বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের অন্যতম উদ্দেশ্যই ছিল দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি আর ২০২৩ সালে তা প্রায় ১৮ কোটি। একটি দেশের সফলতা, শান্তি, উন্নতি নির্ভর করে সে দেশের মানুষের আর্থিক সচ্ছলতার মাত্রায়। সেই সূচকের বিচারে ১৯৭১ সালের যাত্রা শুরুর পরিকল্পনায় ছিল বাংলাদেশ হবে একটি উন্নত দেশ, যে দেশের শতভাগ মানুষ থাকবে মানসম্মত শিক্ষায় শিক্ষিত, আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়তে আসবে বিদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী, প্রশ্ন উঠবে না দেশের শান্তি সমৃদ্ধি নিয়ে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম শুরু ছাত্রদের আন্দোলনের মাধ্যমে। আর ছাত্র আন্দোলনের একটি বিষয় ছিল পড়াশোনার উপকরণের ব্যয়। আমার মনে আছে—আমি যখন নবম শ্রেণির ছাত্র, ১৯৬৭ সাল। আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের একটি বিষয় ছিল কাগজের দাম। বাজারে প্রচলিত ছিল তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের পার্বত্য চট্টগ্রামের কর্ণফুলী কাগজকলের কাগজ করাচি যায় শুধু একটি সিল দেওয়ার জন্য এবং তার জন্য ছাত্রদের কাগজ কিনতে প্রতি দিস্তার মূল্য ছিল ০ দশমিক ২৫ টাকার পরিবর্তে ০ দশমিক ৭৫ টাকা। অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল আন্দোলনের একটি প্রধান বিষয়। সময়ের ব্যবধানে এখনো আন্দোলন করতে হচ্ছে শিক্ষার সঙ্গে জড়িত শিক্ষক সম্প্রদায়কে অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য।
বর্তমানে ১ কোটির বেশি মানুষ বিদেশে কর্মরত। এই সংখ্যা খুব সহজেই বৃদ্ধি করা সম্ভব। তবে সেসব মানুষ হতে হবে জ্ঞান ও বুদ্ধিতে মানসম্মত। কিন্তু এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী— বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় অষ্টম শ্রেণিতে বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা অর্জনের হার বাংলায় শতকরা ৫৪ শতাংশ, ইংরেজিতে শতকরা ১৯ শতাংশ এবং গণিতে শতকরা ২২ শতাংশ। এ কারণেই এমন শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা বিদেশ যায় তুলনামূলক কম বেতনে। ২০১৮ সালের পর যেভাবে এবং যে গতিতে আমাদের দেশ চলছে, তাতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি হয়েছে বলা কঠিন বা অসম্ভব। চলতি বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে গত ২৮ জুলাই ২০২৩ তারিখে। পাশের হার ৮০ দশমিক ৩৯ শতাংশ। সংবাদে প্রকাশ ‘কমেছে পাশের হার ও জিপিএ-৫’। একটি দেশে একই বিষয়ে দুই রকম তথ্য থাকতে পারে না। বাংলাদেশের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের মেধার যে হিসাব আমরা পাই, আর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার যে পাশের হার দেখা যায়, তা একটি আরেকটির বিপরীতমুখী। দেশের পরিকল্পনাবিদদের সামনে সঠিক হিসাব থাকা জরুরি। যদি তা না হয়, তাহলে সরকারের উন্নয়নের দাবি নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা থেকে যাবে। সরকার যদি অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশের নেগেটিভ গ্রোথ বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষায় মান বিশ্বমানে উন্নীত করতে পারেন বা করেন, তাহলে বাংলাদেশের বর্তমান মানুষ হবে দেশের জন্য সম্পদ। দেশের বিভিন্ন এনজিও এবং সামাজিক সংগঠন সময় সময় সরকারের সামনে বাংলাদেশের অবস্থা এবং করণীয় তুলে ধরেন সুন্দর এবং কার্যকর পরিকল্পনার মাধ্যমে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনমিতির সুবিধা গ্রহণের জন্য।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন সমস্যা। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, ‘আমিও গরিব হয়েছি, দেশেও আকাল শুরু হয়েছে’। কারণ আমাদের দরকার ১৮ কোটি মানুষকে দ্রুত শিক্ষিত করা। মনে হয় যতই দিন যাচ্ছে ততই বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতা বাড়ছে। সরকার দাবি করছে, প্রায় শতভাগ ছেলেমেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা ভিন্ন। সম্প্রতি এক সংবাদে প্রকাশ, দেশে শিশুশ্রমে নিয়োজিত ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৯২৭ জন। এই ছেলেমেয়ের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে ১০ লাখ ৬৮ হাজার ২১২ জন জড়িত। অর্থনৈতিক চাহিদায় এই ছেলেমেয়ের মা-বাবারা তাদের সন্তানকে জীবনের ঝুঁকির মধ্যে কাজে পাঠাচ্ছেন, সরকারের যদিও আইন এবং নিয়ম রয়েছে শিশুশ্রম বেআইনি। কবি সুকান্ত লিখেছেন, ‘পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’। যার পেটে ক্ষুধা, তার কাছে প্রথম এবং প্রধান চাহিদা খাবারের। হয়তো এই বিবেচনায় আমাদের সংবিধানে ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে দেশের মানুষের মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থার নিশ্চয়তার দায়িত্ব সরকারের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে আমাদের উচিত দ্রুত প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা জাতীয়করণ করা। সরকারি স্কুলের শিক্ষার মান হতে হবে বিশ্বমানের। পাশের দেশ দিল্লি হতে পারে আমাদের উদাহরণ। বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রণয়ন করতে হবে আমাদের শিক্ষার সিলেবাস। মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম, আবার বিশ্ব দরবারে প্রতিযোগিতায় টিকতে গিয়ে অন্যের ভাষাও জানতে ও বুঝতে হবে। এই বিষয়ে উদাহরণ হতে পারে সিংগাপুর। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্র ভাষাজ্ঞানও আমাদের জন্য একটি সুন্দর উদাহরণ।
বাংলাদেশের মতো ছোট দেশের ১৮ কোটি মানুষ নিয়ে যেন আরাম-আয়েশে বসবাস করা যায়, তার প্রথম এবং প্রধান শর্ত মানসম্মত শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া। জ্ঞানই একমাত্র মানুষের সম্পদ, যা ক্ষয় হয় না। আর শিক্ষাই একমাত্র মাধ্যম, যার মাধ্যমে উপার্জনের জগতে যোগ্যতা এবং ক্ষমতা অর্জন সম্ভব, যা টেকসই করে মানুষের উপার্জনের ক্ষমতা। সমাজের ভিক্ষাবৃত্তিও সহনশীল পর্যায়ে থাকতে পারে। সুতরাং সময় ব্যয় না করে দ্রুত শিক্ষায় সফলতা অর্জন করতে হবে। আমাদের মতো অর্থনীতিতে শিক্ষার প্রসার এবং মানসম্মত করার জন্য খাদ্য, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও বিবেচনায় রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, সময়ের প্রয়োজনে ব্যবসায়ীরাও শিক্ষা জগতে প্রবেশ করছেন। ফলে বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে অতি বাণিজ্যিকীকরণ না করে তা যতটা সম্ভব দাতব্যনির্ভর করতে হবে। শিক্ষার মান এবং পরিবেশ বজায় রাখার ক্ষেত্রে কোনো প্রকার আপস করা যাবে না।