সম্প্রতি বহিঃপরীক্ষক হিসেবে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বিএসসি অনার্স শেষ বর্ষের কোর্সে ভাইভা নিতে গিয়েছিলাম। ভাইভায় প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত পঠিত বিষয়গুলো সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়। এর মধ্যে একটি সাধারণ প্রশ্ন হলো, ‘অমুক কোর্সের কোন লেখকের বই পড়েছ?’ অবাক হয়ে দেখলাম, বেশির ভাগ শিক্ষার্থী উত্তর দিচ্ছে, ‘কোর্স টিচার পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন স্লাইড পড়িয়েছেন, ঐ স্লাইড দেখে পড়েছি। কোন বই থেকে পড়িয়েছেন, এটা এখন মনে করতে পারছি না।’ বিভাগীয় প্রধান থাকাকালীন দেখেছি, অনেক সম্মানিত শিক্ষক অঙ্কের মতো বিষয়টির ক্লাসও পাওয়ার পয়েন্ট স্লাইডের মাধ্যমে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন। এ বিষয়ে একাধিক বার শিক্ষার্থীরা আমার কাছে তাদের হতাশার কথা ব্যক্ত করেছিল।
শিক্ষায় সমৃদ্ধি আনতে স্থান-কাল বিবেচনায় স্লাইড ও বইয়ের যথাযথ ব্যবহার জানতে হবে। আমার মতে, স্লাইড সাধারণত কোনো বিশদ বিষয়কে অল্প সময়ে অভিজ্ঞ জনগোষ্ঠীর সামনে বুলেট আকারে উপস্থাপন করার মাধ্যম। স্নাতক পর্যায়ে জ্ঞানের পরিপক্বতা অর্জন জরুরি। কারণ এই জ্ঞানই পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীকে নতুন জ্ঞান সৃষ্টির সুযোগ করে দেয়। ২৩ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ৫০ মিনিটের ক্লাসে চুম্বক অংশ পড়াতে গেলে খুব বেশি হলে ৬ থেকে ১০ পৃষ্ঠা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পড়ানো সম্ভব। কিন্তু পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে বুলেট আকারে পয়েন্ট করে দেখাতে গেলে দেখা যায় ২৫টি স্লাইডেই ৫০ পৃষ্ঠার কনটেন্ট যুক্ত করা সম্ভব। এভাবে আমরা শিক্ষকবৃন্দ নিজেদের অজান্তেই শিক্ষার্থীদের ওপর এই বিশাল বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছি। দিনের পর দিন চাপিয়ে দেওয়া এমন বোঝা শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি করছে। তারাও শিক্ষার বিষয়ে ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে সেমিস্টারের পরীক্ষা বৈতরণী পার হতে চাইছে। এর চেয়ে যদি তাদের জন্য একটি বইয়ের রেফারেন্স ধরে সিলেবাস অনুযায়ী এগিয়ে যাওয়া যেত, তাহলে পাঠ্য বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানের ধারাবাহিকতা ও গভীরতা অনেক বেশি হতো। তাদের পড়ার আগ্রহ বাড়ত। তারাও পরবর্তী প্রজন্মকে শেখাতে পারত যে কেমন করে ধারাবাহিকভাবে জ্ঞানার্জন করতে হয়। জ্ঞানসমৃদ্ধ প্রজন্ম সৃষ্টি করতে চাইলে এই বিষয়গুলো খেয়াল রাখা জরুরি। আমরা দেখেছি, অভিজ্ঞ শিক্ষকগণ টেকনোলজির ক্লাস নিতে গিয়ে শুধু জটিল ছবি বা সার্কিট উপস্থাপন করার জন্য স্লাইড ব্যবহার করেন, যাতে ছবি বা সার্কিট ডায়াগ্রাম আঁকতেই ৫০ মিনিটের ক্লাসের সম্পূর্ণটি ব্যয় হয়ে না যায়।
হোয়াইট বোর্ডে পাঠদান সম্পর্কে ইউনিভার্সিটি অব স্লোভেন্সকি ব্রডের একজন অধ্যাপকের লব্ধ অভিজ্ঞতায় তিনি লিখেছেন, ‘একদিন শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের সময় বিদ্যুৎ ছিল না, আমি আমার শিক্ষার্থীদের হোয়াইট বোর্ড ব্যবহার করে পড়ালাম। শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া দেখে আমি বিস্মিত হলাম। তারা বলল, ‘স্যার, আজ পর্যন্ত এটা আপনার শ্রেষ্ঠ পাঠদান।’ জেপি ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজির অধ্যাপক আর সি মিত্তাল বলেন, ‘পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন ছবি ও বড় সমীকরণের জন্য ব্যবহৃত হতে পারে, কিন্তু শেখানো দরকার হোয়াইট বোর্ডে। কারণ কোনো সেমিনারে ও কনফারেন্সে কিছু উপস্থাপনের জন্য আপনি শিক্ষক নন বরং একজন উপস্থাপক, যার কাজ হলো একটি নির্দিষ্ট সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে বিষয়বস্তু উপস্থাপন করা।’ এ সম্পর্কে জয়পুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নমিতা জৈন বলেন, ‘হোয়াইট বোর্ড পাঠদান উত্তম। কারণ এটি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে সরাসরি সংযুক্ত করে। এর মাধ্যমে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অংশগ্রহণমূলক শিক্ষায় বেশি আনন্দ পায়।’ তবে মাস্টার্স ও পিএইচডি গবেষণারত শিক্ষার্থীদের জন্য শ্রেণিকক্ষে স্লাইড প্রেজেন্টেশন অনেক ক্ষেত্রে অপরিহার্য। কারণ বিএসসি ডিগ্রি সমাপ্তির পরে তারা অনেকেই কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে এবং তাদের জ্ঞানের মাত্রা অনেকটাই পরিপক্ব থাকে। স্লাইড দেখে ব্যাখ্যা করলে তারা বিষয়বস্তু অনুধাবনে সমর্থ হয়।
