
সারা দেশের মানুষ যখন ঈদ উদযাপনের প্রস্ততি নিয়ে ব্যস্ত ঠিক তখনই আমাদের গার্মেন্টস শ্রমিকদের রাজপথে নামতে হয় বেতন(মজুরি) এবং বোনাসের নিশ্চয়তার জন্য। যাদের শ্রমে দেশের অর্থনীতি সচল থাকে আর সেই শ্রমিকরা যখন তাদের ক্ষুধা নিবারেণের জন্য বেতন (মজুরি) জন্য রাজপথে নামে তখন তাদের এই ন্যায্য দাবীকে উপেক্ষা করার জন্য রাষ্ট্রের একটা পক্ষ থেকে এটাকে শ্রমিক বিশৃঙ্খলা আখ্যা দেওয়া হয়। কিছু মুখোশধারী দেশপ্রেমিক চাটুকার মালিকদেশ পক্ষ নিয়ে মুখরোচক বক্তব্য দেন। আমার প্রশ্ন হলো শ্রমিদেরকে কেনো বেতন (মজুরি) জন্য রাজপথে আন্দোলনে নামতে হবে? কাজের শেষে কেনো শ্রমিকদের ন্যায্য বেতন ( মজুরি) হবে না? কাজ শেষে মালিকরা শ্রমিকদের বেতন (মজুরি) নিয়ে যে তালবাহনা করেন তার নাম মালিক শৃঙ্খলা। আমার অধিকারের কথা বললে তার বিশৃঙ্খলা আর আর আমাকে দিনের পর দিন বেতন (মজুরি) বঞ্চিত করার নাম শৃঙ্খলা। বা! কি চমৎকারা নিয়ম। দেশের তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল খাতের অধীনে থাকা ১২২টি কারখানা এখনও শ্রমিকদের ফেব্রুয়ারি মাসের বকেয়া বেতন পরিশোধ করেনি। এখনও ঈদ বোনাস দিতে পারেনি ৭২৩টি পোশাক কারখানা। জানুয়ারি বা তারও আগের বেতন বকেয়া রয়েছে ৩০টি কারখানায়।
এ যেন এক আজব শৃঙ্খলা! শ্রমিক তার ঘাম ঝরিয়ে কারখানায় জীবন পুড়াবে, আর মালিক সেই ঘামের দাম দিতে গড়িমসি করবে! এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বললেই তাকে বলা হবে উচ্ছৃঙ্খল, আর শ্রমিকের পাওনা মেরে খেলেই সেটি হবে নিয়মের শৃঙ্খলা! কেনো ঈদের আগে রাস্তায় নামতে হবে আমাদের? কেনো উৎসবের আনন্দের বদলে হাতে আসে লাঠির আঘাত? আমাদের শ্রমে গড়া অর্থনীতির সুফল ভোগ করে কারা? যদি মজুরি চাওয়াটাই অপরাধ হয়, তবে এ কেমন সুবিচার? শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার মানবে না যে সমাজ, সে সমাজ কি আদৌ সভ্য হতে পারে? বেঁচে থাকার জন্য, অধিকার আদায়ের জন্য, আমরা কি তাহলে প্রতিবাদ করতে করতে জীবন কাটিয়ে দেব? আর কতকাল চলবে এই বৈষম্যের খেলা? শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই মজুরি চাই, শ্রমিকের ঈদ আনন্দের আগেই পাওনা চাই! ন্যায়বিচার চাই, বেঁচে থাকার অধিকার চাই! যেখানে শ্রমিকের রক্তে গড়া পোশাক বিদেশে যায়, সেই শ্রমিকের ঘরে কেনো অভুক্ত ঈদ আসে? যারা দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড, তাদের কেনো করা হয় অবহেলা, নিপীড়ন-নির্যাতন? বেতনের (মজুরির) দুঃশ্চিন্তায় যদি কোন শ্রমিকের মৃত্যু হয় তবে সেই দায় মালিক এবং রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। কোন ভাবেই রাষ্ট্র, সরকার এবং মালিক এই দায় এড়াতে পারে না। আর যদি রাষ্ট্র, সরকার এবং মালিক এই দায় কোনভাবে অস্বীকার করে তবে বুঝতে হবে এই রাষ্ট্র, সরকার এবং মালিক শ্রমিক বান্ধব এবং গতিশীল অর্থনীতির উন্নয়ন বান্ধব নয়।
