শিক্ষা থাকলেই কি মানুষ হওয়া যায়? বর্তমান পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করে বলব না হওয়া যায় না। বর্তমান শিক্ষা শুধু আপনাকে টাকার পেছনে দৌড়াতে শেখাবে, মানুষকে কীভাবে হারাতে হয় শেখাবে কিন্তু অসুস্থকে কীভাবে সেবা করতে হয়, অসহায়কে কীভাবে সাহায্য করতে হয় তা শেখাবে না। বর্তমান শিক্ষা যেন শুধু বইয়ের পাতায় বন্দি। পিঞ্জরাবদ্ধ পাখি যেমন মুক্তির স্বাদ পায় না, মানুষও তেমনি মোহের মায়ায় বন্দি। এখানে মুক্তি কোথায়! মানবিকতা আজ অসুস্থ প্রতিযোগিতার মায়াজালে আবদ্ধ।
শিক্ষা হোক, চাকরি হোক কিংবা জীবনের লক্ষ্য পূরণেই হোক—সব কিছুতেই আজ প্রতিযোগিতা। মনের শান্তির জন্য এখন কেউ পেশা নির্বাচন করে না, করে অন্যকে ছোট দেখাতে। জীবন যেন জুয়াখেলা। অবসাদ, অবসন্নতার কারণে বর্তমানে তরুণ সমাজে যে আত্মহত্যা প্রবণতা তা এই অসুস্থ মানসিকতাকে ঘিরেই। এসএসসি, এইচএসসি কিংবা ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্টে পরাজিত হলে যেখানে মানুষ মৃত্যুকে বেছে নেয়, যেখানে জীবনের মূল্য একটা সার্টিফিকেট, সেখানে মানুষ হিসেবে আমার মূল্য দৃষ্টিগোচর হয় না।
বাবা-মায়ের ইচ্ছা পূরণের জন্য ভালো রেজাল্ট করার প্রবণতা ছোটবেলা থেকেই সবার মাঝে জেঁকে বসে। অভিভাবকেরা ভুলেই যান যে, শিশুর শৈশব আছে, শিশু কোনো যন্ত্র নয়। বাবা-মায়ের মানসিকতাই যেন এমন—আমার সন্তান হবে সবার থেকে সেরা! কিন্তু আসলেই কি একাডেমিক রেজাল্ট ঠিক করে দেয় একজন মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব! কখনোই না। মানুষ শ্রেষ্ঠ হয় তার কর্মে, তার ব্যবহারে, তার সুচিন্তিত সিদ্ধান্তে। কিন্তু কোথায় সেই মুক্তবুদ্ধির চর্চা, কোথায় সেই চিন্তার স্বাধীনতা। জীবনে বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে আজ সবাই ব্যস্ত। কারো সময় নেই অন্যের খোঁজ নেওয়ার। প্রতিবেশীর খবর নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। কারণ, আমার সময় নষ্ট হবে। ছাদে বাগান করার ইচ্ছা হয় না; কারণ সময় নেই। বই পড়তে ইচ্ছা করে না; কারণ ইউটিউবে ভিডিও দেখেই ক্লান্ত। এই অসুস্থ বিনোদনের জাঁতাকলে আজকের সমাজ যারপরনাই পিষ্ট।
জীবন একটাই। কিন্তু এ যেন শত জীবনকে হারানোর জন্য জন্মেছে! ডিগ্রির পর ডিগ্রি অর্জন করলেও এখন আর তাকে মানুষ বলা যায় না, বলতে হয় এমএ, বিএড বা এমএসসি, বিকম, পিএইচডি। সার্টিফিকেট দ্বারা যেখানে মানুষ মূল্যায়িত হয় সেখানে মনুষ্যত্বের মূল্যায়ন কোথায়!
একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়। অতিসম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়কে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অ্যাক্সিডেন্টের ঘটনা জাতির বিবেককে নাড়াতে বাধ্য। একজন মানুষ গাড়ির নিচে পিষ্ট অথচ চালকের থামার নাম নেই! কী ট্র্যাাজিক হিস্ট্রি! অথচ চালক একজন উচ্চ সার্টিফিকেটধারী ব্যক্তিত্ব। এই বীভৎস দৃশ্য আমাদেরকে ভাবতে বাধ্য করে—মনুষ্যত্ব আসলে কোথায়! বলা বাহুল্য, এ ধরনের ঘটনা প্রতিদিনকার জীবনে অতি সাধারণ দৃশ্য হয়ে উঠেছে! প্রতিদিন এ রকম হাজরো ঘটনা আমাদের পথ আগলে দাঁড়াচ্ছে—এভাবে কী চলতে পারে?
‘আমার জীবন আছে বলেই আমি মানুষ’—মূলত এ ধরনের চিন্তা থেকে মুক্তি দরকার সবার আগে। ‘শিক্ষা অর্জন করলেই আমি মানুষ’—এ চিন্তা থেকেও আসলেই মুক্ত হওয়াটা অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। ‘আসলেই মানুষ হতে পেরেছি কি না’—নিজের মনকে এই প্রশ্ন করলে কী উত্তর পাওয়া যাবে, ভাবুন তো একবার! বাস্তবতা হলো, টাকার পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে নিজের স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করা মানুষগুলো আজ ক্ষমতার শীর্ষে বসে সমাজে ঘটে যাওয়া অন্যায়, অবিচারকে, দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। এই অবস্থায় সমাজকে এগিয়ে নিতে মানুষের একাডেমিক শিক্ষার সার্টিফিকেট নয়, দরকার মনুষ্যত্ব। কারণ আপনি শিক্ষা অর্জন না করলেও বেঁচে থাকবেন। কিন্তু মনুষ্যত্ব না থাকলে মানুষ হতে পারবেন না।