যে ‘পথের পাঁচালী’ ছবি বানিয়ে সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র পরিচালনার সারা বিশ্বে নিজের স্থান করে নেন, সেই পথের পাঁচালীর কাহিনীটা নাটকীয়ভাবেই এসেছিল তার জীবনে। ১৯৪৫ সালের ঘটনা। সত্যজিৎ রায় তখন সিগনেট প্রকাশনা সংস্থায় চাকরি করতেন। সেখান থেকে বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় বইগুলো একেবারে সাধারণ পাঠক বা কিশোরদের উপযোগী করে নতুন সংস্করণে ছাপা হতো। আর সেসব বইয়ের প্রচ্ছদসহ আরও অন্য ছবি আঁকার দায়িত্ব পড়ত সত্যজিৎ রায়ের ওপর। একদিন সিগনেট প্রেসের প্রধান ডি কে গুপ্ত সত্যজিৎকে ডেকে বলেন, পথের পাঁচালীর কিশোরপাঠ্য সংস্করণ ‘আম আঁটির ভেঁপু’ বের হবে এবং প্রচ্ছদসহ ভেতরের ছবিগুলো তাকে আঁকতে হবে। সত্যজিৎ তখনো পথের পাঁচালী পড়েননি। কাজ বুঝে নিয়ে সত্যজিৎ ৩০০ পৃষ্ঠার মূল বই পড়ে ফেললেন। পড়ে শুধু তিনি অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘অপূর্ব’! তারপরই কাহিনীটা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে।
পাঁচ বছর পর ইতালিয়ান পরিচালক ভিত্তোরি দ্য সিকার বানানো নিও রিয়েলস্টিক ‘লাদ্রি দি বিচিক্লেত্তে’; ইংরেজিতে ‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’ ছবিটি সত্যজিৎ রায় লন্ডনের এক সিনেমা হলে দেখেন। ছবিটি দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে সিনেমা বানানোর স্বপ্নে বিভোর হলেন তিনি। সত্যজিৎ রায় একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন, লন্ডনে ঐ ছবিটি দেখে সিনেমা হল থেকে বের হওয়ার পরপরই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তিনি চলচ্চিত্রকার হবেন এবং প্রথম চলচ্চিত্রটি তৈরি করবেন কালজয়ী উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’ নিয়ে। তারপর সমস্ত আবেগ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সিনেমাতে।
যদিও পথের পাঁচালীর চিত্রনাট্য নিয়ে অনেক তোড়জোড় হয়েছিল! স্ক্রিপ্টটি নিতে আগ্রহী ছিলেন আরও অনেকে। কিন্তু, বিভূতিভূষণের স্ত্রী রমা দেবী সত্যজিৎকেই দিয়েছিলেন পথের পাঁচালীর স্বত্ব। সত্যজিৎ রায় তখন বিজ্ঞাপন অফিসে চাকরি করেন। এই চাকরি করার ফাঁকেই ছুটি নিয়ে তিনি শুটিং করতেন। অধিকাংশ শুটিং হতো ছুটির দিনে বা তিনি অফিস থেকে ছুটি নিলে সেদিন। পয়সাকড়ি তার হাতে বেশি ছিল না। এই ছবি তৈরির কাজ যে আড়াই বছর ধরে চলবে—সেটা শুরুর দিকে তিনি নিজেও ভাবেননি। শেষে যত দিন গড়িয়েছিল, তার মনে একটা ভাবনামিশ্রিত ভয় ঢুকে গিয়েছিল, যদি অপু-দুর্গা এই সময়ের মধ্যে বেশি বড় হয়ে যায়, তাহলে তো সেটা ছবিতে ধরা পড়ে যাবে। কিন্তু এই আড়াই বছরে তাদের দুজনের সেই বয়সে যতটা বাড়ার কথা ছিল, তারা কেউই সেটা বাড়েনি।
