সব জল্পনা -কল্পনার অবসান ঘটিয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন টেবিল ঘড়ি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন। সুষ্ঠু ভোটে চমক দেখিয়েছে টেবিল ঘড়ি। রাত পৌন ২টায় বেসরকারিভাবে নির্বাচন কমিশন ঘোষিত সবকয়টি (৪৮০টি কেন্দ্র) কেন্দ্রের ফলাফলে ঘড়ি প্রতীক পেয়েছে ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট। প্রতিদ্বন্দ্বি আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের আজমতউল্লা খান পেয়েছেন ২ লাখ ২২ হাজার ৭৩৭ ভোট। জায়েদা খাতুনের কাছে ১৬ হাজার ১৯৭ ভোটে হেরেছেন আজমতউল্লা।
ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভোট পড়ে ৪৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন ভোটারের মধ্যে প্রদত্ত ভোট ৫ লাখ ৭৫ হাজার ৫০ ভোট। তবে ইভিএমের ভোটের ফলাফল ঘোষণা করতে সময় লেগেছে প্রায় সাড়ে ৯ ঘন্টা।
ফলাফল ঘোষণার পর তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মেয়র পদে বিজয়ী জায়েদা খাতুনের পক্ষে তার ছেলে গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বলেন, নির্বাচনের এই ফলাফলে মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। সুষ্ঠু ভোটের জন্য প্রধানমন্ত্রী ও নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ। সবার প্রচেষ্টায় গাজীপুর সিটি করপোরেশনকে আধুনিক ও স্মার্ট সিটিতে রুপান্তরিত করব। সার্বক্ষণিক নাগরিক সেবায় নিয়োজিত থাকব। সবাইকে নিয়ে কাজ করব। এই সিটি করপোরেশনকে এগিয়ে নিতে সকলের কাছে মায়ের জন্য সহযোগিতা চান জাহাঙ্গীর।
গাজীপুর জেলা পরিষদের ভবনের বঙ্গতাজ মিলনায়তনে নির্বাচনের ‘ফলাফল সংগ্রহ ও পরিবেশন কেন্দ্র’ থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম এ ঘোষণা দেন। ফলাফল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে অধীন আগ্রহে ছিলেন দেশবাসী। গাজীপুরের ‘ফলাফল সংগ্রহ ও পরিবেশন কেন্দ্রে’ টানটান উত্তেজনা তৈরি হয়। তবে ফলাফল ঘোষণায় ধীরগতি হওয়ায় ঘড়ি প্রতীকের কর্মী-সমর্থকদের পক্ষ থেকে ফলাফল পাল্টানোর অভিযোগ করা হয়। চূড়ান্ত ফল ঘোষণার পর নৌকা প্রতীকের শিবিরে হতাশা নেমে আসে। উল্লাসে মেতে উঠেন ঘড়ি প্রতীকের সমর্থকরা। গাজীপুরে নৌকার পরাজয়ের কারণ হিসাবে অনেকেই মনে করছেন, নৌকার ব্যাজ পরিধান করে ঘড়ি প্রতীকে ভোট দিয়েছেন আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের একাংশ। এছাড়াও নির্বাচন বর্জন করা বিএনপি -জামায়াতের অধিকাংশ ভোট পেয়েছেন জায়েদা খাতুন।
নির্বাচনের ৮জন মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। অন্যদের প্রাপ্ত ভোট: লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টি-জাপার প্রার্থী এম এম নিয়াজ উদ্দিন (১৬৩৬২), হাতপাখা প্রতীকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের গাজী আতাউর রহমান (৪৫৩৫২), গোলাপ ফুল প্রতীকে জাকের পার্টির মো. রাজু আহাম্মেদ (৭২০৬), মাছ প্রতীকে গণফ্রন্টের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম (১৬৯৭৪)। এ ছাড়া স্বতন্ত্র থেকে মেয়র পদে ঘোড়া প্রতীকে মো. হারুন-অর-রশীদ (২৪২৬) ও হাতি প্রতীকে সরকার শাহনূর ইসলাম (২৩২৬৫) ভোট।
