দেশের পুঁজিবাজার ‘ফ্লোর প্রাইস’ বা সর্বনিম্ন মূল্যস্তরে’ আটকে যাওয়ায় সব ধরনের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ‘ফ্লোর প্রাইস’ ভীতি কাজ করছে। এ কারণে লেনদেনও নেমেছে তলানিতে। ৩১ জুলাই ‘ফ্লোর প্রাইস’ কার্যকর হওয়ার পর থেকেই শেয়ারবাজারে লেনদেনে খরা চলছে। ৮৩৮ কোটি টাকার ওপরে উঠে যাওয়া লেনদেন ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে এখন ৬০০ কোটি টাকার একটু ওপরে অবস্থান করছে।
শেয়ারবাজারসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সবাই এখন ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার অপেক্ষায় আছেন। তারা বলছেন, বেশির ভাগ শেয়ার ফ্লোর প্রাইসে আটকে থাকায় বাজারে লেনদেন কমে গেছে। তাতে প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি উভয় বিনিয়োগকারীই বলতে গেলে নিষ্ক্রিয় রয়েছেন। এ কারণে বাজার স্থবির হয়ে পড়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও দেশের অর্থনীতির নানা খাতে সংকট দেখা দিলে শেয়ারবাজারেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাতে দ্রুত কমতে থাকে শেয়ারের দাম। সূচকও পড়ে যায়। এমন এক পরিস্থিতিতে বাজারের পতন ঠেকাতে গত জুলাইয়ে শেয়ারের সর্বনিম্ন মূল্যস্তর বেঁধে দেয় বিএসইসি। এতে শেয়ারের দাম নির্দিষ্ট একটি সীমায় আটকে যায়। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবু আহমেদ শনিবার ইত্তেফাককে বলেন, পুঁজিবাজার ‘ফ্লোর প্রাইস’ দেওয়ার পক্ষে কোনো যুক্তি নেই। এটি একটি ভুল সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের এমন কোনো দেশে নজির নেই যেখানে শেয়ারবাজারে মূল্য আটকে রাখা হয়েছে। যে বাজারে কেনা-বেচা করা যায় না সেটা বাজার হতে পারে না। যে বাজারে লেনদেন হওয়ার কথা ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা সেখানে লেনদেন হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকা। অনেকে জরুরি প্রয়োজনে টাকার দরকার হলেও শেয়ার বিক্রি করতে পারছেন না। যত দ্রুত সম্ভব ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
কেউ কেউ বলছেন, এ মুহূর্তে ফ্লোর প্রাইস তুলে দিলে বাজারে ব্যাপক পতন হবে—এ বিষয়ে আবু আহমেদ বলেন, ‘ধরেই নিলাম ২০০ থেকে ৩০০ পয়েন্ট সূচক পড়ে যাবে। তাতে কমে গেলে শেয়ারমূল্য আবার বাড়বে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৬০ শতাংশ কোম্পানি তাদের আর্থিক রিপোর্ট খারাপ দেখিয়েছে। ঐ সব কোম্পানির দাম সমন্বয় করতে হবে। ফ্লোর প্রাইস দেওয়াতে শেয়ার প্রাইস আটকা পড়ে গেছে। কোনো ভালো বিনিয়োগকারী বলবে না যে, ফ্লোর প্রাইসের কোনো যুক্তি আছে। বাজার উঠবে নামবে এটাই বাজারের বিউটি।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সর্বনিম্ন মূল্যস্তরই মূলত শেয়ারবাজারকে জটিল এক পরিস্থিতিতে নিয়ে গেছে। এখন এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যেখানে সর্বনিম্ন মূল্যস্তর বহাল রেখে বাজারে কিছুতেই গতি সঞ্চার করা যাবে না। বাজারের পতন ঠেকাতে যে মূল্যস্তর আরোপ করা হয়েছিল, সেটিই এখন বাজারের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে শেয়ারবাজারে ভালো ভালো কোম্পানির শেয়ারের লেনদেন বন্ধ হয়ে গেছে। লেনদেন হওয়া কোম্পানিগুলোর বেশির ভাগেরই দাম প্রতিদিন একই জায়গায় আটকে থাকছে।
গত কয়েক দিনে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্ট ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাজারে মূল সমস্যা হচ্ছে আস্থাহীনতা। এর কারণ- আর্থিক খাতে দুর্নীতি অনিয়মের নানা নেতিবাচক খবর। আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতা, ডলার সংকট, টাকার মান কমে যাওয়া, রিজার্ভ কমে যাওয়া অন্যতম। বেশির ভাগ কোম্পানির আর্থিক অবস্থা ভালো নেই। কোম্পানিগুলোর পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে—আন্তর্জাতিক বাজারে আমদানিকৃত পণ্যের কাঁচামালের দাম বেড়ে গেছে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় তাদের খচর বেড়ে গেছে। আগামীতে এ প্রবণতা আরো বাড়তে পারে বলে তাদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি কাজ করছে। এছাড়া আগামী বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে এ ধরনের আতঙ্ক আছে। সেটাকে ঘিরে বিনিয়োগকারী এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটি দুশ্চিন্তা আছে।
এ অবস্থায় বাজারে গতি ফেরাতে গত ২১ ডিসেম্বর ১৬৯ প্রতিষ্ঠানের সর্বনিম্ন মূল্যস্তর তুলে নেওয়া হয়। বিএসইসির নির্দেশনা অনুযায়ী, ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া ১৬৯ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তালিকাভুক্ত কোম্পানির পাশাপাশি মিউচুয়াল ফান্ডও রয়েছে। বিএসইসি জানিয়েছে, ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া হলেও এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম এক দিনে সর্বোচ্চ ১ শতাংশের বেশি কমতে পারবে না। তবে নিয়ম অনুযায়ী, এসব প্রতিষ্ঠানের দাম এক দিনে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারবে।
সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম ফ্লোর প্রাইসে নেমে আসে। তাতে এসব প্রতিষ্ঠানের লেনদেন একপ্রকার বন্ধ হয়ে যায়। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে বাজারে। লেনদেনও কমে যায়। এমন পরিস্থিতি বাজারসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষ ফ্লোর প্রাইস তুলে দেওয়ার সুপারিশ করে। তার ভিত্তিতে প্রথম ধাপে ১৬৯ প্রতিষ্ঠানের ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএসইসি।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, যেসব প্রতিষ্ঠানের ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া হয়েছে সম্মিলিতভাবে এসব প্রতিষ্ঠানের বাজার মূলধন বাজারের মোট মূলধনের প্রায় ৫ শতাংশ। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমলেও তার বড় ধরনের কোনো প্রভাব সূচকে পড়ছে না। বাজারে যাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে সে জন্য কম মূলধনী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর থেকেই মূলত ফ্লোর প্রাইস তুলে নেওয়া হয়।
এর আগে সূচকের পতন ঠেকাতে গত ২৯ জুলাই থেকে তালিকাভুক্ত সব শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের ওপর ফ্লোর প্রাইস আরোপের সিদ্ধান্ত নেয় বিএসইসি। ঐ সময় বিএসইসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।