শুটিংয়ের শুরুতেই গোলমাল বাধে। অপু-দুর্গাকে শুটিংয়ের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কলকাতা থেকে প্রায় ৭০ মাইল দূরে বর্ধমান জেলার পালসিট বলে একটা জায়গায়। সেখানে রেললাইনের ধারে কাশফুলে ভরা একটা মাঠ ছিল। পথের পাঁচালীর সেই বিখ্যাত ট্রেনের দৃশ্য, অপু-দুর্গার প্রথম ট্রেন দেখার দৃশ্য সেখানে তোলা হবে বলে ঠিক ছিল। দৃশ্যটা বেশ বড়, তাই একদিনে হবে না, অন্তত দুই দিন সময় লাগবে। প্রথম দিন সকাল থেকে শুরু করে বিকাল অবধি কাজ করে প্রায় অর্ধেক দৃশ্য তোলা হয়েছিল। প্রথম দিনের কাজ শেষ করে সবাই ফিরে এলেন। দিন সাতেক পরে আবার সেই একই জায়গায় পৌঁছে সত্যজিৎ রায় চমকে গেলেন? এ তিনি কোথায় এলেন? কারণ মাঠভর্তি কাশবন উধাও! স্থানীয় লোকদের কাছে জিগ্যেস করে তিনি জানতে পেরেছিলেন, কাশফুল গরুর প্রিয় খাদ্য, তাই এই মাঝের সাত দিনে সারা মাঠের কাশফুল গরুতে খেয়ে সাফ করে দিয়েছে! ছবিতে এই দৃশ্যের বাকি অংশ সত্যজিৎ রায় তুলেছিলেন পরের বছর, যখন মাঠ আবার কাশফুলে ভরে গিয়েছিল।
সেবার অবশ্য ট্রেনের শটও নেওয়া হয়েছিল। সত্যজিৎ আগে থেকেই ট্রেনের সময়সূচি দেখে জেনে নিয়েছিলেন যে ঐ লাইনে সকাল থেকে বিকালের মধ্যে কয়টা ট্রেন চলে। তখন কয়লার ইঞ্জিনের সময়। সাদা কাশফুলের পাশে ট্রেনের কালো ধোঁয়া না হলে দৃশ্য জমবে কেন? যে স্টেশন থেকে ট্রেন আসবে সেখানে শুটিং দলের একজন থাকতেন, তিনি সোজা ট্রেনের ড্রাইভারের ইঞ্জিনে উঠে পড়তেন—কারণ গাড়ি শুটিং স্পটের কাছাকাছি এলেই বয়লারে কয়লা দেওয়া দরকার, না হলে কালো ধোঁয়া বেরোবে না যে! আজ এত বছর পরেও যখন বিশ্ব জুড়ে চলচ্চিত্রপ্রেমীরা সত্যজিৎ রায়ের এই ছবিটি দেখেন, তখন তারা কিন্তু ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেন না যে তারা আসলে একটা নয়, তিনটে আলাদা ট্রেন দেখছেন।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় রয়েছে অপু-দুর্গার পোষ্য কুকুর ভুলোর কথা। গ্রাম থেকেই সত্যজিৎ একটা কুকুর জোগাড় করেছিলেন, সেটা তাদের বেশ পোষও মেনে গিয়েছিল। ছবির একটা দৃশ্যে আছে যে, অপুর মা সর্বজয়া অপুকে ভাত খাওয়াচ্ছেন, ভুলো সামনের উঠানে বসে খাওয়া দেখছে। এতটা ছিল একটা শট। পরের শটে ছিল—সর্বজয়া বাকি ভাতটা আস্তাকুঁড়েতে ফেলে দিচ্ছেন, আর ভুলো সেটা খেয়ে নিচ্ছে। কিন্তু দ্বিতীয় এই শটটি সেদিন সত্যজিৎ নিতে পারেননি, দিনের আলো ফুরিয়ে গিয়েছিল আর ফুরিয়ে গিয়েছিল টাকা। মাস ছয়েক পরে টাকার জোগাড় হলে আবার শুটিং করতে যাওয়া হলো গ্রামে। কিন্তু এবারে গিয়ে জানা গেল যে, সেই কুকুর মরে গিয়েছে! এবারে কী হবে? অনেক খোঁজাখুঁজির পরে অবশেষে একই রকমের দেখতে একটা কুকুরের সন্ধান পাওয়া গেল। ধরে আনা হলো সেই কুকুরকে। দেখা গেল, দুই কুকুরের আশ্চর্য মিল, শুধু যে গায়ের রঙে সেটা নয়, এই কুকুরেরও ল্যাজের ডগা সাদা ছিল। শেষ পর্যন্ত এই নকল ভুলোকে দিয়েই সত্যজিৎ রায় তার কাজ শেষ করলেন। ছবিতে কিন্তু বোঝা যায় না যে সত্যজিৎ আসলে দুটো ভিন্ন কুকুর ব্যবহার করেছিলেন।
শুধু কুকুর নয়, মানুষকে নিয়েও সত্যজিৎ বিপদে পড়েছিলেন। চিনিবাস ময়রার কাছ থেকে মিষ্টি কেনার সাধ্য অপু-দুর্গার নেই। এই দৃশ্য তোলার পরেও শুটিং কয়েক মাসের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। টাকার জোগাড় হওয়ার পরে সত্যজিৎ যখন আবার নিজের শুটিং ইউনিট নিয়ে গ্রামে ফিরে আসেন, তত দিনে চিনিবাস ময়রার ভূমিকায় যিনি অভিনয় করেছিলেন তিনি আর এই জগতে নেই। কুকুরে-কুকুরে পার্থক্য না ধরা গেলেও, প্রথম চিনিবাসের সঙ্গে মেলে এমন মানুষ তিনি কোথায় পাবেন? শেষ পর্যন্ত যাকে পাওয়া গিয়েছিল, তার সঙ্গে আগের চিনিবাসের মুখের বিশেষ মিল না থাকলেও চেহারাতে ছিল—ইনিও আগের চিনিবাসের মতন নাদুসনুদুস ছিলেন। ছবি দেখে কারো বোঝার সাধ্য নেই যে ঐ দৃশ্যে দুজন আলাদা চিনিবাস রয়েছেন।