গাজীপুর সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে ভোটগ্রহণ চলাকালে প্রথম দিকে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস পাওয়া যায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘড়ি এবং নৌকার পক্ষে অভিনন্দনের জোয়ার বয়ে যায়। চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার আগে নিশ্চিত হওয়া যায়নি কে হচ্ছেন পরবর্তী গাজীপুর সিটির মেয়র। এজন্য ভোটের ফলাফল নিয়ে সকলের মাঝে ব্যাপক আগ্রহ-উদ্দীপনা তৈরি হয়। তবে সন্ধ্যার পর থেকে ফলাফল ঘোষণায় ব্যাপক ধীরগতি লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত ফলাফল নিয়ে জায়েদা খাতুন এবং আজমত উল্লা খানের শিবিরের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়। উভয় পক্ষ থেকে বিজয়ী হওয়ার আনন্দ উল্লাস করে কর্মী-সমর্থকরা।
ইসির ফলাফল ঘোষণা ধীরগতি নিয়ে রাতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। ফলাফল ঘোষণার মঞ্চে ছুটে এসে সাংবাদিকদের কাছে সংশয় প্রকাশ করে জাহাঙ্গীর বলেন, দিনের ভোটের ফল দিনেই চান। রাত যত গভীর হচ্ছে ফলাফল নিয়ে ততই সন্দেহ বাড়ছে। তিনি বলেন, কেন্দ্র ঘোষিত ফলাফলে আমার মা বিজয়ী হয়েছেন। ফলাফল ঘোষণার আগে জয়-পরাজয় যাই হোক ফলাফল মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেন পরাজিত প্রার্থী আওয়ামী লীগের প্রাথী আজমতউল্লা খান।
এ যাবৎ অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মধ্যে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন সবচেয়ে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ভোটগ্রহণ চলে। গাজীপুর সিটির ভোট সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে সর্বোচ্চ প্রস্তুত গ্রহণ করেছিলো নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ভোটগ্রহণ শেষে সুষ্ঠু ভোট হওয়ায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর। গতকাল সকাল থেকেই ভোটকেন্দ্রগুলোয় ভোটারদের উপস্থিতি দেখা গেছে। প্রার্থীরাও কেউ ভোট গ্রহণের অনিয়ম নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলেননি। কিছু কিছু কেন্দ্রে ইভিএমে ধীরগতি ও জটিলতা ছিল বলে অভিযোগ করেছেন ভোটাররা। নির্বাচনে ভোট গ্রহণের সময় গোপন বুথে প্রবশের দায়ে দুজনকে আটক করা হয়। নির্বাচন ভবন থেকে সিসিটিভি ক্যামেরায় ভোট দেখার পর এই অনিয়ম চোখে পড়ে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের। তারা বিষয়টি দেখার পর দুজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা দেয়ার নির্দেশ দেন। এরপর একজনকে আটক এবং অন্যজনকে তিন দিনের জেল দেয়া হয়েছে। যারা ভোটকেন্দ্রে ভেতরে চারটার আগে ঢুকেছেন কিন্তু ভোট গ্রহণ বাকি, তাদের ভোট নেয়া হয়।
গাজীপুর সিটিতে মোট ভোটার ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন। তাদের মধ্যে ৫ লাখ ৯২ হাজার ৭৬২ জন পুরুষ, ৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৬ জন নারী ও ১৮ জন হিজড়া। এই সিটিতে ৫৭টি সাধারণ ও ১৯টি সংরক্ষিত ওয়ার্ড আছে। মোট ভোটকেন্দ্র ৪৮০টি, মোট ভোটকক্ষ ৩ হাজার ৪৯৭টি। গাজীপুর সিটির ৪৮০টি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে ৩৫১টি গুরুত্বপূর্ণ (ঝুঁকিপূর্ণ) কেন্দ্র। এজন্য অতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়। এ নির্বাচনে ৪৮০ জন প্রিজাইডিং কর্মকর্তা, ৩ হাজার ৪৯৭ জন সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা এবং ৬ হাজার ৯৯৪ জন পোলিং কর্মকর্তাসহ ১০ হাজার ৯৭১ জন ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তা ছিলেন। নির্বাচনে মেয়র পদে ৮, সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ৭৯ এবং সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২৪৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণ উপলক্ষে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন বিভাগের ১৩হাজার সদস্য নিয়োজিত ছিলেন।