সততার ইংরেজি আভিধানিক অর্থ—Honesty, Integrity, Goodness, Uprightness, Probity, Rectitude এবং Candour। ইংরেজি শব্দগুলো বাংলায় তরজমা করলে পাওয়া যায় সততার আসল তাৎপর্য ও গুরুত্ব। তার মধ্যে প্রধান কয়েকটি হচ্ছে চারিত্রিক অখণ্ডতা, শুদ্ধতা, সাধুতা, সত্যশীলতা, সম্পূর্ণতা, সত্যবাদিতা, ঋজুতা, অকপট, অবক্র, সোজা, সিধা, চারিত্রিক সরলতা, সারল্য ও স্পষ্টবাদিতা।
মানুষ যেহেতু সমাজবদ্ধ জীবন যাপন করে, সে কারণেই সমাজের এক জনের কথা, কাজ ও ব্যবহারের প্রভাব অন্য জনের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় দেখা যায়। বর্তমান বিশ্বকে ইংরেজিতে বলা হয় গ্লোবাল ভিলেজ। বিশ্বের বর্তমান বাজারব্যবস্থা এমন, যে কেউ ইচ্ছা করলেও তার সব প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী নিজে প্রস্তুত বা সংগ্রহ করতে পারে না। ফলে এক দেশের মানুষ অন্য দেশের মানুষের ওপর কোনো না কোনোভাবে নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতার জন্য যে লেনদেন হয়, তা করতে হয় সততার সঙ্গে। অর্থাৎ দুই পক্ষের চুক্তিতে যা থাকবে, বাস্তবে তা-ই প্রতিফলিত হতে হবে। এই লেনদেনও এখন হয়ে থাকে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে। কাগজপত্রই কথা বলবে। সুতরাং যা বলবেন, তা-ই করতে হবে। কোনো এক দেশের মানুষের কাজ ও কথার মিল না থাকলে শুধু সমাজে, দেশে অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে তা নয়, বিশ্ববাজার-ব্যবস্থায় তার প্রতিফলন দেখা দিয়ে এক চরম সমস্যা দেখা দেবে। দেখা দেবে অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা। এই বিশৃঙ্খলা শুধু এক দেশেই নয়, এতে একাধিক দেশের অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়বে।
সততা ব্যক্তিজীবনের পাশাপাশি প্রভাবিত করে সমাজকে। ব্যক্তিজীবন শুরু হয় নিজ সংসার থেকে। সেই সংসারই একজন ব্যক্তির বড় এবং প্রথম শিক্ষক। মানবসন্তান প্রথম শিক্ষা পায় তার মা-বাবার কথা এবং কাজ থেকে। মা-বাবার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে যদি সততা বর্জিত হয় এবং সন্তান যদি তা ধারণ করে, তখন সমাজে এক দীর্ঘস্থায়ী বিশৃঙ্খলা বা অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়। জ্ঞানার্জন করা যায়, তবে সততা আহরণ করতে হয়। সংসারের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পারে সমাজের শান্তি, সমৃদ্ধির রাস্তা সহজ এবং দ্রততর করতে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত শিক্ষক যদি সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন না করেন, তাহলেই দেখা দেবে ছাত্রদের যোগ্যতার অভাব, যা সমাজের সর্বক্ষেত্রে প্রতিফলিত হবে। খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশের পঞ্চম শ্রেণি পাশ করা ছাত্রছাত্রীর মধ্যে শতকরা ৭০ জন পড়তে, লিখতে ও গণনা করতে পারে না। একইভাবে স্বাস্থ্য খাতেও ডাক্তারদের সেবা থেকে বিশেষ করে পল্লি এলাকার জনগণ বঞ্চিত হয়। এতে আমরা দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বের হতে পারব না। স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা যাবে না। এজন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতসহ সর্বত্র সততা বজায় রাখার বিকল্প নেই।
