষ্ঠ পর্যায়ের খেলোয়াড়ি জীবন শুরু করেছিলেন।
সর্বশেষ ২০০১-০২ মৌসুমে তিনি আরামবাগ থেকে বিআরটিসিতে যোগদান করে সেখানে মাত্র এক মৌসুম খেলার পর খেলোয়াড়ী জীবন থেকে তিনি অবসর নেন। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশি ফুটবল ক্লাব টিএন্ডটির ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করার মাধ্যমে ম্যানেজার হিসেবে ফুটবল জগতে অভিষেক করেন ছোটন।২০০৯ সালে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা দলের ম্যানেজারের দায়িত্বের পাশাপাশি বাংলাদেশ মহিলা অনূর্ধ্ব-২০ দলের ম্যানেজারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশ মহিলা অনূর্ধ্ব-১৪ এবং বাংলাদেশ মহিলা অনূর্ধ্ব-১৭ দলেরও ম্যানেজারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এই দায়িত্বে ছোটন এ পর্যন্ত সাতটি শিরোপা জিতেছেন। যার মধ্যে ২০১৮ সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপ এবং সবশেষ ফুটবলে বাংলাদেশের মেয়েদের সবচেয়ে বড় অর্জন ২০২২ সাফ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতেন। কোচ গোলাম রাব্বানী ছোটন এবার মুখোমুখি হয়েছেন
প্রশ্ন : সম্প্রতি নিজ এলাকা টাঙ্গাইলে সংবর্ধনা পেয়েছেন। এর আগে তো কখনো নিজ এলাকায় এত বড় সংবর্ধনা পাননি? নিজের এলাকায় এত বড় সংবর্ধনা পেয়ে আপনার অনুভূতি কেমন?
গোলাম রাব্বানী ছোটন : এটা অবশ্যই স্পেশাল। চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশে আসার পর থেকেই সারা বাংলাদেশ থেকে আমাদের সংবর্ধনা দেয়া হচ্ছে। তবে নিজ এলাকায় এমন সংবর্ধনা অবশ্যই আমার জন্য স্পেশাল। আমি দীর্ঘদিন টাঙ্গাইলে খেলাধুলা করেছি। আমার বোন এবং দুলাভাই আমাকে অনেক সাপোর্ট করেছেন। এবং সংবর্ধনা দেয়ার সময় সেখানে সবাই আমার নিজের মানুষ ছিলেন। সংবর্ধনার দিন আমার সাথে আমার ভাগ্নি, আমার ভাগ্নে এবং সবাই ছিল। আমার খেলোয়াড়ি জীবনে তারা আমাকে অনেক সহযোগিতা এবং সাপোর্ট করেছে। সংবর্ধনার দিন যে তারা আমার সাথে ছিল এটা আমার জন্য অনেক বড় একটা পাওয়া। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, আমার সাথে যারা খেলেছে, আমার বন্ধু বান্ধব সবাই আমার সাথে ছিল; এটা আমার জন্য অনেক আনন্দের মুহূর্ত। টাঙ্গাইলের স্বনামধন্য অনেকেই উপস্থিত ছিলেন; যেমন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফারুক ভাই, ডিসি, এসপি সবাই ছিলেন। সর্বোপরি সব মিলিয়ে নিজ এলাকায় নিজের মানুষের কাছ থেকে এমন সংবর্ধনা আমার জন্য অবশ্যই স্পেশাল একটা দিন।
প্রশ্ন : চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর দেশে এসে অনেক ব্যস্ত সময় পার করছেন; অনেক সংবর্ধনা পাচ্ছেন, কেমন কাটছে এই সময়টা?
