১৯ জানুয়ারি ২০২৩, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয়গণের সৌজন্য সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হয়। প্রাণবন্ত আলোচনার এক পর্যায়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার ছোট্ট জায়গা, আমার জনসংখ্যা বেশি, সেটা মাথায় রেখেই দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার পদক্ষেপ নিয়েছি। শিল্প খাতে দ্রুত পরিবর্তন আসছে বারবার। এই পরিবর্তনে এখন আসছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। এখনই তার উপযোগী দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে।’ বৈঠকে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে দক্ষ নাগরিক গড়ে তুলতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে নির্দেশ দেন তিনি। তার নির্দেশনার যথাযথ বাস্তবায়ন ঘটাতে শিক্ষা পরিবার তথা শিক্ষাসংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, প্রাইমারি, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যেতে হবে। এক্ষেত্রে কর্মপন্থা প্রণয়নের জন্য আমাদের মতো আর্থসামাজিক অবস্থানে থেকে যে দেশগুলো এগিয়ে যাচ্ছে, চাকরিক্ষেত্রে তাদের বৈশ্বিক অবস্থান ও শিক্ষার বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করা সর্বাগ্রে জরুরি।
পরিসংখ্যান মতে, আমেরিকায় ভারতীয় জনসংখ্যা তাদের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশ। কিন্তু বিশ্বপ্রযুক্তির রাজধানীখ্যাত সিলিকন ভ্যালির তিন ভাগের এক ভাগ প্রকৌশলী ভারতীয়। গুগল, অ্যাডোবি, মাইক্রোসফট, আইবিএম, টুইটারের মতো স্বনামধন্য কোম্পানির সিইও ভারতীয়। শুধু তা-ই নয়, বিশ্বের শীর্ষ ১০ শতাংশ কোম্পানির সিইওর আসন অলংকৃত করে রেখেছে ভারতীয়রা। প্রতি বছর ব্যবসাক্ষেত্রে চরম সফল ৫০০ কোম্পানির তালিকা তৈরি করে ফরচুন ম্যাগাজিন। ‘ফরচুন ফাইভ হানডেড্র’ কোম্পানির ৩০ শতাংশ সিইও হলো ভারতীয়। ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রভাবশালী সিইওদের মধ্যে গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই, মাইক্রোসফটের সিইও সত্য নাদেলা, টুইটারের সিইও পরাগ আগরওয়াল, অ্যাডোবির সিইও শান্তনু নারায়ণ, আইবিএমের সিইও অরবিন্দ কৃষ্ণ, নোকিয়ার সিইও রাজিব সুরি, মাস্টার কার্ডের সিইও জয় পাল সিং, পেপসির সিইও ইন্দ্রা নুয়ী, মাইক্রন টেকনোলজির সিইও সঞ্জয় মালহোত্রা, পলো আলতো নেটওয়ার্কের সিইও নিকেশ আরোয়া, স্যালেনের সিইও লিনা নারায়ণসহ রয়েছেন আরও অনেকে। এর অন্তর্নিহিত কারণ হলো ভারতীয়রা নিজেদের দেশ থেকে সমস্যা সমাধানের এক অভিনব ক্ষমতা নিয়ে আসে। ভারতের জনসংখ্যা প্রায় ১৪০ কোটি। দেশের জনসংখ্যার প্রায় চার ভাগের এক ভাগ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। এছাড়াও দেশ জুড়ে শিক্ষা, চিকিৎসা ও অবকাঠামোসহ সব ক্ষেত্রে সুযোগ অপ্রতুল। এত অসুবিধার মধ্যে বেড়ে ওঠার কারণে ভারতীয়দের মধ্যে বিশেষ ধরনের মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা জন্মায়। সীমাহীন প্রতিবন্ধকতা পার করতে গিয়ে ভারতীয়রা পরিবর্তিত পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারদর্শী হয়ে ওঠে।
ভারতীয় সিইওদের মধ্যে একটি বিষয়ে মিল আছে। তা হলো তাদের বেশির ভাগের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি আছে। তাদের অনেকেই ভারতীয় আইআইটি থেকে পড়ালেখা করেছেন। ভারত থেকে পড়ালেখা শেষে আমেরিকার শীর্ষ বিদ্যাপীঠ ভারতীয়দের জন্য এক নতুন দুয়ার উন্মোচন করে। ভারত থেকে শেখা কঠিন অধ্যবসায় তারা আমেরিকায় গিয়ে কাজে লাগায়। ফলে ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা খুব সহজেই সবার চেয়ে এগিয়ে যেতে পারে।