মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ এনে গত বছরের ৯ ডিসেম্বর র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সাবেক মহাপরিচালক ও বর্তমান আইজিপি বেনজীর আহমেদসহ বাহিনীটির সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট (রাজস্ব বিভাগ) ও পররাষ্ট্র দপ্তর। এ বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে জাতিসংঘে পুলিশ প্রধানদের সম্মেলনের অংশগ্রহণকে কেন্দ্র করে। এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই ধারণা করেছিলেন হয়তো বাংলাদেশের পুলিশ প্রধান সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না, পরবর্তী সময়ে আলোচনা ও চিঠি আদান প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশের পুলিশ প্রধান সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।
যুক্তরাষ্ট্র প্রদত্ত মানবাধিকারের রিপোর্টে বাংলাদেশ পুলিশের আইজি ড. বেনজীর আহমেদ ছাড়াও বিশ্বের অন্তত ১২টি দেশের পুলিশ প্রধান ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। বিভিন্ন সময়ে বিশ্লেষকগণ এ সংক্রান্ত মন্তব্য করে থাকেন; তারা মনে করেন এ ধরনের বিধি নিষেধের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক রাজনীতি ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আলোচিত এ নিষেধাজ্ঞায় শুধু বাংলাদেশের পুলিশ প্রধান নয়, এর সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখা বৃহৎ দেশগুলোর পুলিশ প্রধান ও বাহিনীও রয়েছে। অন্যদিকে, জার্মানির বার্লিনভিত্তিক ওপেন স্যাংশনস সংস্থাটি বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশ, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার তথ্য সংরক্ষণ ও হালনাগাদ করে থাকে। এই পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বের অন্তত ১২টি দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও তাদের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আওতায়। কিছু কিছু বাহিনী ও কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয় ইউনিয়ন, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও জার্মানিরও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কাজেই, নিষেধাজ্ঞার কারণ ও অন্যান্য বিষয়াদি খতিয়ে দেখলে সহজেই বোঝা যাবে, বৈশ্বিক রাজনীতি ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নিয়ন্ত্রণের উপর নির্ভর করে অনেককেই নিষেধাজ্ঞার খড়গ পোহাতে হয়।
রাশিয়া, চীন, ইরান, উত্তর কোরিয়া, বেলারুশ, মিয়ানমার, ভেনিজুয়েলা, কিউবা, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও সিরিয়ার পুলিশ প্রধানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। জাতিসংঘের ১৯৩টি দেশের মধ্যে এই কয়েকটি দেশ নিষেধাজ্ঞার আওতায়। কিন্তু প্রত্যেকটি দেশের ভূ-রাজনীতি ও বিশ্ব রাজনীতিতে ব্যাপক গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। এসব দেশের মধ্যে কোনও কোনোটির পুরো বাহিনী আবার কোনও কোনও দেশের পুলিশ কর্মকর্তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট (রাজস্ব বিভাগ) ও পররাষ্ট্র দফতরের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বা অর্থ দপ্তরের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, সকল মার্কিন নাগরিক বা স্থায়ী বসবাসের অনুমতি রয়েছে, এমন সকল ব্যক্তি, যেখানেই থাকুন না কেন, অফিস অব ফরেন অ্যাসেটস কন্ট্রোল (ওএফএসি) এর নির্দেশনা মেনে চলতে বাধ্য। