৫৭/৮, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড, কলকাতা। ১৯৭১-এ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সব অনুষ্ঠান এই বাড়ি থেকেই রেকর্ড হতো, আমরা তখন এই বেতার কেন্দ্রেই দিনরাত কাটিয়েছি। বর্তমানে বাসাটির নাম গুপ্তা হাউজ। প্রায় ৪৮ বছর পর ২০১৮ সালে আমি কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সেই ভবনটি দেখতে যাই।
বাংলার পবিত্র মাটি থেকে পাকিস্তানি হানাদারদের বিতাড়িত করার জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি যে যুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের উত্সাহ-উদ্দীপনা ও সাহস জুগিয়েছে; জুগিয়েছে সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে অনুপ্রেরণা এবং হানাদার বাহিনীকে সর্বক্ষণ রেখেছে ভীতসন্ত্রস্ত, তা হলো মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ। আর এই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ পরিচালনা করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সরকারের দখলকৃত এলাকার ছয়টি বেতারকেন্দ্র থেকে অবিরাম মুক্তিযোদ্ধা ও বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে ভয়াবহভাবে মিথ্যাচার ও অপপ্রচার চালানো হয়েছে। তার বিরুদ্ধে জবাব দেওয়া হয়েছে একমাত্র বেতার কেন্দ্র থেকে। এই বেতার কেন্দ্রই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। আর এই বেতার কেন্দ্রের একজন কণ্ঠসৈনিক ছিলাম আমি। যার জন্য নিজেকে গর্বিত মনে করি।
একদিন ভোর ৫টায় চুপি চুপি দরজাটা খুলে ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের উদ্দেশে। নীলক্ষেত থেকে ইপিআরটিসি (বর্তমান বিআরটিসি) বাসে উঠলাম। কাঁচপুর, দাউদকান্দি হয়ে কুমিল্লা পৌঁছলাম। দাউদকান্দিতে গিয়ে দেখলাম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ব্রাশ ফায়ার করছে, সবাইকে চোখ বেঁধে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। কাউকে আবার ছেড়ে দিচ্ছে, আমাকে কোনো প্রশ্ন না করে এক ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিল মিলিশিয়া আর রাজাকার-আলবদররা। দৈবক্রমে বেঁচে গেলাম। ঈশ্বর আমার সহায় ছিলেন। এরপর কুমিল্লার আড়িখোলা গ্রামের এক পরিবারের সঙ্গে রাত কাটিয়ে তাদেরই সহযোগিতায় পরদিন পার হলাম বর্ডার। পৌঁছলাম আগরতলা, সেখানে কলেজটিলায় গণসংগীতের একটি দল ইতিমধ্যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু করেছে। সেখানে এক মাস থাকলাম। কাজ ছিল প্রতিদিন সন্ধ্যায় মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য দেশাত্মবোধক, উদ্দীপনামূলক গান শোনানো। এরপর পল্লিগীতি শিল্পী মরহুম সরদার আলাউদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে আগরতলা থেকে কলকাতায় ৫৭/৮, বালীগঞ্জ সার্কুলার রোডে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পৌঁছলাম। সেখানে গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গান শুরু করলাম।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এবং সেখানে রেকর্ডকৃত বেশির ভাগ গানেই আমার কণ্ঠ আছে। এই সময় পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, নোঙর তোলো তোলো, ও আমার দেশের মাটি, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি ইত্যাদি দেশের গান গাওয়া হতো দল বেঁধে। বিভিন্ন মুক্তিযুদ্ধ কলকাতায় ক্যাম্পে প্রখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গে আমরা গান গাইতাম। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা হলো, স্বাধীন বাংলা বেতার একদিন প্রখ্যাত লোকসংগীত শিল্পী হরলাল রায় আমাকে দিয়ে একটি দ্বৈত সংগীত গাওয়ালেন নাসরিন আহম্মদ শীলু আপার সঙ্গে (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি, তখন তিনি ইংরেজি সংবাদ পাঠ করতেন) গানটির কথা ছিল ‘জ্বলছে জ্বলছে প্রাণ আমার দেশ আমার’, গানটি লিখেছিলেন গীতিকার শহিদুল ইসলাম। এই গানটি ছিল আমার গাওয়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রথম দ্বৈত সংগীত। গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারের দিন প্রথম বারের মতো আমার নাম ঘোষণা করা হয়। দিনটি ছিল ২১ অক্টোবর ১৯৭১, দ্বিতীয় অধিবেশনে গানটি প্রচার হয় এবং সেই দিনই আমার বাবা-মা বাংলাদেশে থেকে জানতে পারেন, আমি জীবিত আছি, এটা আমার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
প্রথম পর্যায়ে চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র সংগঠিত হয়েছিল চট্টগ্রাম বেতারের ১০ জন নিবেদিতকর্মী (দুজন বেতারকর্মী ছিলেন না), স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, জনগণ এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সহযোগিতায়। এই বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের ১০ জন সার্বক্ষণিক সংগঠক ছিলেন সর্বজনাব বেলাল মোহাম্মদ (উক্ত বেতারের তত্কালীন নিজস্ব শিল্পী), আব্দুল কাশেম সন্দ্বীপ (ফটিকছড়ি কলেজের তৎকালীন ভাইস প্রিন্সিপাল), সৈয়দ আব্দুল শাকের (চট্টগ্রাম বেতারের তৎকালীন বেতার প্রকৌশলী), আব্দুল্লাহ আল ফারুক (তৎকালীন অনুষ্ঠান প্রযোজক), মোস্তফা আনোয়ার (তৎকালীন অনুষ্ঠান প্রযোজক), রাশেদুর হোসেন (তৎকালীন টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট), আমিনুর রহমান (তৎকালীন টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট), শারফজ্জামান (তৎকালীন টেকনিক্যাল অপারেটর), রেজাউল করিম চৌধুরী (তৎকালীন টেকনিক্যাল অপারেটর) এবং কাজী হাবিব উদ্দিন (ইনি বেতারকর্মী ছিলেন না) স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন বেলাল মোহাম্মদ।
ইথারে ভেসে আসা শব্দ যে বুলেটের চেয়েও শক্তি নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে আঘাত হানতে পারে, তার প্রমাণ হচ্ছে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’, ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে টিক্কা-নিয়াজি-ফরমান আলির পাকিস্তানি পশুরা সেদিন বুলেট-বেয়নেট দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামকে স্তব্ধ করতে চেয়েছিল। আর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হাতিয়ারের চেয়ে শক্তিশালী আঘাত হেনেছে নরপশুদের বিরুদ্ধে। এই কেন্দ্র থেকেই বাংলাদেশের নবগঠিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণ ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল প্রথম বারের মতো বহির্বিশ্বে প্রচারিত হয়। মুজিবনগর সরকার নিজস্ব পূর্ণাঙ্গ বেতার কেন্দ্রের গুরুত্ব অনুধাবন করে ভারত সরকারের সহযোগিতায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে। প্রাপ্ত যন্ত্রপাতি দিয়ে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ১৯৭১ সালের ২৫ মে মুজিবনগর থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যক্রম শুরু করে, যা ১৯৭২ সালের ২ জানুয়ারি পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই অবদানের কথা যেমন অনস্বীকার্য তেমনি এই বেতার কেন্দ্রের সব শিল্পী-কলাকুশলীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি ও যুদ্ধে তাদের প্রশংসনীয় ভূমিকা ও সব পর্যায়ে সমাদৃত। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র তাই এক অবিস্মরণীয় নাম।