আমার এক প্রাক্তন শিক্ষার্থী প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। আমার অফিসে এসে একদিন তার কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা শেয়ার করলেন—তিনি তার এক শিক্ষার্থীকে ব্যাবহারিক পরীক্ষায় সাধারণ গ্রেড দিয়েছেন। শিক্ষার্থী সংক্ষুব্ধ হয়ে বিভাগীয় প্রধানের বরাবর এই মর্মে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে যে, সে আরো বেশি নম্বর পাবে, শিক্ষক ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে কম নম্বর দিয়েছেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিভাগীয় প্রধান শিক্ষককে ডেকে আরো এক গ্রেড বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে এমন অতিমূল্যায়ন সার্বিক শিক্ষার সমৃদ্ধির অন্তরায়। তাছাড়া এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিশ্রম করার প্রবণতা বাড়ার পরিবর্তে নেতিবাচক সবিনাশী দর্শন তৈরি হয়। আমার জীবনে ঠিক হুবহু এমন নয়, একটু ভিন্ন অভিজ্ঞতা আছে। ২০০৫ সালে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকালীন শিফটে ক্লাস নিতাম। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার আগে বলল, ‘স্যার, আমাদের পরীক্ষায় ভালো গ্রেড দিলে পরবর্তী সেমিস্টারে আপনার পুনরায় ক্লাস নেওয়ার ব্যাপারে আমরা সুপারিশ করব।’ কথাটি আমার মনে এখনো দাগ কেটে আছে। তথ্যমতে, ২০২১ সালে ৯৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থী ছিল ৩ লাখ ১০ হাজার ১০৭ জন। আমাদের শিক্ষার্থীদের ৬৫ শতাংশই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। এখানে শিক্ষার মানোন্নয়নে মনোযোগী হলে শিক্ষার সার্বিক উন্নয়নের সূচক হবে ঊর্ধ্বমুখী।
আমার এক পরিচিত ব্যক্তির সন্তান বিজ্ঞান বিভাগের কোনো এক বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। প্রথম বর্ষে তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ব্যাবহারিক ক্লাসের পরীক্ষণগুলো করা তার জন্য বেশ কঠিন বলে সে প্রায়ই তার বাবার কাছে অভিযোগ করছে। আমরা প্রায়ই বলি, জনশক্তিই আমাদের সম্পদ। কিন্তু জনবল যদি শারীরিক দুর্বলতার কারণে মানসিক শক্তি অর্জন না করে, তাহলে শিক্ষিত হয়েও তারা খুব বেশি এগোতে পারবে না। ভয়, উৎকণ্ঠা হবে তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। দক্ষিণ কোরিয়া দেশটির সমগ্র জাতির তরুণ প্রজন্মকে কঠোর শারীরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এর কারণ হলো, চিরবৈরী সম্পর্কের দেশ উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ হলে যাতে তারা যুদ্ধ করার মনোবল সম্পন্ন পর্যাপ্ত তরুণ পায়। যুদ্ধ কবে লাগবে, সে বিষয়ে কোনো ধারণা না থাকলেও এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, সুস্থ, সবল নাগরিক হওয়ার ফলে তাদের নবপ্রজন্ম যে কোনো মানসিক চাপ মোকাবিলায় সক্ষম। দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পের উন্নয়নের সূচক জাতিগত সুস্থতা ও সক্ষমতার নির্ণায়ক। সুতরাং শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা অটুট রাখতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলাধুলা ও ব্যায়ামকে বাধ্যতামূলক করা অপরিহার্য।
বিশ্ব অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি মানসম্মত শিক্ষা। শিক্ষার সমৃদ্ধিতে উপর্যুক্ত বিষয়গুলোর গভীর পর্যালোচনা অপরিহার্য। এর বাস্তবভিত্তিক সমাধানে পদক্ষেপ গ্রহণ সময়ের দাবি। এভাবেই সুস্থ, সবল ও দক্ষ জনশক্তির বিকাশে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলুক আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি—এই প্রত্যাশা আপনার, আমার—সবার।