পুরো বিশ্ব এক টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গত এক বছরে জীবনযাত্রার সংকট কেবলই তীব্র হয়েছে। দিন যত গড়াচ্ছে, বেশির ভাগ মানুষেরই আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য রক্ষা করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে। কবে বিশ্ব ফিরে পাবে তার চিরচেনা স্বাভাবিকতা—এটাই এখন সবার বড় চিন্তার বিষয়। স্বল্প, মধ্যম বা উন্নত দেশ—ভালো নেই কেউই। বিশেষ করে অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতিই সব সর্বনাশের মূল। আর এর মধ্যেই আসছে আমাদের জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচন মানেই অস্থিরতার শঙ্কা। তাই এই পূর্বানুমান করা মোটেও অসাধ্য নয় যে, নিশ্চিতভাবেই আমাদের জন্য এক দুঃসহ সময় অপেক্ষমাণ।
তবে নির্বাচনি বছরে অর্থনীতির অবস্থা যে রকমই থাকুক না কেন, শেয়ার বাজারের পরিস্থিতি একটু ভালো থাকে—সাধারণ বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবাই এরকমই আশা করেন। বিশেষ করে মাহাবুব সাহেবের (প্রতীকী নাম) মতো বিনিয়োগকারীরা, যারা বিনিয়োগের সব নিয়মকানুন শিকেয় তুলে, জীবনের সব কষ্টার্জিত সঞ্চয়টুকু আরো বেশি ভালো থাকার আশায় শেয়ার বাজারের মতো একটি ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় বিনিয়োগ করে আজ সর্বস্বান্ত। অবশেষে তাচ্ছিল্য ও ঔদাসীন্যপূর্ণ এক জীবন অতিবাহিত করছেন। তাই তো দুরাশার কালো মেঘ ভেদ করে যখন এক চিলতে আলো দেখা যায়, তখনই মনে স্বপ্ন জাগে, ভাবে সুদিন বুঝি ফিরে আসবে। নির্বাচনের আগে এটি সরকারের শেষ বাজেট। তাই তো নির্বাচনি বাজেট নিয়ে বিনিয়োগকারীদের অনেক প্রত্যাশা—নিশ্চয়ই অর্থমন্ত্রী এবারের বাজেটে মাহাবুব সাহেবদের জন্য কোনো সুখবর রেখেছেন। আশা-নিরাশার দোলাচলে বিনিয়োগকারীরা। ব্রোকার হাউজগুলোও বিনিয়োগকারীদের উপস্থিতিতে সরগরম। সবকিছু ভুলে তারা নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন। অন্তত লেনদেনের চাঙাভাবে এটাই প্রতিভাত হয়।
গত বছরের নভেম্বরের পর লেনদেন ছাড়িয়েছে হাজার কোটি টাকার ওপরে। লেনদেনের ওপর ভর করে ঝিমিয়ে থাকা সূচকেও দেখা যাচ্ছে কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা। কারণ হিসেবে অনেকে মনে করছেন, শেয়ার বাজার প্রাণবন্ত ও বিনিয়োগবান্ধব করার লক্ষ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে যে প্রণোদনাগুলো প্রস্তাব আকারে পাঠানো হয়েছে, তা থেকে বাজেটে অর্থমন্ত্রী নিশ্চয়ই কিছু না কিছু বিবেচনা করবেন, যা শেয়ার বাজার স্থিতিশীলতায় ভূমিকা রাখবে। যেমন :বন্ড থেকে সুদের আয়ের ওপর কর অব্যাহতি, যা একটি শক্তিশালী বন্ড বাজার তৈরি করবে। একটি কার্যকর বন্ড বাজার অর্থনীতিকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করতে পারে। আবার দেখা যাচ্ছে, বিনিয়োগকারীরা সাধারণত শেয়ার বাজার থেকে লভ্যাংশ আকারে যে মুনাফা লাভ করেন, তা কিন্তু কোম্পানিগুলোর কর-পরবর্তী মুনাফা। তাই এই লভ্যাংশের ওপর আবার কর, এটি একধরনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের করারোপ। এটি বাতিল করে লভ্যাংশের ওপর উেস কর চূড়ান্ত কর হিসেবে বিবেচিত হলে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ বাড়বে।