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে জীবন ভারতীয়দের চেয়েও বেশি প্রতিযোগিতাময়। কারণ বাংলাদেশের প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব ভারতের প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্বের প্রায় তিন গুণ। আমারদেরও প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকার ক্ষমতা ঈর্ষণীয়। কিন্তু যে ক্ষেত্রে আমরা ভারতীয়দের চেয়ে পিছিয়ে আছি, সেটা হলো ইংরেজি ও গণিত। বর্তমানে আমাদের দেশে ইউটিউব এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইংরেজি শিক্ষার বিষয়টি একটি পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারলেও গণিতে উৎকর্ষসাধনের বিষয়টি অধরাই থেকে যাচ্ছে। ২০২২ সালে গণিত অলিম্পিয়াডে চীনারা ২৫২ পয়েন্ট পেয়ে প্রথম স্থান, ১৬৫ পেয়ে ভারত ২৪তম স্থান এবং ১১৫ পেয়ে বাংলাদেশ ৫৭তম স্থান অধিকার করে। গণিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করে দেশের সেরা গণিতজ্ঞ শিক্ষার্থীরা। পয়েন্ট প্রাপ্তির ভিত্তিতে আমাদের সেরা গণিতজ্ঞ শিক্ষার্থীরা চীনের তুলনায় ২ দশমিক ১৯ এবং ভারতের তুলনায় ১ দশমিক ৪৩ অনুপাত পিছিয়ে আছে। ২৪ মে ২০২২ একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার খবরের শিরোনাম ‘ইংরেজি-গণিতে এখনো দুর্বল শিক্ষার্থীরা ’। গবেষণাধর্মী এই রিপোর্টে দেখানো হয়েছে যে, মাধ্যমিক পর্যায়ে ইংরেজিতে ৬১ শতাংশ ও গণিতে ৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থীর অবস্থা হতাশাব্যঞ্জক। প্রকৃতপক্ষে প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত গড়া গণিতের ভিত্তিই বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উচ্চশিক্ষায় গবেষণার প্রাণভোমরা।
প্রোগ্রাম ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট (পিআইএসএ)-ইকোনমিক করপোরেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি)-এর উদ্যোগে পৃথিবীর ৮০টি দেশের ১৫ বছর বয়সের শিক্ষার্থীদের গণিত ও বিজ্ঞানবিষয়ক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের প্রতিযোগিতা। এটি প্রতি তিন বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হয়। এই প্রতিযোগিতায় ২০১৮ সালে চীন প্রথম স্থান আর আমেরিকা ৩৭তম স্থান অধিকার করে। এতে আমেরিকান তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভীষণভাবে হতাশ ও উদ্বিগ্ন হন। তিনি তার উদ্বিগ্নতার বহিঃপ্রকাশ ঘটান তার টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে টুইট করে, ‘জেগে ওঠো আমেরিকা, আমাদের খাবার চাইনিজরা খেয়ে নিচ্ছে।’ ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক লাইনের এই টুইটই গবেষণা ও শিল্পে গণিতের অপরিহার্যতা প্রকাশ করেছে।
চাঁদে অবতরণকারী তিন জন নভোচারীর নাম আমরা প্রায় সবাই জানি। কিন্তু চাঁদে সফলভাবে রকেট উৎক্ষেপণের জন্য যে গণিতবিদগণ দিনরাত পরিশ্রম করেছেন তাদের নাম লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে গেছে। এরা হলেন ক্যাথেরিনা জনসন, ডরোথি ভাউগান ও মেরি জ্যাকসন। রকেট উৎক্ষেপণের ক্ষেত্রে অন্তরালের এই নায়কদের অবদান নিয়ে ২০১৬ সালে ‘হিডেন ফিগারস’ নামক একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। সিনেমায় গণিতবিদ ক্যাথেরিনা জনসনের একটি উক্তি সর্বকালেই গ্রহণযোগ্যতা পাবে, ‘প্রযুক্তি আসে এবং যায়। রাজনীতির পালাবদল হয়। কিন্তু গণিত সর্বদাই আস্থার স্থল।’
গবেষণা, শিল্প ও স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রসৈনিক হতে হলে প্রথম দরকার গণিতে পারদর্শী ও অনুরাগী জাতি। গণিতের অনুরাগ বাড়াতে গণিতের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টিসহ গণিতকে জয় করার সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা থাকতে হবে। এ লক্ষ্যে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থায় গণিত শেখার সঠিক কৌশল অনুসন্ধানে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা দরকার। তবেই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মানসম্মত গবেষণার চর্চা বাড়বে। এগিয়ে যাবে দেশ, উন্নত ও সমৃদ্ধ হবে জাতি।