গোলাম রাব্বানী ছোটন : সত্যি বলতে নেপাল থেকে আসার পর অনেক ব্যস্ত সময় পার করছি। সেই এয়ারপোর্ট থেকেই অনেক মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি এবং পাচ্ছি। যদিও অনেক ক্লান্ত ছিলাম; তবুও মানুষের এমন ভালোবাসা সত্যিই খুব ভালো লাগছে।
প্রশ্ন : এত বছরের সাধনা। সাফে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। এই দলটাকে নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
গোলাম রাব্বানী ছোটন : পরিকল্পনা তো অবশ্যই আছে। আমাদের ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি সাত বছর আগে স্বপ্ন দেখেছিলেন যে আমরা সাউথ এশিয়ার সেরা হবো। এজন্য তিনি বাফুফে একাডেমিক ক্যাম্প শুরু করেছিলেন। এখন আমাদের ৭০ জন মেয়ে আছে। এখন আমাদের প্রধান লক্ষ্যটা হলো আমরা যে সাউথ এশিয়ার সেরা হলাম এই জায়গাটা ধরে রাখা এবং আশিয়ান অঞ্চলে একটা ভালো অবস্থান তৈরি করা। আমাদের সভাপতি আলোচনা করেছেন। এখন থেকে আশিয়ান অঞ্চলে বাংলাদেশের চেয়ে ভালো ভালো টিমগুলোর সঙ্গে আমাদের মেয়েরা নিয়মিত খেলবে। অন্যদিকে এখন আমাদের প্রত্যেকটা মেয়েদের বয়সই ১৮ থেকে ২০ এর মধ্যে। আমরা যদি আরও পাঁচ-ছয় একসাথে থাকতে পারি এবং তাদের বয়স যখন ২৫-২৬ হবে আশা করি আমাদের মেয়েরা তখন তাদের সর্বোচ্চটা দিতে পারবে। তখন তারা আরও ভালো কিছু করতে পারবে। এছাড়া আমরা এশিয়ায় একটা ভালো অবস্থানে যেতে পারব বলে আশা করছি। সেই লক্ষ্যে আমরা এখন থেকেই কাজ শুরু করে দিয়েছি। এর জন্য আমাদের যা যা দরকার ফেডারেশন থেকে আমাদের সবকিছুই দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে।
প্রশ্ন : বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের দায়িত্ব নেয়ার পর আপনার কাছে কখন মনে হয়েছিল যে এই মেয়েরা চ্যাম্পিয়ন হতে পারে এবং চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো যোগ্যতা তাদের হয়েছে?
গোলাম রাব্বানী ছোটন : ২০১২ সালে যখন সারা বাংলাদেশ থেকে এই মেয়েদের ট্যালেন্ট হান্ট থেকে নিয়ে আসা হয় তখন থেকেই তারা নিজেদের প্রমাণ করেছে। ২০১৭ সালে তারা অনূর্ধ্ব-১৫ সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়। ওই বছরই এএফসি কাপে তারা কোয়ালিফাই করে। ২০১৮ সালে আবার অনূর্ধ্ব-১৮ সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়। ২০১৯ সালে বঙ্গমাতা অনূর্ধ্ব-১৯ ইন্টারন্যাশনাল টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়ন হয়। ২০২১ সালে ভারতকে হারিয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ সাফ চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। তো তাদের যে প্রতিভা আছে ধারাবাহিকভাবে সেই শুরু থেকেই তারা মাঠে তা প্রমাণ করে আসছে এবং সবশেষ নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে তারা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। সেই শুরু থেকেই মেয়েরা নিজেদের প্রমাণ করে আসছে এবং ভবিষ্যতে এই মেয়েরা আরও অনেক ভালো করবে।
প্রশ্ন : সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে এবারই প্রথম ভারতকে হারিয়েছেন, নেপালকেও হারিয়েছেন তাও আবার ফাইনালে। আসলে কোন পরিকল্পনায় তাদেরকে বধ করেছেন?