তবুও এই শ্রমিকের ঘামেই মালিকের সম্পদ বাড়ে, তাদের হাতেই গড়ে ওঠে বৈদেশিক মুদ্রার পাহাড়। কিন্তু সেই হাত যখন ন্যায্য পাওনার দাবি তোলে, তখনই রাষ্ট্রের চোখে তারা বিশৃঙ্খল পথচারী! বেঁচে থাকার জন্য, অধিকার আদায়ের জন্য, আমরা কি তাহলে প্রতিবাদ করতে করতে জীবন কাটিয়ে দেব? শ্রমিক শুধু উৎপাদনের যন্ত্র, তাদের সুখ, তাদের স্বপ্নের কোনো দাম নেই, কোনো অধিকার নেই? এমনিতেই গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন(মজুরি) নিয়মিত দেওয়ার নজির তেমন একটা নাই আর বেতন(মজুরি) না দেওয়ার সেই ধারাটা মালিক শ্রেণি অব্যাহত রাখেন উৎসবের সময়ও। তবে তারা কি শুধু উৎসবের আগে এক টুকরো অনিশ্চয়তার নাম? আমরা যখন উৎসবে মাতি, তারা তখন রাস্তায়, দাবির প্ল্যাকার্ড হাতে, একটু ন্যায়বিচারের আশায়, একটু সম্মানের আশায়। বেতন (মজুরি) আদায় করতে করতে গিয়ে জীবন দিতে হয়, রাষ্ট্রের বাহিনী দ্বারা রক্তাক্ত হতে হয় এর চেয়ে লজ্জার কি হতে পারে একটি স্বাধীন জাতির জন্য। দেশ স্বাধীন হয়েছে ৫৩ বছর কিন্তু শ্রমিকের অধিকার এবং শ্রমের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় নি। দেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বৈষম্য দেখে মনে হয় উৎসব এবং আনন্দ শুধু দেশের ধনিক শ্রেণি এবং মালিক শ্রেণির জন্যই বরাদ্ধ। দেশের শ্রমজীবী সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করার সমগ্র আয়োজন করে রেখেছে মালিক-শাকক-শোষক শ্রেণি। শ্রমিক ছাড়া শিল্প চলে না, অথচ তাদের অধিকার নিশ্চিত করার কেউ নেই। বড় বড় উন্নয়নের গল্প শোনা যায়, কিন্তু শ্রমিকের ভাগ্যে ন্যায্য মজুরি জোটে না।
স্বাধীন দেশে পরাধীন শ্রমিক, এ কেমন বিধান? ঘাম ঝরিয়ে গড়ি শিল্প, তবু মজুরিতে অপমান! রাস্তায় নামলেই গুলি, লাঠি, আর নির্যাতন, তবে কি শ্রমিকের ভাগ্যে শুধু বঞ্চনার আয়োজন? পোশাক রফতানি করে দেশ পায় বৈদেশিক মুদ্রা, কিন্তু শ্রমিকের ঘরে থাকে অন্ধকারের দুর্ভিক্ষযাত্রা। শ্রমের মূল্য চাইতে গেলে শুনতে হয় হুমকি, এই বৈষম্যের শেষ কোথায়? নাকি এটাই চিরস্থায়ী রীতি? আমরা কি কেবল মেশিনের মতো কাজ করতেই জন্মেছি? অধিকার চাইতে গেলে কেনো নির্যাতনের শিকার হই? বছরের পর বছর প্রতিশ্রুতির নামে প্রহসন চলে, কিন্তু শ্রমিকের ভাগ্যের চাকা কখনো কি ঘুরে? এখন সময় প্রতিরোধের, জেগে ওঠার, ন্যায়বিচারের দাবিতে শক্ত হাতে দাঁড়ানোর! শ্রমিকের ঈদ হবে ন্যায্য মজুরির আলোয়, শোষণের অবসান হবে সংগ্রামের আগুনে! দেশ স্বাধীন হলো, কিন্তু শ্রমিক মুক্ত হলো না, সোনার বাংলায় শ্রমিকের ঘরে আজও অভাবের হাহাকার! রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছিল যারা, তাদেরই সন্তানেরা আজ রক্ত ঝরিয়ে বেতন আদায় করে! কেনো আমাদের ঈদ আসে চোখে জল নিয়ে? কেনো ন্যায্য পাওনা চাইতে গেলে লাঠির আঘাত সইতে হয়? রাষ্ট্র কি শুধু মালিকের? শ্রমিকের