সমাজ ও দেশ যেহেতু রাজনীতিবিদদের দিকনির্দেশনায় পরিচালিত হয়, সে কারণেই রাজনৈতিক ব্যক্তিদের আচার-ব্যবহার, কথা, চিন্তাচেতনা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সমাজব্যবস্থার সব স্তরে প্রবলভাবে প্রতিফলিত হয়। এ কারণে হয়তো সমাজে রাজনৈতিক নেতাদের অনুকরণে অনেককেই অনেক কিছু করতে বা পড়তে দেখা যায়। তার মধ্যে নেতার পোশাক সবচেয়ে বেশি অনুকরণ করে তার কর্মীরা। নেতা রাজনীতি করেন তার দেশের মানুষের কল্যাণে। আর সে কারণেই জনপ্রিয় নেতা হয়ে যান দেশের সম্পদ। তার নিজের জীবনে ব্যক্তিগত বা গোপনীয় বলতে কিছু থাকে না বা তিনি রাখতে পারেন না। নেতার জীবনের সততা ও সরলতার দ্রুত প্রতিফলন ঘটে সমাজজীবনে।
সমাজে বিশৃঙ্খলা অনেক কারণেই হতে পারে, তবে সেই বিশৃঙ্খল অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারেন একজন জনপ্রিয় নেতা সুচিন্তিত ও দূরদর্শী দিকনির্দেশনার মাধ্যমে। বিশৃঙ্খল অবস্থায় শক্তি প্রয়োগ করে শান্তি আনা যত কঠিন, নেতার আহ্বানে তা আনা অপেক্ষাকৃত সহজ। অবশ্য সমাজে বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টির পেছনেও প্রায়শই কোনো না কোনো নেতার হাত থাকে। সেখানেই জনপ্রিয় এবং দেশপ্রেমিক নেতার আসন ঠিক হয়। নেতা এক দিনে হওয়া যায় না। সময় ও সুযোগ অনেক সময় নেতাকে সাহায্য করে তার সততার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে। দীর্ঘ সময় ধৈর্য ধারণ করে সততার সঙ্গে অপেক্ষা করতে হয় জনগণের সিদ্ধান্তের জন্য। অবশ্যই তা হতে হবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অনুসরণ করে। ক্ষমতায় গেলেও সততার পরীক্ষায় ফেল করা যাবে না। রাজনীতিতে সততার প্রয়োজন তুলনামূলকভাবে একটু বেশি, যা উন্নত দেশে পরিলক্ষিত হয়।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের সমস্যা অনেক। একদিকে দেশের মানুষের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আর্থিকভাবে সমস্যাগ্রস্ত, অন্যদিকে অশিক্ষিত। এই অবস্থায় সমাজে নানারকম বিশৃঙ্খলা প্রতি মুহূর্তে বিরাজমান। সুতরাং জনপ্রিয় নেতার প্রয়োজন অত্যাবশ্যক। এমন অবস্থায় জনগণ আশা করে নেতা সত্য কথা বলবেন, কথা থেকে বিচ্যুত হবেন না। নেতার কথা ও তার কাজে মিল থাকবে। এক কথায় নেতা হবেন সব বিষয়ে সৎ। নেতার কথা আর কাজের মিল থাকলেই সমাজব্যবস্থায় অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে না। তখন সমাজে উন্নয়নের গতি হবে ঊর্ধ্বমুখী। তখন সমাজে আয় বৈষম্যের মাত্রা তুলনামূলকভাবে সহনশীল থাকবে। বাংলাদেশ অন্য আর একটি দেশ থেকে আলাদা। এই দেশের মানুষ রক্ত দিয়ে জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত পেয়েছে। তারা আশা করে অর্থনৈতিক মুক্তি। তারা অন্য দেশকে সাহায্য করবে, যেমন কিছুদিন আগে শ্রীলঙ্কাকে কিছু মার্কিন ডলার দিয়ে তাদের বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা পূরণে আমরা তাদের পাশে ছিলাম। আসল কথা হলো, সততাই ব্যক্তি ও সমাজ উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে যা সহজে পাওয়া যায় না।