এছাড়া স্টক এক্সচেঞ্জের স্টেকহোল্ডারদের উেস কর হ্রাস করতে হবে। এটি এই মন্দা বাজারে তাদের টিকে থাকতে সহায়তা করবে। এসএমই বোর্ডের অধীনে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর জন্য রেয়াতযোগ্য হারে কর আরোপের দাবি জানানো হয়েছে। তাহলে ঐ কোম্পানিগুলো তালিকাভুক্তির জন্য উত্সাহী হবে এবং শেয়ার বাজারের গভীরতা বাড়বে। মূলত এই প্রস্তাবগুলো নিয়েই বিনিয়োগকারীদের একটু বাড়তি প্রত্যাশা। তবে অভিজ্ঞ মাহাবুব সাহেব শেয়ার বাজারের সাময়িক মুভমেন্টের জন্য এই ইস্যুগুলোই বড় করে দেখেন না। তার অভিজ্ঞতা বা বিশ্লেষণ বলছে অন্য কিছু। তিনি লক্ষ করলেন, ব্রোকার হাউজের সবারই আলোচনার বিষয় বাজেট। আর এই সময়ে বরাবরই দেখা যায়, বাজেটে বিনিয়োগকারীদের যৌক্তিক চাওয়া-পাওয়াগুলো পেছনে ফেলে সবচেয়ে যে বিষয়টি আলোচনার বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়, সেটি হলো কালোটাকা বিনিয়োগ। তবে এবার কালোটাকার বিষয়টি বিনিয়োগকারীদের ভাবনার জায়গায় অতটা গুরুত্ব পায়নি। অহেতুক ভেবেই বা কী লাভ? প্রত্যাশিত হারে কালোটাকা কখনো শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ হয়নি।
দেখা গেছে, গত ২০২১-২২ অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত নামমাত্র ৪৯ জন কালোটাকা শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করেছেন। অর্থমন্ত্রীও হতাশ—তাই তো চলতি অর্থবছরে অর্থমন্ত্রী দেশের মধ্যে থাকা কালোটাকা বিনিয়োগের পথ বন্ধ করে দিয়ে, বিদেশে পাচারকৃত অর্থ সুযোগ দিয়ে দেশে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এখানেও তিনি ব্যর্থ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে সরকারের এই সহজ সুযোগ কেউ গ্রহণ করেছে এমনটি জানা যায়নি। এনবিআরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রচারের অভাব ও আস্থার সংকটে কেউ বৈদেশিক সম্পদ ফেরত আনার সুযোগ নেয়নি। তবে এটি কীভাবে আরো প্রচার করা যেত, সে সম্পর্কে তারা স্পষ্ট করে কিছু জানাননি। সরকার বুঝতে ব্যর্থ হলেও মাহাবুব সাহেবরা কিন্তু ঠিকই আঁচ করতে পেরেছিলেন—পাচারকৃত টাকা দেশে ফিরবে না এবং আগামী বাজেটে এই সুযোগ আর রাখা হবে না। এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার বই আর কিছু নয়। তাই কালক্রমে কালোটাকার বিষয়টি বিনিয়োগকারীদের কাছে এখন আর খুব বেশি অর্থবহ কিছু নয়।
অন্যদিকে লাগামহীন মূল্যস্ফীতিতে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের ব্যয় বেড়েছে। ফলে মানুষের হাতে উৎবৃত্ত অর্থ থাকছে না। তাই ব্যাংকে যেমন আমানত কমছে, তেমনি অন্যান্য সঞ্চয়ী উপকরণেও বিনিয়োগের প্রবণতা কমছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক জরিপে জানা গেছে, অর্থনীতির এই অবস্থায় বাংলাদেশে মাথাপিছু ঋণগ্রহণ বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। ৩৭ শতাংশ পরিবার ঋণ গ্রহণ করে জীবিকা নির্বাহ করছে। এই যখন সামষ্টিক অর্থনীতির হাল, সেখানে শেয়ার বাজার ঊর্ধ্বমুখী। আবার যেখানে অর্থমন্ত্রী আগামী বাজেটে শেয়ার বাজারের জন্য কোনো সুখবর রাখেননি; বরং বাজেট পাঠে একবারের জন্যও শেয়ার বাজারের নাম উচ্চারণও করেননি। বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনেও দেখা গেছে, অর্থমন্ত্রী, সচিব ও গভর্নর শেয়ার বাজারের প্রশ্ন-উত্তরে একে অপরকে পাশ দিয়েছেন। মহা আশ্চর্যের বিষয়, এর কোনো নেতিবাচক প্রভাব বাজারে পড়েনি। না, এটা এত সরল দৃষ্টিতে দেখতে মাহাবুব সাহেব রাজি নন। কারণ মাহাবুব সাহেব জানেন, অস্বাভাবিক সময়ে স্বাভাবিক আচরণ, এটি একটি অস্বাভাবিকতার লক্ষণ।