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র যেসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে, সে সকল প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির সঙ্গে মার্কিন কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কোন রকম লেনদেন বা সম্পর্ক রক্ষা করতে পারে না। নিষেধাজ্ঞায় অভিযুক্তের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক নষ্ট হয় এবং তারা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে পারবেন না। এ শর্তে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের যুক্তরাষ্ট্রে থাকা সকল অর্থ-সম্পদ, মার্কিন কোন ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে থাকা সম্পদ জব্দ থাকবে। এগুলো হস্তান্তর, প্রদান বা লেনদেন করা যাবে না। সেই সঙ্গে যেসব প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধিত, তাদের বিদেশি শাখাকেও এই নির্দেশনা মানতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্র ভর্তুকি বা অনুদান দিয়ে থাকে, অথবা যুক্তরাষ্ট্র পরিচালনা করে, তাদের জন্যও এই নির্দেশনা কার্যকর হবে। যদি কেউ সেটা লঙ্ঘন করে, তাহলে বিভিন্ন অংকের জরিমানার মুখোমুখি হতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞা বন্ধু দেশগুলো মানতে বাধ্য নয়। কিন্তু কানাডা, যুক্তরাজ্য, জার্মানি বা অস্ট্রেলিয়ার মতো যেসব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, তারাও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা অনুসরণ করে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্র যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাঙালিদের নাগরিক সমাবেশে বলেছেন, এ বিষয়টির নেপথ্যে তিন বছর ধরে বাংলাদেশিদের একটি চক্রের চারটি লবিস্ট ফার্ম কাজ করেছে। এসব বাংলাদেশিরা তাদের অবয়বে বাঙালি হলেও তারা প্রকৃত বাঙালি নন। তারা কৃত্রিম বাঙালি। তারা দেশ ও দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিকভাবেই ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছেন। তিনি আরো বলেন, ‘আজকে আমি যুক্তরাষ্ট্রে এসেছি, যুক্তরাষ্ট্রের বুকে দাঁড়িয়ে আছি। আমি এই দেশে অনেকবার এসেছি, এখানে লেখাপড়া করেছি, চাকরি করেছি। সেই যুক্তরাষ্ট্র আমাকে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। আমাকে তাদের নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। আমি পশ্চিমা ভাবধারা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী একজন মানুষ। সেই মূল্যবোধটি হচ্ছে গণতন্ত্রের মূল্যবোধ। মানবতা ও মানবাধিকারের মূল্যবোধ। আমি তাদের স্বাধীনতায়ও বিশ্বাসী। আমি মানবতা ও মানবাধিকারে বিশ্বাস করি কিন্তু আমার বিরুদ্ধেই এটা হলো।’
আইজিপি বলেন, ‘আমি এজন্য আমেরিকান সরকারকে দায়ী করব না। কারণ হচ্ছে, এটা ষড়যন্ত্রকারীদের তিন বছরের ফসল। চারটি লবিস্ট ফার্মকে নিয়োগ করা হয়েছে। প্রতিটি ফার্মকে ২৫ মিলিয়ন (ডলার) করে দেওয়া হয়েছে। এটা একশ মিলিয়নের প্রজেক্ট। এই নিষেধাজ্ঞা হলো তার ফলাফল। এর সঙ্গে সত্যের কোনো সম্পর্ক নেই। আমি আমেরিকার সরকারকেও কোনো দোষ দেব না, দায়ী করব না। আমেরিকান নাগরিকরা তো লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করেনি। কারা এই লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করেছে, তা ওয়েবসাইটে লেখা রয়েছে। তারা কারা? তারা তো আমেরিকান লোক না, এখানে তারা বসবাসও করে না। তাই আমেরিকানদের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই। বরং আমি যেটা মনে করি, আমাদের সঙ্গে আমেরিকানদের একটা শক্তিশালী সম্পর্ক রয়েছে। তাদের নাগরিকদের সঙ্গে আমাদের নাগরিকদের সম্পর্ক রয়েছে।’ বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘যে সময়ের কথা বলা হয়েছে, তখন আমি আমেরিকায় চাকরি করি। তাহলে তখন তারা আমাকে বের করে দিল না কেন?’ কাজেই এ নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা থাকতে পারে তথা সরকারকে বিশ্ববাসীর নিকট বেকায়দায় ফেলার একটি প্রক্রিয়াও বলা যেতে পারে।
