দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের (সরকারিকরণ) দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা শিক্ষকেরা আন্দোলন করছেন। মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের এক দফা দাবিতে ১১ জুলাই থেকে শিক্ষকেরা প্রেসক্লাবের সামনে পালন করছেন লাগাতার এই অবস্থান কর্মসূচি। এই লেখা যখন লিখছি, তখন আন্দোলনের ১৬তম দিন অতিবাহিত হয়েছে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এই কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান করছেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের এই শিক্ষকেরা। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির ব্যানারে পালন করছেন এই কর্মসূচি। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অস্থায়ী মঞ্চে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির নেতারা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা শিক্ষক নেতারা ধারাবাহিকভাবে বক্তব্য রাখছেন। বক্তব্যে দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরছেন। তারা তাদের দাবির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
প্রায় দুই বছর করোনার অতিমারিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় লেখা-পড়ার অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, এ অবস্থায় এই মুহূর্তে শিক্ষকেরা আন্দোলনে কেন? কেন ক্লাসরুম থেকে রাজপথে? শিক্ষক ক্লাসরুমে থাকবেন, শিক্ষা দেবেন—এটাই স্বাভাবিক। তাদের রাজপথে মানায় না। অন্য সব পেশার মতো শিক্ষকতা পেশা নয়।
মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গত ২০ জুলাই থেকে ২ আগস্ট পর্যন্ত গ্রীষ্মকালীন ছুটি ছিল। ছাত্রছাত্রীদের যাতে ক্লাসের ক্ষতি না হয়—এ কথা ভেবেই হয়তো বন্ধের এই সময়টায় দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলনে গেছেন শিক্ষকেরা। কিন্তু হঠাত্ করেই সরকার গ্রীষ্মকালীন ছুটি বাতিল করে এই ছচুটি শীতকালীন ছুটির সঙ্গে যুক্ত করার ঘোষণা দিলেন। এদিকে কলেজ ও মাদ্রসার শিক্ষকেরাও শিক্ষা জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলনের অংশ হিসেবে মানববন্ধন এবং প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেছেন।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অধিকাংশই এমপিওভুক্ত। এর মানে হলো, এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকার থেকে বেতনের মূল অংশসহ কিছু ভাতা পান।
স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে শিক্ষক সমাজ এখনো অর্থনৈতিক পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে পারেনি। শিক্ষকদের অবস্থা আজও অত্যন্ত নাজুক, সামাজিকভাবে তো বটেই পেশাগতভাবেও। বেসরকারি (এমপিওভুক্ত) শিক্ষকগণ আরো অবহেলিত। এ দেশের প্রায় ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে ২৬ হাজার বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায়। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক-কর্মচারীর অবস্থা আরো নাজুক। অনেক প্রতিষ্ঠানেই নেই লাইব্রেরি, নেই গবেষণাগার ও খেলার মাঠ। যেসব প্রতিষ্ঠানে আছে তা মানসম্মত নয়। নেই প্রয়োজনীয়সংখ্যক শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষা উপকরণ ও আসবাবপত্র। অনেক প্রতিষ্ঠান হয়নি এমপিওভুক্ত। আবার অনেক এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানেরও সব শিক্ষক এমপিওভুক্ত নন। এদের অবস্থা আরো করুণ। যেসব শিক্ষক এমপিওভুক্ত হয়েছেন, তাদের অধিকাংশ চাকরির শুরু থেকেও এমপিওভুক্ত হননি। অথচ এমপিওভুক্তির তারিখ থেকে শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরির অভিজ্ঞতা হিসাব করা হয়। বছরের পর বছর বেতন না পাওয়া অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ শিক্ষা দেওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এমনকি এমপিওভুক্ত হওয়ার আগেই অবসরে যান অনেক শিক্ষক।
সব পেশাতেই সুযোগ-সুবিধা দিনে দিনে বাড়ে। বেসরকারি কলেজের প্রভাষকদের পদোন্নতির বিষয়টা অত্যন্ত জটিল ও অমানবিক। আগে সৌভাগ্যবান কলেজ শিক্ষকগণ পদোন্নতি পেয়ে সহকারী অধ্যাপক হতেন। বর্তমানে বেসরকারি শিক্ষকদের এমপিও নীতিমালা-২০১৮ অনুযায়ী উচ্চমাধ্যমিক কলেজের শিক্ষকেরা পদোন্নতি পেয়ে হবেন জ্যেষ্ঠ প্রভাষক। পদোন্নতির জটিল নিয়মে অনেক শিক্ষককেই প্রভাষক পদ থেকেই অবসর নিতে হয়। দরকার সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি আরো সহজ করে সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করা। প্রতিষ্ঠানের প্রধান (অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক, সুপার) থেকে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী সবার বাড়িভাড়া মাত্র ১০০০ টাকা, যা হাস্যকর ও লজ্জাজনক।
