একজন আদর্শ শিক্ষক কেবল শিক্ষকই নন; একাধারে তিনি একজন মেনটর, কাউন্সেলর, ইন্সপিরেটর, পথপ্রদর্শক এবং সর্বোপরি একজন অভিভাবক। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে একটি ঘটনা বলি। বিশ্ববিদ্যালয়ে থিসিস গ্রুপে নির্বাচিত হওয়ার পর রিসার্চ সুপারভাইজার জানতে চাইলেন আমার ল্যাপটপ আছে কি না। আমি উত্তরে নেই বলে, এক সপ্তাহের মধ্যে কিনে নেওয়ার কথা জানালাম। এক সপ্তাহ পর আবারো তিনদিন সময় নিলাম। তবু কিনতে না পেরে আর দুইদিন সময় চাইলাম। তৎক্ষণাৎ তিনি আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘পৃথিবীতে বাবা-মা তথা পরিবারের পরে সব কথা নিঃসংকোচে শেয়ার করার মতো আস্থার জায়গা যদি আমাকে না মনে করতে পার তাহলে আমি সুপারভাইজার বা শিক্ষক হিসেবে ব্যর্থ হয়েছি।’ এই বলে তিনি লকার থেকে একটি ল্যাপটপ বের করে দিয়ে বললেন, এটা তোমার জন্য এবং চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত ল্যাপটপ না কিনে এটাই তোমার কাছে রাখবে।
তবে ইদানীং শিক্ষকদের নিয়ে যথেষ্ট অভিযোগ রয়েছে। ঠিকমতো শ্রেণিকক্ষে পাঠদান না করে প্রাইভেট বা কোচিংয়ে ডাকা প্রধান অভিযোগ। ভালোমন্দ মিলিয়েই যেমন মানুষ, তেমনি শিক্ষকদের মধ্যেও কিছু অর্থলোভী রয়েছেন। তবে সমস্যাটা কেবল এই শিক্ষকদের না; সমস্যাটা আমাদের সিস্টেমের। পৃথিবীর সবচেয়ে মহান পেশা শিক্ষাদান করেও যখন একজন ব্যক্তি অবহেলিত বা নিম্নশ্রেণির কর্মচারী হিসেবে বিবেচিত হন, অপর্যাপ্ত আর্থিক সুবিধা পান তখন তাঁর কাছে খুব বেশি কিছু আশা করাটাও খুব জ্ঞানীর কাজ নয়। শিক্ষকরা যদি পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা ও সামাজিক মর্যাদা পেতেন তাহলে আমার মনে হয় না যে সারা দিনের ক্লাস শেষে নিজের সুখ-শান্তি বিসর্জন দিয়ে আবার তাঁরা প্রাইভেট পড়াতেন।
একই বিসিএসে ক্যাডার হয়ে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তা গ্রেডের ওপরে সুপার গ্রেড পেয়ে চাকরি শেষ করেন। অথচ শিক্ষা ক্যাডারে কয়জন গ্রেড-৩ পর্যন্ত যাওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন! এমনকি গ্রেড ৩-এ গিয়েও তার সামাজিক মর্যাদা অন্য কিছু ক্যাডারের গ্রেড ৬-এর চেয়েও কম থাকে! আর এজন্যই একজন ক্যান্ডিডেটের পছন্দ তালিকার সবচেয়ে নিচের দিকে থাকে শিক্ষা ক্যাডার। অথচ সামগ্রিক জাতীয় কল্যাণে চিত্রটি এর বিপরীত হওয়া উচিত ছিল। তাহলে এত বৈষম্য ও সমস্যার বোঝা যার ঘড়ে তার কাছে কীভাবে আমরা সর্বোচ্চ সার্ভিস আশা করব? তবে এসব সমস্যার সমাধানের পথ এখনো রুদ্ধ হয়ে যায়নি। সৎ, যোগ্য, ও নিবেদিত শিক্ষকদের সমাবেশ ঘটাতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। যেমন: ১. শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি স্বতন্ত্র কমিশন গঠন যার মূল কাজ হবে মেধাবী ও নিবেদিত প্রার্থী বাছাই করা। এক্ষেত্রে অবশ্যই তাঁর পঠিত বিষয় বা যে বিষয়ে সে পাঠদান করবে সেই বিষয়ে জ্ঞানের গভীরতাকে প্রাধান্য দিতে হবে। পাঠদানের সক্ষমতা যাচাইয়ে প্রদর্শনী ক্লাসের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এক্ষেত্রে পঠিত বিষয়ে তাঁর লব্ধ গবেষণা ও প্রশিক্ষণকেও গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে। ২. নিয়োগ লাভের পর একজন শিক্ষকের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা থাকতে হবে, যাতে দেশের সেরা শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট হয়। কারণ তারা শিক্ষকতা পেশায় এলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সেরা হবে যা দেশ ও দশের জন্য কল্যাণকর। ৩. পদোন্নতির ধারা মসৃণ করতে হবে—তাছাড়া কর্মদক্ষতার স্পৃহা হারাবে। ৪. একাডেমিক উৎকর্ষ সাধনে সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করতে হবে যেখানে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। ৫. স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো নির্ধারণ করতে হবে এবং স্ব স্ব ক্ষেত্রে অবদানের জন্য পর্যাপ্ত পারিতোষিক বা পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকবে। পর্যাপ্ত বেতন দেওয়ার পর তাদের প্রতি প্রাইভেট বা কোচিং করানোর নিষেধাজ্ঞা দিলে তা কার্যকর করা সহজ হবে, এমনকি যৌক্তিকও হবে।
উল্লিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করলে শিক্ষাক্ষেত্রে আশানুরূপ পরিবর্তন দৃশ্যমান হবে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নয়ন টেকসই যার সুফল ভোগ করবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। সিঙ্গাপুর এখন সারা বিশ্বের কাছে অনুকরণীয়। ১৯৬৫ সালে যখন সিঙ্গাপুরকে মালয়েশিয়া থেকে বের করে দেওয়া হয় তখন দিশেহারা কিংবদন্তি নেতা লি কুয়ান ইউ। কীভাবে এই রাষ্ট্রকে তিনি এগিয়ে নিয়ে যাবেন। তখন গুরুত্ব দেওয়া হলো সামাজিক পুনর্গঠনমূলক কর্মসূচির দিকে। যার মধ্যে মূল ছিল শিক্ষাব্যবস্থা। মেধাবী শিক্ষার্থীদের বাছাই করে বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে তাদের দেশে এনে কর্মে নিয়োগ করা হয় এবং মেধাবীদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করার জন্য শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো দিয়ে তাদের বেতন অন্যান্য পেশার তুলনায় বেশি করা হয়। যার ফলে মাত্র এক দশকেই দেশটিতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন আসে।