গোলাম রাব্বানী ছোটন : আমরা ২০২১ সালে উজবেকিস্তানে যে এশিয়া কাপ খেলেছি সেখানে আমাদের অবস্থান ভালো ছিল না। সেখান থেকে এসে আমাদের অনেক কাটাছেড়া করতে হয়েছে। আমরা খেলোয়াড়দের সাথে বসেছি, আলোচনা করেছি। মেয়েরাও উপলব্ধি করতে পেরেছে। তখন থেকে আমরা খেলোয়াড়দের সব বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছি। তাদের ফিজিক্যাল, টেকনিক্যাল সব বিষয়েই আমরা জোর দিয়ে অনুশীলন করেছি। গত এক বছরে মেয়েরা কঠোর অনুশীলন করেছে। তারা তাদের ঈদ, পূজা তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে এই ভবনেই ছিল। এই এক বছরে সব ডিপার্টমেন্টে উন্নতি করার ফলেই আমাদের এই সাফল্য এসেছে।
প্রশ্ন : মেয়েদের কোচিং করানোর জন্য মানুষের নানা কটু কথা শুনতে হতো আপনাকে। আসলে সেই সময়টা আপনি কীভাবে পার করেছেন?
গোলাম রাব্বানী ছোটন : আমি শুরু করেছি সেই ২০০৯ সালে। তখন মেয়েরা ফুটবল খেলতে পারত না। তবে কোচিং করানো এটা অবশ্যই আমার প্যাশন। আমি এবং কোচিং স্টাফের যারা ছিল তাদের সবারই কাজের প্রতি একটা ভালোবাসা ছিল। মানুষ নানাভাবে কটু কথা বলেছে। হেয় করে কথা বলত; তবে ওসব কথার প্রতি কেউ কোনো তোয়াক্কা করিনি। কাজের প্রতি আমরা খুবই ব্যস্ত ছিলাম। তাদের এসব কথা নিয়ে কখনো ভাবতাম না। কাজের প্রতি মনোযোগী ছিলাম। আপনি বলেছিলেন যে অনেক সাধনার পরই কিন্তু এই সাফল্য এসেছে। আসলেই তাই; আমরা সাধনা করেছি বলেই আমাদের এই সাফল্য ধরা দিয়েছে। মাঝে মাঝে খারাপ লাগতো মানুষের অনেক কটু কথা শুনে। তবে খারাপ লাগলেও আমার লক্ষ্য ওই একটাই ছিল; ভালো কিছু করা। তবে সামনে আরও ভালো করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
প্রশ্ন : মানুষের এমন কটু কথায় কখনো কী ভেঙে পড়েছিলেন? কিংবা কখনো কী আপনার মনে হয়েছে যে মেয়েদের কোচিং করানো ছেড়ে দেই!
গোলাম রাব্বানী ছোটন : না, এ রকম কখনো মনে হয়নি। কারণ কাজ তো কাজই। যেহেতু আমি ফেডারেশনে চাকরি করি সেহেতু ফেডারেশন আমাকে যেখানেই দিবে আমি সেখানেই মনোযোগ দিয়ে কাজ করব। আমার লক্ষ্য ছিল যে, আমি যেখানে আসছি এই দলটাকে উন্নতি করা। তারা যেন ভালো খেলতে পারে এবং ভালো কিছু করতে পারে সে লক্ষ্যেই আমি কাজ করেছি। এবং সবাই জেনে খুশি হবেন যে নেপালে ট্যাক্সি ড্রাইভার থেকে শুরু করে সবাই বাংলাদেশের মেয়েদের খেলা দেখে ভূয়সী প্রশংসা করেছে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলেও অনেকেই বাংলাদেশের মেয়েদের খেলার প্রশংসা করেছে। যখন নেপালের ট্যাক্সি ড্রাইভার এবং সে দেশের মানুষ আমার দেশের মেয়েদের খেলার প্রশংসা করে এটা শুনে অবশ্যই গর্ব হয়েছে।
প্রশ্ন : চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর খেলোয়াড়দের বেতন বাড়ানোর আশ্বাস দিয়েছে ফেডারেশন। সেটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কতটুকু এগিয়েছে বাফুফে?