বিভিন্ন দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞা কি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত? কেননা, তারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে বিভিন্ন সময়ে কতিপয় রাষ্ট্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তবে বিশ্লেষক মনে করেন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার এবং সুশাসনের কথা বলে বিভিন্ন দেশকে চীন-রাশিয়ার পক্ষ থেকে সরিয়ে এনে কার্যত দলের পাল্লা ভারী করা। এরা সাম্রাজ্যবাদের বিস্তারের জন্য কতিপয় রাষ্ট্রের ওপর ইচ্ছাকৃত চাপ সৃষ্টি করে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ কূটনীতিতে বেশ পারদর্শিতা দেখিয়েছে এবং সে কারণেই বাংলাদেশ পুরোপুরি চীন-রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে আছে, তা বলা যাবে না; বরং সবদিকেই ভারসাম্য রক্ষা করে চলার চেষ্টা করছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র চায়, বাংলাদেশ প্রশান্ত মহাসাগরীয় সামরিক জোটে যোগ দিক। তবে বাংলাদেশ এখনো এসব জোটে যোগদানের বিষয়ে তেমন আগ্রহ না দেখানোয় বিভিন্ন পক্ষ হতে চাপ আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাও এ চাপের অংশও হতে পারে।
কাজেই, লবিস্ট ফার্ম মূলত যে কাজটি করে তা হল-তাদের উদ্ভাবিত বা প্রতিষ্ঠিত তথ্যগুলো বিভিন্ন মাধ্যমে অর্থের বিনিময়ে প্রকাশ করে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে সরকারের বিরুদ্ধে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে থাকে। এ কাজটি তারা অত্যন্ত সুকৌশলে ও পরিকল্পিতভাবে করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় আমরা দেখেছি, প্রকৃত অপরাধীদেরকে বাঁচাতে সরকারের ওপর নানা পক্ষ থেকে চাপ এসেছে, তারা মানবাধিকারের দোহাই দিয়েছে। দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ফোন আমাদের বিচলিত করেছে, করেছে দ্বিধান্বিত। পরবর্তী সময়ে আমরা জেনেছি মূলত টাকার বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে সমর্থন নেওয়ার জন্যই একটি পক্ষ এ ধরনের অপচেষ্টায় মেতে উঠেছিল। কিন্তু সরকারের দূরদর্শী সিদ্ধান্ত ও সাহসী ভূমিকার কারণেই বিচারের রায় হওয়া যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি নিশ্চিত হয়েছে। বর্তমান সময়েও একটি পক্ষ সরকারের বিরুদ্ধাচারণের স্বার্থেই লবিস্ট নিয়োগ করে নিজেদের বানানো মিথ্যা তথ্যকে সর্বমহলে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টায় কাজ করে যাচ্ছে। তবে সরকারও এ বিষয়ে যথেষ্ট সজাগ থাকায় লবিস্টরা তেমন একটা সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারছে না। যার সর্বশেষ প্রমাণ, জাতিসংঘে পুলিশ প্রধানদের সম্মেলনে আইজিপির যোগদান। আর এর মধ্য দিয়ে লবিস্টদের ব্যর্থতাই প্রকাশ পায়।
তবে যে বিষয়টি খুব জরুরী তা হচ্ছে, দেশবিরোধী প্রচারণায় যারা জড়িত তাদেরকে কার্যকরভাবে সনাক্ত করে দেশীয় আইনে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। আর যারা দেশের বাইরে থেকে দেশের বিরুদ্ধে প্রচারণায় নিয়োজিত তাদেরকেও যে কোন মূল্যে দেশে ফেরত এনে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। তাছাড়া যারা লবিস্ট নিয়োগে অর্থকড়ি দিয়ে সহযোগিতা করে থাকে তাদেরকেও সনাক্ত করে দেশ ও দশের সামনে মুখোশ উন্মোচন করে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই পরবর্তী সময়ে এ ধরনের অস্থিতিশীল ও বিব্রতকর প্রচার প্রচারণা থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত রাখা যাবে।