সাম্প্রতিক সময়ে বাজার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, অনেক শেয়ার ফ্লোর প্রাইস ছেড়ে ওপরে উঠে গেছে। কিন্তু ভালো মৌলভিত্তি শেয়ারের কোনো ক্রেতা নেই। লেনদেনে শীর্ষে থাকা কোম্পানিগুলোর মধ্যে ভালো মৌলভিত্তির শেয়ার আতশি কাচ দিয়ে খুঁজে বের করতে হয়। লেনদেন যা হয়, এর এক-তৃতীয়াংশ নির্দিষ্ট একটি সেক্টরের। জানা যায়, সেই সেক্টরে নাকি সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই কোনো কোনো শেয়ারদর বেড়ে তিন-চার গুণ হয়েছে। এটি কি কোনো স্বাভাবিক বাজার? নাকি সেই পুরোনো বিমা খাতের প্রেতাত্মারা বাজার দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। আবার অনেকে বলে থাকেন, এবারের বাজেটে তালিকাভুক্ত আর অতালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে করের পার্থক্য আরেকটু বাড়ানো যেত কি না। এটি করলে নিঃসন্দেহে ভালো হতো।
তবে ভেবে দেখার বিষয় হলো, শেয়ার বাজারে যেসব ভালো কোম্পানি রয়েছে। সেগুলো কি যথাযথ মূল্যে রয়েছে? বাজার কি এই শেয়ারগুলোর প্রতি যৌক্তিক আচরণ করছে? এটা কি প্রমাণ করে না যে, আমাদের শেয়ার বাজার এখনো সেই ম্যাচিউর্ড জায়গায় পৌঁছায়নি? কোনো যৌক্তিক নিয়ম মেনে আমাদের শেয়ার বাজারের গতি নির্ধারিত হয় না। এই বাজারে বাস্তবতা নেই, আছে অকারণে প্রত্যাশার প্রসারণ। বাজার যখন কোনো একদিকে মোড় নেয়, তখন সবাই সেই দিকেই ছুটতে থাকে। এটাকে বলে হার্ড মেন্টালিটি। অনেক বেশিসংখ্যক বিনিয়োগকারী কারসাজির প্ররোচনায় নির্দিষ্ট বা কমসংখ্যক কিছু শেয়ারের পেছনে যুক্তিহীনভাবে ছোটে। চিন্তা-চেতনার কোনো বালাই নেই। সবাই এখানে স্বপ্নে পৌষ দেখে, কিন্তু দিগন্তে অপেক্ষমাণ সর্বনাশের কথা কেউ ভাবে না।
প্রখ্যাত দার্শনিক সান্তানার বিখ্যাত একটি উক্তি, ‘যারা অতীত মনে করতে পারে না, দণ্ডনীয়ভাবে তারা একই ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে।’ সেই পথ ধরেই বাংলাদেশের শেয়ার বাজারে বারবার একই পরিণতি। সুযোগসন্ধানী চক্রের কলকাঠি নাড়ানোই শেয়ার বাজারের ইতিহাস। এখানে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কোনো বিনিয়োগ নেই। আবার কেউ করলেও বিনিয়োগ সুরক্ষা নেই, সুশাসন নেই। অব্যবস্থাপনার শেষ নেই। দশকের পর দশক ধরে কারসাজি চক্রের বলয়ে থেকে থেকে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা সুষ্ঠু চিন্তা করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। ভালো মানের বিনিয়োগকারী তৈরি হয়নি।
এই মুহূর্তে একটি ঘটনা মাহাবুব সাহেবের খুব মনে পড়ছে, এটি ছিল ২০১২ কি ১৩ সাল—হাউজে বসা মাহাবুব সাহেব। মন্দা বাজার, সূচক পড়ছেতো পড়ছেই। তাকিয়ে দেখা ছাড়া কোনো উপায় নেই। এরই মধ্যে স্মার্ট এক যুবক হন্তদন্ত হয়ে ট্রেডিং রুমে ঢুকেই ট্রেডারকে বলেন, ‘আমরা হোটেলে ঢোকেন, আমরা হোটেলে ঢোকেন’। সবাই উল্লসিত, নিশ্চয়ই এর কাছে কোনো নিউজ আছে, যার জন্য সবাই মুখিয়ে আছেন। এই তো দু-চার পয়সা আয়ের সুযোগ। কিছুক্ষণ পরেই তারা সংবাদ ফিরে পান—আরে, ‘আমরা হোটেল’ বলতে তো কোনো কোম্পানি শেয়ার বাজারেই নেই। কোম্পানিটির নাম ‘আমরা টেকনোলজি’। নিচে বসে চা খেতে খেতে সংবাদটি পেয়ে যুবকটি তৃতীয় তলায় উঠতে উঠতে কোম্পানির নামই ভুলে গেছেন—এই আমাদের শেয়ার বাজারের হালহকিকত। আরো বিশদভাবে বললে, যে দেশে মেয়ের বান্ধবীর ননদের হাজব্যান্ডের কথা শুনে কোনো অর্থনীতিবিদ নিজে, তার ছেলেমেয়ে, স্ত্রী বা কাজের বুয়া, এমনকি বাড়ির দারোয়ান ও ড্রাইভার—সবাই একসঙ্গে ধনী হওয়ার আশায় শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করেন, সেই বাজারের পরিস্থিতি এর চেয়ে ভালো আর কীই-বা হবে?