আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। চাইলেই অতি স্বল্প সময়ের ব্যবধানেই পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ভ্রমণ করা যায়। ভ্রমণের ক্ষেত্রে সড়কপথই বেশি সুবিধাজনক ও জনপ্রিয়। আমাদের দেশ অবকাঠামোগত দিক দিয়ে অনেকদূর এগিয়ে গেছে—এ কথা মানতেই হবে। একই সঙ্গে এ দাবিও অস্বীকার করার সুযোগ নেই, বর্তমানে সড়কপথ এক আতঙ্কের নাম! প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনার কথা শোনা যায়। এতে প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য মানুষ।
২০২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে দুটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে আট জন নিহত হয়। এর প্রতিবাদে ১ মার্চ ‘সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কাফনের কাপড় পরে মানববন্ধন’ শিরোনামে একটা সংবাদ প্রকাশ হয়, যা বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বেশ সোচ্চার হয়ে উঠে সারা দেশের মানুষ। রাস্তায় রাস্তায় বের হয় বিক্ষোভ, আন্দোলন, মানববন্ধন, প্রতিবাদ মিছিল। সবাই একটাই দাবি তোলেন—‘নিরাপদ সড়ক চাই।
বাস্তবতা হলো, দৈনন্দিন জীবনে আমাদের যে ব্যস্ততা, তার তাগিদে রাস্তাঘাটে বাড়ছে ট্রাফিক জ্যাম। ফলে স্বভাবতই বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। প্রয়োজনের তাগিদে বের হয়ে অসময়ে যেন আমাদের প্রাণ না ঝরে—এটাই সবার দাবি। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পড়াশোনার প্রয়োজনে শিক্ষার্থীরা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করে সবচেয়ে বেশি। এতে করে সড়ক দুর্ঘটনার বড় শিকার তারাই! এক্ষেত্রে সড়কপথে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তার প্রশ্ন থেকেই যায়। বস্তুত, ২০২১ সালের সেই দাবি আজও পূরণ হয়নি। বরং সড়কে লাশের সারি বেড়েই চলেছে। শিক্ষার্থী কিংবা সাধারণ জনগণ, প্রতিনিয়ত কেউ না কেউ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেই। সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে শিক্ষার্থীরা। যার পরিপ্রেক্ষিতে ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ পাশ হয়। কিন্তু ২০২৩-এ এসেও সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে আগের মতোই! প্রতি বছর ২২ অক্টোবর ‘নিরাপদ সড়ক দিবস’ পালন করা হয়। দুর্ঘটনা কমানোর বিষয়ে নানা উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলা হয়, কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন ঘটে না—বিষয়টি দুঃখজনক বটে। প্রতিবারই একটি করে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, আর দুই-তিন দিন কঠোর আন্দোলন হয়; কিছুদিন পর অবস্থা হয় সেই আগের মতোই—এমনটা কেন হবে!
এমতাবস্থায় সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। বেশির ভাগ দুর্ঘটনার মূল কারণ বেপরোয়া গাড়ি চালানো, অদক্ষ চালক, সড়ক আইন মেনে না চলা ইত্যাদি। তাছাড়া আজকের দিনে একটা বেশ পরিচিত চিত্র হয়ে উঠেছে—‘রেস-প্রতিযোগিতা’! কোন গাড়ি কত দ্রুত চলতে পারে, কে আগে যেতে পারে’—এই প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায় রাস্তায়। বিশেষ করে, উঠতি বয়সি তরুণ প্রজন্ম এই মরণখেলায় মত্ত! এক্ষেত্রে সড়কে সিসি ক্যামেরা স্থাপন জরুরি। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ কার্যকর করার পাশাপাশি মালিক শ্রমিকসহ সাধারণ মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধিও সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে অনেক আগে। আমরা দেখি, অধিকাংশ উন্নত দেশে রাস্তায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশ থাকে না; অথচ কেউ ট্রাফিক নিয়ম না মানলে কিংবা কোনো দুর্ঘটনা ঘটালে সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালে কন্ট্রোল রুম তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা রোধের ক্ষেত্রে এ ধরনের ব্যবস্থা কার্যকর করা গেলে ব্যাপক সুফল পাওয়া যাবে। মনে রাখতে হবে, যতদিন না জনগণকে নিরাপদ যাত্রার নিশ্চয়তা দিতে পারছে রাষ্ট্র, ততদিন উন্নত জাতি হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতে পারব না আমরা। এজন্য ব্যক্তিসচেতনতা তো বটেই, দরকার সড়ক আইনের ঠিকঠাক বাস্তবায়ন।