সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামছে না। মাদারীপুরের শিবপুর উপজেলায় ঢাকাগামী একটা যাত্রীবাহী বাস খাদে পড়ে অন্তত ১৯ জন নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে কমপক্ষে ২৫ জন। চালকের বেপরোয়া মনোভাবে মুহূর্তেই ১৯ জন স্রেফ সংখ্যায় পরিণত হলো। উচ্চগতির বলি হলেন চালক নিজেও।
মাদারীপুরের শিবচরের কুতুবপুর এলাকায় গত রোববার সকালে ঢাকাগামী ইমাদ পরিবহনের যাত্রীবাহী বাস খাদে পড়ে যায়। এতে ব্যাপকসংখ্যক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনা আগেও ঘটেছে। কিন্তু মহাসড়কের রেলিং ভেঙে বাস খাদে পড়ে এত প্রাণহানির ঘটনা আগে ঘটেনি। এটি এক্সপ্রেসওয়েতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা।
শুরু থেকেই উচ্চগতিতে বাস চলছিল। ‘ব্রেক ঠিকমতো কাজ করছে না’—এমন কথাও বলাবলি করছিলেন চালক এবং হেলপার। উচ্চগতিতে চলার সময় অনেক যাত্রী ভয় পেয়ে চিত্কার-চেঁচামেচি করছিল। কিন্তু ড্রাইভার তাতে পরোয়া করেননি। ৩০ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে গাড়ি চালাচ্ছিলেন তিনি। যার মানে হচ্ছে, গাড়ি চালানোর মতো শারীরিক ও মানসিক ফিটনেস ছিল না তার। কিন্তু সেটি দেখার কেউ ছিল না।
আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ২০২২ সালে দেশে ৫ হাজার ৭০টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে মারা গেছে ৫ হাজার ৭৬০ জন। আগের বছরের তুলনায় বিদায়ি বছরে সড়কপথে ২ হাজার ৪১৫ জনের মৃত্যু বেশি হয়েছে। এটি নিরাপদ সড়ক চাই—নিসচার তথ্য। এছাড়া বিভিন্ন সংগঠন সড়ক দুর্ঘটনার যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে ভিন্ন ভিন্ন চিত্র উঠে এসেছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৫৪৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। যাত্রীকল্যাণ সমিতি বলছে, একই সময়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৯ হাজার ৯৫১ জন। সবার হিসাবেই ২০২২ সালে মৃত্যু বেড়েছে। এছাড়া গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৪২০ জন পথচারীর মৃত্যু হয়েছে, যা খুবই উদ্বেগের।
ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে দ্রুতগতির দুই বাসের প্রতিযোগিতায় রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ঐ দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়েছিলেন। এরপর নিরাপদ সড়কের দাবিতে ছাত্ররা রাস্তায় নেমে আসে। রাজপথে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে। গাড়ি আটকে কাগজপত্রও দেখে। লাইন মেনে গাড়ি চলাচলে বাধ্য করে। কিন্তু সেই লাইন বেশি দিন টেকসই হয়নি।
ছাত্রদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপদ সড়ক আইন আরো যুগোপযোগী ও কঠোর করা হয়। ২০১৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সংসদে ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’ পাশ হয়। ৮ অক্টোবর গেজেট জারি হয়। পরে আইনটি সেভাবে আর কার্য়কর হচ্ছে না। কারণ আইনটিতে পরিবর্তন আনার দাবি জানিয়েছিলেন পরিবহনশ্রমিকেরা। পরে ১৩ মে ২০২১ সালে পরিবহনশ্রমিকদের চাপের মুখে সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরপর আইনটি অরেকটা হিমঘরে আছে বললেও অত্যুক্তি হবে না।
সড়ক নিরাপদ হোক, এটি প্রত্যাশার কেন্দ্রে। কেননা, এর সঙ্গে জীবন-মৃত্যুর সম্পর্ক জড়িত। দেখা যাচ্ছে, দুর্ঘটনা মানেই মৃত্যু, প্রাণহানি, অঙ্গহানি, সম্পদহানি, হাহাকার, আর্তনাদ আর আহাজারি। নতুন আইন হয়েছে সড়ক নিরাপত্তায়। তা বাস্তবায়ন শুরু হলেও দুর্ঘটনা প্রতিরোধে তা খুব একটা সুফল বয়ে আনেনি; বরং এই আইনকে প্রতিহত ও অগ্রাহ্য করার প্রবণতা লক্ষণীয়। আসলে নিরাপদ সড়কের জন্য সবার এগিয়ে আসার কোনো বিকল্প নেই। কারণ সড়ক নিরাপদ না হলে এর মাশুল সব পক্ষকেই দিতে হবে।
সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে নানা রকম সুপারিশ এসেছে বিভিন্ন সময়ে। এর মধ্যে রয়েছে—বিভিন্ন গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রচার এবং তারই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। স্কুলের পাঠ্যক্রমে সড়ক দুর্ঘটনা রোধের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে তা অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে।
ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করা, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং, নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া যেখানে-সেখানে যাত্রী ওঠা-নামা, ওভারটেকিং, পালটাপালটি ও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, অতিরিক্ত যাত্রী ও মালবোঝাই করা, গাড়ির ছাদে যাত্রী বহন করা, ওভারব্রিজ কিংবা আন্ডারপাস বা জেব্রাক্রসিং থাকা সত্ত্বেও সেগুলো ব্যবহার না করার প্রবণতাকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মাধ্যমে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু শুধু একটি পরিবারে গভীর শোক, ক্ষত সৃষ্টি করে না, আর্থিকভাবেও পঙ্গু করে। কোনো কোনো দুর্ঘটনায় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি প্রাণ হারান। তখন ঐ পরিবারের যে কী অবস্থা হয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যারা পঙ্গুত্ব বরণ করেন, তাদের পরিবারের অবস্থা আরো করুণ, আরো শোচনীয়।
যানবাহনের উচ্চগতি, নাজুক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামোগত সমস্যা, পরিকল্পনা ও নীতির দুর্বলতা অসচেতনতাবিষয়ক সড়ক দুর্ঘটনা ত্বরান্বিত করছে। তাই সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কর্তৃপক্ষকে সেই সব সমস্যা দূরীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, এক বছরে প্রায় ২০ হাজার ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনায় ৩ হাজার মানুষ নিহত হয়। আহত হয় ১ লাখ। এদের বেশির ভাগই পঙ্গুত্ব বরণ করে।
দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সবাই কমবেশি জানেন। বহু বার এসব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দেশে সড়ক অবকাঠামো ও স্থলভাগের আয়তন অনুপাতে জনসংখ্যার চাপ বেশি। সড়কের তুলনায় মোটরযানের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। একই সড়কে চলছে বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার, রিকশাসহ নানা রকম মিশ্র যানবাহন। উপরন্তু, সড়ক ও মহাসড়কগুলো ত্রুটিপূর্ণ। দেশব্যাপী মহাসড়কের অনেক স্থানেই রয়েছে বিপজ্জনক বাঁক। এসব বাঁকের কারণে প্রায়ই সেই সব জায়গায় দুর্ঘটনা ঘটছে।
সম্প্রতি দুর্ঘটনা মহামারি আকার ধারণ করার জন্য যেসব কারণকে দায়ী করা হচ্ছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে চালকের অসতর্কতা ও বেপরোয়া গাড়ি চালানো। এ সমস্যা বারবার চিহ্নিত হলেও এর কোনো প্রতিকার নেই। প্রতিবার দুর্ঘটনার পরপরই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেই তদন্ত প্রতিবেদন কোনো দিন আলোর মুখ দেখে না। সংগত কারণেই দোষীদের শাস্তিও হয় না। সমাজের উঁচু স্তর থেকে নিচু শ্রেণির মানুষ যারাই দুর্ঘটনার শিকার হন না কেন, কোনো একটি ঘটনার বিচার হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত মেলা ভার। বিচারহীন, প্রতিকারহীন অবস্থায় কোনো কিছু চলতে থাকলে সেটির পুনরাবৃত্তিও তো ঘটবেই।
প্রতি বছর ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালন করা হয়। সচেতন করা হয় সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু সমস্যা থেকে যায় তিমিরেই। সড়ক দুর্ঘটনা হয় না এমন দেশ নেই। কিন্তু দুর্ঘটনার সংখ্যা ও ক্ষয়ক্ষতি যত কমিয়ে আনা যায়, সেটিই লক্ষ্য হওয়া উচিত।