সরকারি চাকরিজীবীরা অবসরজীবনেও উৎসব বোনাস পান। অনেক ক্ষেত্রে চাকরিজীবী মৃত্যুর পর তার পরিবারও পায় উৎসব বোনাস। অন্যদিকে চাকরিতে থাকাকালীনই কেবল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ মূল বেতন স্কেলের ২৫ শতাংশ বোনাস পান, যা দেখে মনে হয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক পরিবারের উৎসব-পার্বণ থাকতে নেই। বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা ভাতা থেকেও বঞ্চিত, যা মাত্র ৫০০ টাকা। লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের বর্তমান যুগে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পরিবার-পরিজন নিয়ে স্বাভাবিক জীবন পরিচালনা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের দুর্ঘটনাজনিত কারণে কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। অথচ শ্রম আইনে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান আছে। এমপিওভুক্ত স্বল্প বেতনের শিক্ষকগণ শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসরের পর জীবনসায়াহ্নে অবসর সুবিধার অর্থের দুশ্চিন্তায় দিন পার করেন।
শিক্ষকদের অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণের কথাটি বারবার উচ্চারিত হয়েছে। হয়েছে শ্রেণিকক্ষ থেকে রাজপথে আন্দোলন। বেসরকারি শিক্ষকদের কথা বললেই সরকার থেকে শুরু করে অনেকেই দেশের দারিদ্র্যের কথা তোলেন, যেন শিক্ষার জন্য যথোপযুক্ত অর্থসংস্থান ছাড়াই শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটবে। যেহেতু দেশের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তাই বেসরকারি শিক্ষকদের ওপর জাতির কৃষ্টি, সভ্যতা ও সমৃদ্ধি অনেকটা নির্ভর করে। বেসরকারি শিক্ষকদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান না করে শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। শিক্ষক সংগঠনগুলোর দাবি, এই সমস্যার সমাধানে চাকরি জাতীয়করণের ব্যবস্থা গ্রহণ করে শিক্ষকদের অতীত যাবতীয় অসংগতি বিবেচনায় এনে শিক্ষকদের মর্যাদা দিতে হবে। তারা আরো বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমুদয় অর্থ-সম্পদ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিলে শিক্ষা জাতীয়করণের জন্য সরকারের অতিরিক্ত তেমন কোনো অর্থ লাগবে না। শুধু দরকার সদিচ্ছার। শিক্ষা জাতীয়করণ না হলে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীরা আকৃষ্ট হবেন না। দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকদের পৃথক বেতন স্কেলও দেওয়া উচিত। এটা শিক্ষার জন্য, দেশ ও জাতির জন্য, ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য করা উচিত।
আমরা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কথা শুনতে পাচ্ছি। শুনতে পাচ্ছি স্মার্ট বাংলাদেশের কথাও। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আমাদের জন্য আশা, নাকি আশঙ্কা? চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মূল একটি স্তম্ভ হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। সেটি কার্যকর করার জন্য দরকার বিশাল ডেটা এবং ডেটা প্রক্রিয়া করার জন্য অচিন্তনীয় কম্পিউটিং পাওয়ার, যার কোনোটাই এই মুহূর্তে আমাদের নেই। এসব কার্যকর করার জন্য জ্ঞানভিত্তিক (Knowledgebase) দেশ হিসেবে গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। বর্তমানে জ্ঞানভিত্তিক দেশ হিসেবে আমাদের দেশ পৃথিবীর গড় অবস্থানেরও নিচে। জ্ঞানভিত্তিক দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে বিজ্ঞানকে গুরুত্ব দিতে হবে। সবচেয়ে দুঃখের ও হতাশার ব্যাপার হচ্ছে, শিক্ষায় আমরা আমাদের জিডিপির ২ শতাংশের কাছাকাছি ব্যয় করি, যেখানে ব্যয় করার কথা ৬ শতাংশ। মুখস্থনির্ভর ও পরীক্ষানির্ভর নিরানন্দ লেখাপড়া এবং কোচিং সেন্টারের রমরমা ব্যবসা থেকে মুক্তি জরুরি।
দীর্ঘদিন ধরে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবি জানিয়ে আসছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা। শিক্ষকদের কোনো দাবির জন্য রাস্তায় নামতে হয়—এটা দেশ ও জাতির জন্য লজ্জাজনক, কলঙ্কজনক। শিক্ষা জাতীয়করণের মাধ্যমে মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য দেশের সব শিশুকে জ্ঞানবিজ্ঞানে, গবেষণার সক্ষমতায় স্মার্ট নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ হবে (বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার) স্মার্ট মানুষের দেশ।
আজকের শিক্ষকেরা আগামীর বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে সব সমস্যার যৌক্তিক সমাধানে শিক্ষা থেকে অন্তরায়ের সব জগদ্দল পাথর সরাতে হবে। করতে হবে এই পেশায় মেধাবীদের আকৃষ্ট। শিক্ষার্থীদের শ্রেষ্ঠ করে গড়ে তোলার জন্য তুলে দিতে হবে শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের হাতে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ভবিষ্যত্ সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে স্বপ্নবাজ হয়ে গড়ে ওঠুক শিক্ষার্থীরা। আলোকিত জাতি গঠনের মাধ্যমে আমাদের দেশ পৃথিবীর বুকে স্মার্ট বাংলাদেশ হয়ে দাঁড়াক মাথা উঁচু করে।