কি এখানে কোনো জায়গা নেই? স্বাধীন দেশের মাটিতে পরাধীন জীবন আর কতদিন? শ্রমিক ছাড়া শিল্প চলে না, তাহলে শ্রমিকের ঘরে কেনো হাঁড়ে হাঁড়ে অভাব? বড় বড় ভাষণ, উন্নয়নের গল্প, কিন্তু শ্রমিকের ভাগ্যে নেই ন্যায্য অধিকার! এই বঞ্চনার শেকল ভাঙতেই হবে, শ্রমের মূল্য, শ্রমিকের সম্মান নিশ্চিত করতেই হবে! রাষ্ট্র যদি শ্রমিকের না হয়, তাহলে এই রাষ্ট্র কাদের জন্য? যতদিন না অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়, ততদিন সংগ্রাম চলবেই, চলবেই! ন্যায়বিচার চাই, শোষণমুক্ত বাংলাদেশ চাই,শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার প্রাপ্য চাই!দেশ গড়ার কারিগর যারা, তারাই আজও বঞ্চিত, ঘাম ঝরিয়ে গড়ে তোলে, তবু থাকে অপমানিত। কারখানায় আগুন জ্বলে, পুড়ে মরে প্রাণ,বিচার মেলে না কখনো, থামে না এই অপমান। ন্যায্য দাবির বদলে মেলে লাঠি আর গুলি, রাষ্ট্র দেখে না তাদের, শুনে না কষ্টের বুলি। এই কি তবে স্বাধীনতা? এই কি মুক্তির গান? শ্রমিকের কান্না যখন রাজপথে দেয় সনদ জান? তবু আশার আলো জ্বলে, অধিকার একদিন আসবেই, শ্রমের মর্যাদা নিশ্চিত হলে, সত্য স্বাধীনতা হাসবেই! রাষ্ট্রের দায়িত্ব শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, মালিকরা শ্রমিকদের বঞ্চিত করলে তাতে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না, অথচ শ্রমিকরা তাদের পাওনা আদায়ে পথে নামলেই দমন-পীড়ন শুরু হয়। রাষ্ট্র, সরকার এবং মালিকপক্ষকে বুঝতে হবে—শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত না করলে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।
শ্রমিকের ঘামেই গড়ে ওঠে শিল্প, তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমেই দেশের অর্থনীতি শক্ত ভিত পায়। অথচ সেই শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি পেতে আন্দোলনে নামতে হয়, লাঠির আঘাত সইতে হয়—এ যেন চরম বৈপরীত্য! স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও শ্রমিকদের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত না হওয়া আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার এক করুণ বাস্তবতা। জানিনা আমার এই লেখায় কর্তৃপক্ষের কতটুকু বোধ জাগ্রত হবে, কতটুকু, টনক নড়বে, শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার কতটুকটু প্রতিষ্ঠিত হবে, সরকার এবং রাষ্ট্র কতটুকু শ্রমিক এবং শ্রম বন্ধব হবে শ্রমিকের ভাগ্যের কতটুকু পরিবর্তন হবে, চেতনার কতটুকু ইতিবাচক পরিবর্তন হবে তবু লিখছি শ্রমিকের অধিকার, মর্যাদা, শ্রমের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে। শ্রমজীবী মানুষের আমিও প্রত্যাশা করি শোষণমুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক এক বাংলাদেশ—যেখানে শ্রমের মর্যাদা থাকবে, শ্রমিকের হাসি থাকবে, আর বৈষম্যের শৃঙ্খল চিরতরে ভেঙে যাবে।