মানুষ হিসেবে আমরা শ্রেষ্ঠ জীব। অন্যান্য সৃষ্টির মধ্যে স্রষ্টা জ্ঞান, দক্ষতা, বিবেচনাবোধ দেন নি, যা মানুষের মধ্যে দিয়েছেন। মানুষের মধ্যে যে মেধা রয়েছে, তা ব্যবহার করেই সুন্দর জীবনধারা তৈরি করে তারা। মানুষ জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই মনুষ্যত্বের বোধ উপলব্ধি করতে পারে না, তা জাগিয়ে তুলতে হয়। তার একটি মাধ্যম হচ্ছে লেখাপড়া। লেখাপড়ার মাধ্যমে আমরা আমাদের বিবেচনাবোধ জাগিয়ে তুলতে পারি, জ্ঞান অর্জন করে তা চলার পথে প্রয়োগ করতে পারি, জানতে পারি ন্যায়-অন্যায়, সঠিক-ভুল, ভালো-খারাপের মধ্যে তফাৎ। লেখাপড়ার মূল উদ্দেশ্য এসব হলেও বর্তমানে তা সার্টিফিকেট অর্জনের হাতিয়ার ছাড়া আর কিছুই নয়!
ভবিষ্যতে ভালো চাকরি পেতে হবে—এমন লক্ষ্য মাথায় রেখেই পড়ালেখা করে মানুষ। যা গৎবাঁধা পাঠ্যপুস্তক পড়া এবং সেটা পরীক্ষার খাতায় ঢেলে দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বইয়ের পাতায় কী বলছে, তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার তাগিদ বা তাড়না কোনোটাই আমাদের নেই! এই যেমন, সদা সত্য কথা বলবে, মিথ্যা সকল পাপের মা—এগুলো পাঠ করে ও পরীক্ষার খাতায় লিখে সার্টিফিকেট অর্জন ব্যতীত এর বাস্তব চর্চা কেউ করে না তেমন একটা! কারণ, তার কাছে ভবিষ্যতের কর্মসংস্থানের চিন্তাই যেন আসল! অস্বীকার করার উপায় নেই, আজকের দিনে পড়াশোনার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘চাকরি’! ১০০ জন শিক্ষার্থীকে যদি জিগ্যেস করা হয়, তোমাদের পড়ালেখা করার উদ্দেশ্য কী? তাদের মধ্যে ৯৮ শতাংশ বলবে ভবিষ্যতে একটা ভালো চাকরি পাওয়া, বাকি ১ শতাংশ বলবে ‘শিক্ষিত’ শব্দের ট্যাগ লাগানোর জন্য, আর ১ শতাংশ বলবে জ্ঞান অর্জন করার জন্য। অর্থাৎ, শিক্ষা লাভের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকছে চাকরি বা অর্থনৈতিক লাভ, যাকে ঘিরেই আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসা যাওয়া!
আমাদের দেশের ৮০ শতাংশ মানুষই নিম্নমধ্যবিত্ত বা দরিদ্র। তারা চান না যে, তারা যেরকম অর্থ সংকটের মধ্য দিয়ে গেছেন, তাদের সন্তানেরাও সে রকম অবস্থার মধ্য দিয়ে জীবন পার করুক। বস্তুত, এমন ধ্যানধারণা থেকেই সবাই বেছে নেয় এই লক্ষ্য—লেখাপড়া করে ভালো চাকরি করা! বাংলার পিতামাতার কাছ থেকে একটা কমন ডায়লগ শোনা যায়—‘লেখাপড়া করবি না তো কি রিকশা চালাবি?’ সত্যি বলতে, আমাদের দেশে জেনারেল লাইনে লেখাপড়া করার আসল উদ্দেশ্যই চাকরি করা। কয়েক জন হয়তো প্রফেশনাল লেভেলে সিংগার, ক্রিকেটার হতে চেষ্টা করেন; কিন্তু তারপরেও পড়াশুনার গুরুত্বকে সবার ওপরে রাখেন তারা।
আমাদের লেখাপড়ার দরকার আছে, শিক্ষিত হওয়ার প্রয়োজন আছে। তবে যেটা জীবিকা নির্বাহের জন্য লেখাপড়া করা হয়, সেটা আসলে লেখাপড়া নয়। সেটাকে ট্রেনিং নেওয়া বা স্কিল অর্জন করা বলা যেতে পারে। যেমন—ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আর্কিটেকচার ইত্যাদি। মনুষ্যত্ব বিকাশ, মূল্যবোধ অর্জন এবং নৈতিক শিক্ষা অর্জনের জন্য যে লেখাপড়া করা হয় সেটাই আসল শিক্ষা। মূলত নৈতিক শিক্ষাই ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড বিনির্মাণে প্রধান সহায়ক। কাজেই এই বিষয়েও বিস্তর লেখাপড়া করা প্রয়োজন আছে। নৈতিক শিক্ষা ছাড়া একজন ইঞ্জিনিয়ার নির্মাণকাজে রডের পরিবর্তে বাঁশ দেবেন, ডাক্তার বিনা প্রয়োজনে হাজার হাজার টাকার টেস্ট করতে বলবেন—এ ধরনের দৃষ্টান্ত আমাদের অজানা নয়।
মনে রাখতে হবে, একটা দেশকে এগিয়ে নিতে, মানুষের মধ্যে ঐক্যজোট গড়তে, সুশীল সমাজ গড়তে, মানবসেবা করতে, পরার্থে জীবন দান করার শিক্ষা লাভের জন্য নৈতিক শিক্ষার বিকল্প নেই। সুতরাং, কর্মসংস্থান নিশ্চিতের পাশাপাশি দেশের মানুষকে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে, যাতে করে তারা চাকরির তাড়নায় পড়ালেখা না করে বরং প্রকৃত মানুষ হওয়ার লক্ষ্যে, জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে পড়াশোনা করে।