গোলাম রাব্বানী ছোটন : ফেডারেশন সবসময় চেষ্টা করে যাচ্ছে মেয়েদের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা দেয়ার জন্য। তবে ফেডারেশনেরও একটা সীমাবদ্ধতা আছে। এখানে যে একাডেমি চলছে সেটি ৭০ জনের। এখানে অনেক টাকা ইনভেস্ট করতে হচ্ছে। তাদের থাকা, খাওয়া, ট্রেনিং, ট্রান্সপোর্ট সবকিছু মিলিয়েই তাদের পিছনে অনেক ইনভেস্ট করতে হচ্ছে। আপনি দেখবেন যে অন্যান্য খেলোয়াড়দের কিন্তু বেতনও নেই। তবে আমাদের মেয়েদের বেতন আছে। নেপাল থেকে আসার পর মেয়েরা সভাপতির সাথে বসেছিলেন। সেখানে মেয়েরা যা যা চেয়েছে সবকিছুরই আশ্বাস তিনি দিয়েছেন। সম্মানজনক একটা বেতনও তাদেরকে দেয়া হবে। আশা করি খুব দ্রুতই এটার বাস্তবায়ন হবে।
প্রশ্ন : সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জার্নিটা আসলে কেমন ছিল? শুরু থেকে জানতে চাই আপনার কাছে?
গোলাম রাব্বানী ছোটন : জার্নিটা শুরুতে খুব একটা ভালো ছিল না। কারণ ফিফা থেকে মহিলা টিমের জন্য অনুদান দিত মাত্র ১৫ শতাংশ। পুরুষ টিমের অনুদান দিত ৮৫ শতাংশ। যেখানে ফিন্যান্সিয়াল একটা সমস্যা তো ছিলই! অধিকাংশ মেয়েরাই এসেছে দরিদ্র পরিবার থেকে। তারা যে এলাকা থেকে উঠে এসেছে সেই এলাকাগুলোও খুব একটা উন্নত নয়। তাদের পরিবারের সদস্যরাও যেমন মা-বাবা তারা বিশ্বাস করতে পারত না যে মেয়েরা ফুটবল খেলতে পারে। অভিভাবকরা ভাবতো যে ফুটবল খেলতে গিয়ে তাদের হাত পা ভেঙে যাবে। তারা ইনজুরি হবে। তাদের বিয়ে হবে না ইত্যাদি সমস্যা তো ছিলই। এছাড়াও তারা তখন খোলা মাঠে ট্রেনিং করতে পারত না। ছেলেরা তো যেকোনো জায়গায় খেলতে পারবে কিন্তু মেয়েরা পারত না। ফুটবল খেলার জন্য একটা পোশাক আছে। মেয়েরা তখন ফুটবল খেলার পোশাকও পড়তে পারত না। তারা তখন পায়জামা, জামা পড়ে এসে একটা স্কুলের ভিতরে ঢুকে ট্রেনিং করত। তারপরও নানা মানুষের অনেক কথা শুনতে হতো। এরপরও যারা আমাদের নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন; যারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করেছে এবং জেলাপর্যায়ে কাজ করেছে মেয়েদেরকে নিয়ে তাদের প্রচুর কথা শুনতে হয়েছে। নানা রকম বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাদের এবং তাদেরকে অনেকের সাথে ফাইট করতে হয়েছে। সমাজেরও অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হতো প্রতিনিয়ত। বাফুফের সভাপতি যে উন্নতির স্বপ্ন দেখেছেন তা হয়তো কিছুটা বাস্তবায়ন করতে পেরেছি। প্রচুর কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে এবং আমি মনে করি এই সাফল্য সেই কঠোর পরিশ্রমেরই প্রতিফলন।