প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত গোটা শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে বললে ভুল হবে। শিক্ষাব্যবস্থা এখন এমন পর্যায় গিয়ে পৌঁছেছে যে, অভিভাবকেরা চিন্তায় পড়েছেন। কোথায় তারা তাদের ছেলেমেয়েদের পড়াবেন, কীভাবে পড়াবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। তারা হতাশায় ভুগছেন। প্রতিদিনই খবরের কাগজ ও টিভি চ্যানেলে নিয়োগ-দুর্নীতি নিয়ে যেসব খবর বের হচ্ছে, তা দেখে বাঙালি এখন এক কঠিন সমস্যা ও সংকটের মধ্যে পড়েছে। আর এই সংকটের শুরু হয় ২০০৯ সালে মমতা ব্যানার্জি যখন ক্ষমতায় আসেন। দুর্নীতি করেছিলেন তৃণমূল নেতা শঙ্কুদেব পান্ডা। আর ১০ বছর পর তা প্রকাশ্যে নিয়ে এলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিজিত্ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলামে একটার পর একটা দুর্নীতি ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর। প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি কেন্দ্রীয় সংস্থা ইডি (এনফোর্সমেট ডিরেকটরেট) ও সিবিআইয়ের হাতে তদন্তভার তুলে দেন। দুর্নীতি এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছায় যে, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী তথা মমতা মন্ত্রিসভার কার্যত ২ নম্বর সদস্য পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও তার বন্ধবী অর্পিতা মুখার্জির বাড়ি থেকে নগদ ১৫০ কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়। অন্যদিকে চাকরিপ্রার্থীরা এই লেখার দিন পর্যন্ত ৬০০ দিন লাগাতার কলকাতার রাস্তায় বসে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। বিচারপতি মুখোপাধ্যায়সহ বর্তমানে কলকাতা হাইকোর্টের সমস্ত বিচারপতির এজলাসে নিয়োগ দুর্নীতির বহু ঘটনা আসছে। সঙ্গে সঙ্গে তারা কেন্দ্রীয় দুটি সংস্থাকে তদন্তের নির্দেশ দিচ্ছেন। গত চার-পাঁচ দিনে শিক্ষায় দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত আরো সাত-আট জনকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়েছে। বিদ্যার দেবী সরস্বতী পূজার দিন সিবিআই ও ইডি সূত্রে বলা হয়েছে, এ পর্যন্ত প্রায় ৫০০ কোটি টাকার মতো নিয়োগ দুর্নীতিতে শাসক দলের নেতারা অংশ নিয়েছেন। বিচারপতিদের হস্তক্ষেপ না হলে বাংলার নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ বলে কিছু থাকত না তা প্রমাণ করে ছাড়বেন বলে এজলাসেই তারা বলছেন। প্রায় তিন মাস আগে পার্থ চট্টপাধ্যায় কলকাতার একটি পাঁচতারা হোটেলে বাংলাদেশের এক কূটনীতিকের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বেসরকারি এক কলেজ মালিককে নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে বৈঠক করেন। তার দুই দিন পরেই ইডি গ্রেফতার করে পার্থ পট্টোপাধ্যায়কে। তিনি ও তার বান্ধবী জেলে আছেন। পশ্চিমবঙ্গ মাধ্যমিক শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা বোর্ড, মাদ্রাসা বোর্ডসহ একাধিক বোর্ডের প্রধানেরা বর্তমানে সিবিআই, ইডির নজরে আছেন। এমনকি নিয়োগের ক্ষেত্রে অ্যাডমিট কার্ড ও সাদা খাতা দালালদের বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। সিবিআই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, চাকরিপ্রার্থী যারা পেয়েছেন ৭ নম্বর, তাদের দেওয়া হয়েছে ৭০ এবং যারা পেয়েছেন শূন্য, তাদের বাঁ দিকে একটা ৫ বসিয়ে ৫০ করা হয়েছে। একটি-দুটি নয়, এ ঘটনা ঘটেছে হাজার হাজার।
