বাংলায় একটা প্রবাদ আছে ‘ভালোর অল্পই ভালো’। কিন্তু দেশের শিক্ষা পদ্ধতির বেলায় প্রবাদখানা একেবারেই বেমানান। প্রতি বছর যে পরিমাণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাড়ছে, সে হারে শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাচ্ছে কি? আদতে শিক্ষার্থীরা কি যুগোপযোগী শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে? আমাদের দেশের পড়াশোনা হচ্ছে ব্যাপক আয়োজনমূলক কিন্তু ফলাফল শূন্য। সবাই তত্ত্বীয় জ্ঞানে শিক্ষিত, বাস্তবিক কোনো অভিজ্ঞতা নেই। শিক্ষার্থীরা রকেট সাইন্স পড়ে-লেখে, পরীক্ষা দিয়ে সার্টিফিকেটও অর্জন করে। কিন্তু বাস্তবে রকেট বানানোর কোনো সুযোগ নেই। দেশে উচ্চ শিক্ষার চাহিদা ক্রমবর্ধমান। চাহিদা পূরণে সরকার প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করছে। যা প্রশংসনীয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের পরিধি কেমন সেদিকে সরকার কিছুটা উদাসীন। পুরো দোষ আবার সরকারের একার নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষক, শিক্ষার্থীরাও দায়ী।
উচ্চ শিক্ষা মূলত গবেষণানির্ভর হয়ে থাকে। আমাদের দেশে গবেষণার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। সেই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানসমূহের পরিবেশ, পাঠদান পদ্ধতি সবকিছুই নাজেহাল অবস্থা। বাংলাদেশে এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় অর্ধশতাধিক। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সারা দেশে বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশাল অঙ্কের উন্নয়ন বাজেটও রাখছে সরকার। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিকভাবে শিক্ষা ও গবেষণার মান নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে র্যাংকিং সেখানে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। সেটা স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আন্তর্জাতিক মান দেখলে সহজেই কিছুটা অনুমান করা যায়। প্রতি বছরই ওয়েবমেট্রিক্স সেরা ইউনিভার্সিটি তালিকা প্রকাশ করে। তারই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি ওয়েবমেট্রিক্স বিশ্বের ২ শতাধিক দেশের ৩১ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে গবেষণা করে একটি রিপোর্ট প্রদান করেছে। যেখানে বাংলাদেশের সেরা সব বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। তবে প্রথম ১ হাজারের মধ্যে নেই কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। দেশসেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ১৫৮৬, বুয়েট ১৬০৪। অন্য তিন স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় যথাক্রমে রাবি ২২২৪, জাবি ২৪৭৬, চবি ২৫৮৭। ফলে প্রশ্ন উঠছে, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসলে শিক্ষা-গবেষণাসহ নতুন জ্ঞান সৃষ্টির কাজ কতটা হচ্ছে ? সেরা বিশ্ববিদ্যালয় তালিকা করার ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান, গবেষণা, পরিবেশ, সুযোগ-সুবিধাসহ আরো অনেকগুলো বিষয়কে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তালিকাভুক্ত করা হয়ে থাকে। তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের অবস্থান থেকে সহজেই বুঝা যায়, দেশে উচ্চ শিক্ষার মান কত ভঙ্গুর। শিক্ষার মানের এমন দশার কারণও নেহাত কম নয়। অধিক হারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করার ফলে যথাযথভাবে শিক্ষার্থীদের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেই জানার আগ্রহ। শিট, পাঠসহায়ক বই পড়ে পরীক্ষার পর পরীক্ষা শেষ করে ফেলছে। নেই গবেষণার প্রতি আগ্রহ। একাডেমিক পড়াশোনার বাইরে জ্ঞান চর্চার নেই ইচ্ছে। গুটিকয়েক শিক্ষার্থীর মধ্যে আগ্রহ থাকলেও নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক বরাদ্দ নেই, সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অপ্রতুলতা। ফলে অনেক শিক্ষার্থী নিজেদের গুটিয়ে রাখছে। শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও তাই। ক্লাসে পাঠদানে গুরুত্ব না দেওয়া, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক তৈরিতে ব্যর্থ। ফলে শিক্ষার্থীরা আরো দূরে সরে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ভেতর থেকে নতুন চিন্তা-ভাবনা প্রকাশিত হচ্ছে না।
শুধু যে গবেষণার ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি এমন নয়। প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। আবার যেগুলোতে লাইব্রেরি আছে, সেখানে নেই আধুনিক সুযোগ-সুবিধা, নতুন প্রজন্মের প্রয়োজনীয় বইপত্র। তথ্য প্রযুক্তির ছোঁয়া আজ সর্বত্রই। তবুও এখনো শতভাগ মাল্টিমিডিয়া ক্লাস পরিচালনা সম্ভব হয়নি। নেই সমৃদ্ধ কম্পিউটার ল্যাব। যদিও সরকার প্রতি বছর ল্যাব প্রতিষ্ঠা করছে। দেশের শীর্ষ স্থানীয় পত্রিকার তথ্যানুযায়ী দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাব নেই। এছাড়া বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেই স্থায়ী ক্যাম্পাস। অস্থায়ী ক্যাম্পাসে হচ্ছে পাঠদান। ফলে শিক্ষার্থীরা নানা ভোগান্তির শিকারের পাশাপাশি দেশের শিক্ষা ও গবেষণায় হিমশিম খাচ্ছে।
শিক্ষার প্রতি সরকার প্রতি বছর আর্থিক বরাদ্দ বৃদ্ধি করছে। কিন্তু সীমাহীন দুর্নীতি, নিয়মতান্ত্রিক ব্যবহার না থাকার ফলে শিক্ষার মান বৃদ্ধি সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ বাড়াতে হবে। গবেষণা করার আধুনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে আন্তরিকতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য নজর দিতে হবে। শিক্ষাপদ্ধতি যুগোপযোগী করার পাশাপাশি শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার নিশ্চিত করতে হবে।