পথের পাঁচালীর আরেকটা আইকনিক দৃশ্য—তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে দুর্গা কুলগাছতলায় তার ভাইয়ের কাছে আশ্রয় নিল, ভাইবোন জড়াজড়ি করে বসে, দুর্গা বিড়বিড় করছে, ‘নেবু পাতা করমচা, হে বৃষ্টি ধরে যা!’। শরত্কালের অসময়ের ঠাণ্ডা বৃষ্টিতে ভিজে অপু-দুর্গার অবস্থা বেশ শোচনীয় হয়েছিল। শেষে শটের পরে দুধের সঙ্গে ব্র্যান্ডি খাইয়ে দুজনের শরীর গরম করতে হয়েছিল।
শুটিংয়ের সময়ে গ্রামের বেশ কিছু বিচিত্র লোকও তিনি পেয়েছিলেন। একজন বয়স্ক ব্যক্তি ফিল্মের লোক দেখলে চিৎকার শুরু করতেন—‘ফিল্মের দল এয়েচে—বল্লম নিয়ে লাফিয়ে পড়!’ পরে সত্যজিৎ জানতে পেরেছিলেন যে সেই ভদ্রলোকের মাথায় একটু গোলমাল ছিল। পরে অবশ্য এই ভদ্রলোক সত্যজিৎকে তার বাড়ির দাওয়ায় বসিয়ে বেহালায় যাত্রার গান বাজিয়ে শোনাতেন।
যে বাড়িটা সত্যজিৎ পেয়েছিলেন, সেটা ছিল জীর্ণ ও জঙ্গলে ভর্তি। বাড়ির মালিক কলকাতায় থাকতেন। বাড়িটাকে সংস্কার করে ব্যবহার করার উপযোগী করে তুলতে সত্যজিৎ রায়ের প্রায় এক মাস লেগেছিল। বাড়ির একটা অংশে সারবাঁধা অনেকগুলো ঘর ছিল, যেগুলো ছবিতে দেখা যায় না। সেগুলোতে শুটিং ইউনিটের মালপত্র রাখা হতো। আরেকটা ঘরে সাউন্ড রেকর্ডিংয়ের যন্ত্রসমেত বসতেন সাউন্ড রেকর্ডিস্ট ভূপেনবাবু। তাকে দেখতে না পেলেও সত্যজিৎ তার গলা পেতেন। কারণ তিনি সাউন্ড রেকর্ড করতেন ঘরের ভেতরে বসে। প্রতি শটের পরে সত্যজিৎ হাঁক পাড়তেন, ‘সাউন্ড ঠিক আছে তো?’ ভূপেনবাবু জবাবে হ্যাঁ কি না জানিয়ে দিতেন। একদিন হাঁক পেড়েও সত্যজিৎ তার কোনো উত্তর পেলেন না। সত্যজিৎ ঘরে ঢুকে দেখেন, একটা বিরাট বড় গোখরো সাপ সেই ঘরের পিছনের জানালা দিয়ে ঘরের মেঝেতে নামছে, আর সেই বিশালাকৃতির সাপের ভয়েই ভূপেনবাবুর কথা বন্ধ হয়ে গেছে!
‘পথের পাঁচালী’ মুক্তির পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি নির্মাতা সত্যজিৎ রায়কে। চলচ্চিত্রটির নব্য বাস্তববোধ দর্শক ও সমালোচকদের হতবাক করেছিল। অসংখ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে মনোনীত হয়েছিল ‘পথের পাঁচালী’। যে তরুণ নির্মাতা একটি স্বপ্ন পূরণের জন্য বিত্তবানদের কাছে ঘুরেছেন, ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তির পর দেখা গেল তার পেছনে ছুটেছে ভারতের সবচেয়ে নামীদামী প্রযোজক সংস্থাও। সিনেমা নির্মাণের জন্য পরবর্তীকালে আর অর্থকষ্টে পড়তে হয়নি। সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব ফিল্ম ক্রিটিক্স-এর তরফ থেকে সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’কে সর্বকালের সেরা ভারতীয় ছবির খেতাব দেওয়া হয়েছে।
তথ্যসূত্র: সত্যজিৎ রায় রচিত ‘একেই বলে শুটিং’, এবং বাবলু ভট্টাচার্য রচিত ‘সত্যজিৎ রায়’।