এক জন শিক্ষার্থী বহু আশা-সম্ভাবনা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। চোখে থাকে তার অফুরন্ত স্বপ্ন। স্কুল-কলেজ পার হয়ে এ-এক নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ। যেখানে সহপাঠী থেকে শুরু করে শিক্ষকসহ সবাই থাকেন অপরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ গ্রহণ আরম্ভ হওয়ার মধ্য দিয়ে সবাই ধীরে ধীরে পরিচিত হয়ে ওঠেন। সহপাঠীদের কেউ হয় প্রিয় বন্ধু-বান্ধবী। শিক্ষকদের কেউ হন প্রিয় শিক্ষক। কিন্তু দেখা গেল, এরই মধ্যে কোনো এক ফাঁকে সেই শিক্ষার্থীর জীবনে নেমে এলো অমানিশা! কী সেটা? সেটা হচ্ছে, র্যাগিং। এই র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে শিক্ষার্থীর জীবনের ছন্দ এক মুহূর্তেই পালটে যায়!উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে এসে ছাত্র কিংবা ছাত্রী যে কেউই এ ধরনের নেতিবাচক ঘটনার সম্মুখীন হবেন। এটা কাম্য নয়। এখানে যেটা পরিতাপের কথা, যে বা যারা এই ঘটনা ঘটান, তারা একই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র কিংবা ছাত্রী। অন্যভাবে স্পষ্ট করে বললে, এক শিক্ষার্থীই আরেক শিক্ষার্থীকে র্যাগিং করে থাকেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে র্যাগিং যিনি করেন, তিনি সিনিয়র শিক্ষার্থী। আর ভুক্তভোগী যিনি হন, তিনি জুনিয়র শিক্ষার্থী। এমনটাই সচরাচর দেখা যায়। একশ্রেণির সিনিয়র শিক্ষার্থী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আগত নবীন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন। শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ নির্যাতন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। সত্যি বলতে, র্যাগিং হচ্ছে একটা চরম ‘অপসংস্কৃতি’। যে অপসংস্কৃতির চর্চা দীর্ঘদিন ধরে আমাদের শিক্ষাঙ্গনকে কলুষিত করছে। তবু এর চর্চা বন্ধ হচ্ছে না, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। শিক্ষাঙ্গনে র্যাগিংয়ের কবলে পড়ে শিক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। সর্বশেষ আমরা জানতে পারলাম, কুষ্টিয়ার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ফুলপরীর ঘটনা। তিনি সিনিয়রদের দ্বারা অত্যন্ত জঘন্যভাবে র্যাগিংয়ের শিকার হন। কিন্তু এতে দমে যাননি তিনি। বরং সাহসের সঙ্গে প্রতিবাদী হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছেন। বলা বাহুল্য, তার এ প্রতিবাদ অন্য অনেকের সাহস জোগাবে। দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
কিন্তু আসল বিষয় হলো, শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে এ ধরনের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের চর্চা যাতে না হয় এবং ছাত্রছাত্রীদের এসব থেকে দূরে রাখতে আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণকেও জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দায়িত্ব পালন করতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের শিক্ষকগণ ক্লাসে পাঠদানের সময় র্যাগিংয়ের কুফল তথা পরিণতি সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে খোলামেলা আলাপ-আলোচনা করতে পারেন। এ জাতীয় খারাপ কাজে জড়িত হলে সেই শিক্ষার্থীকে—তিনি যেই হন না কেন, যত প্রতাপশালীই হন না কেন—তাকে ভয়ানক শাস্তি ভোগ করতে হবে, সে সম্পর্কে শিক্ষকগণ ছাত্রছাত্রীদের আগেভাগেই সতর্ক করতে পারেন। তাছাড়া ছাত্রছাত্রীদের নিজেদেরও এটা বুঝতে হবে। বুঝতে হবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো শিক্ষা অর্জনের জায়গা। এখানে তিনি যে এসেছেন, তার ওপর দেশ ও জাতির অনেক আশা। তার বাবা-মার আশা। বাবা-মা অনেক কষ্টে তাকে পড়াশোনা করতে পাঠিয়েছেন। মানুষ হতে পাঠিয়েছেন, অমানুষ হতে নয়। অথচ জীবনের মূল্যবান সময়গুলো নিজের কারণেই নষ্ট হয়ে গেলে তা তো অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয়! কাজেই সময় থাকতে সময়কে কাজে লাগানো উচিত প্রতিটি শিক্ষার্থীর।
চারপাশে বহু মেধাবী শিক্ষার্থী মেধার পরিস্ফুটন ঘটাচ্ছেন। ভালো ভালো কাজ করছেন। গবেষণা করছেন। বিজ্ঞানমেলায় গেলে দেখা যায়, নবীন বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার। ছাত্রছাত্রীদের বানানো রোবট, গাড়ি ইত্যাদি। এছাড়া শিক্ষার্থীদের অনেকে মানবিক কাজেও অংশ নেন। অনেকে আবার পড়াশোনার পাশাপাশি সৃজনশীল লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। ছাত্রজীবনেই বই লেখেন কেউ কেউ। অনেকেই পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেন নিয়মিত। এসব যেমন একজন শিক্ষার্থীর নিজের জন্য কল্যাণকর, দেশ-জাতির জন্যও। সুতরাং ছাত্রছাত্রীদের অবশ্যই শুভ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হবে। সর্বোপরি র্যাগিংয়ের মতো অশুভ-অপকর্ম একজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কোনোভাবেই মানানসই হতে পারে না। তাই শিক্ষাঙ্গন হতে হবে র্যাগিংমুক্ত। এই চাওয়া এখন শিক্ষক-অভিভাবক সবার।