শুরুতেই আমরা শঙ্কুদেবের নাম করেছিলাম। কে এই শঙ্কুদেব দিদিকে তিনি পিসিমণি ডাকতেন। দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এই ছাত্রনেতা মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পরীক্ষার্থীদের রোল নম্বর নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাশ করিয়ে দেওয়ার জন্য লাখ লাখ টাকা নেন। সে সময় পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন ব্রাত্য বসু। একটা সময় শঙ্কুদেব পান্ডা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকলে উপাচার্য থেকে শুরু করে অধ্যাপকেরা উঠে দাঁড়াতেন। টাকা না পেলে তিনি কারো ঘর থেকে বের হতেন না। নাম বলতে অনিচ্ছুক এক উপাচার্য এই প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগ করেছেন, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বছরে ৩০ লাখ টাকা এরা আদায় করত। কিন্তু এই উপাচার্য দেননি। শঙ্কুদেব নিজেকে বাঁচানোর জন্য বর্তমানে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি আবার মুকুল রায়ের খুব ঘনিষ্ঠ। গত সাত দিন ধরে শিক্ষার দালালদের একের পর এক গ্রেফতার করা হচ্ছে। তারা সিবিআই ও ইডির জেরার জবাবে বলছেন, তারা টাকা তুলেছেন পার্থ চট্টপাধ্যায়ের নির্দেশে। আদায় করা টাকার একটা বড় অংশ পার্থ চট্টোপাধ্যায় নিজে নিয়েছেন। তাদের কথার সত্যতা যাচাই করার জন্য সিবিআই ও ইডি তাদের কয়েক জনকে মুখোমুখি বসিয়ে সরস্বতী পূজার দিন থেকে জেরা করতে শুরু করছে।
শোনা যায়, দিদির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বাসনা থেকেই পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষার অধঃপতন শুরু হয়। ভারতবর্ষের দুটি সর্বভারতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। আইসিএসসি ও সিবিএসসি। সারা ভারত থেকে বাছাই করা মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা এ দুটি বোর্ডে পড়াশোনা করে। তাদের বাৎসরিক পাশের হার ৯৫-৯৭ শতাংশ। পার্থর মাধ্যমে মমতা এই স্কুলগুলোতে নির্দেশ দেন পশ্চিমবঙ্গ বোর্ডগুলোর পরীক্ষাতত্ত্ব ৯০ শতাংশের বেশি পাশ করাতে হবে। দিদির ঐ নির্দেশ পাওয়ার পরই দেখা গেল পশ্চিমবঙ্গে সরকারের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে পাশের হার বেড়ে হলো ৯০ শতাংশ। এই সময় থেকে শুরু হয় টাকা নিয়ে অথবা ভয় দেখিয়ে পাশ করানোর খেলা। প্রধান পরীক্ষকের কাছ থেকে পরীক্ষকদের কাছে কোনো স্কুল-কলেজের খাতা আছে জেনে নিয়ে এই ছাত্রছাত্রীদের থেকে বিপুল টাকা নিয়ে পাশ করিয়ে দেওয়া শুরু হয়। একটা সময় তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতাকর্মীদের এটা একটা বিরাট ব্যবসা হয়ে দাঁড়ায়।
একটা সময় ছিল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একসময় শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মিয়ানমারও ছিল। আর আজকের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠন-পাঠন দূরের কথা, ভর্তি হতে গেলেও একটি মহলকে টাকা দিতে হয়। হাইকোর্টের নির্দেশে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নিজস্ব ডক্টরেট থিসিস যে অধ্যাপক লিখে দিয়েছিলেন, তিনিও বিপদে পড়ে গেছেন। কারণ পরে জানা গেছে, পার্থ পট্টোপাধ্যায়ের পুরো থিসিসটাই ছিল জাল। এছাড়া টাকার বিনিময়ে নিয়োগ-বদলি তো আছেই।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের আমলে শিক্ষার এই বেহাল দশা দেখে পশ্চিমবঙ্গের অভিভাবকেরা এখন আর ছেলেমেয়েদের পশ্চিমবঙ্গে পড়াতে চান না। ফলে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করার পরই অনেকে তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য দিল্লি বা পার্শ্ববর্তী রাজ্য ওড়িশায় পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এই প্রবণতা সামনে আসার পরই বিচারপতিসহ পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্টজনেরা সরব হয়েছেন যে মমতা সরকারের আমলে বাংলার একটা গোটা প্রজন্ম শেষ হয়ে যাচ্ছে। এর থেকে মুক্তির উপায় কী? কলকাতায় বুদ্ধিজীবী অথবা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-অধ্যাপকেরা এর কোনো সদুত্তর দিতে পারছেন না। তারা বলছেন, গোটা শিক্ষাব্যবস্থার খোল-নলচে না বদলালে এর থেকে মুক্তির উপায় নেই।