বাংলা গান ও চলচ্চিত্রের এক জীবন্ত কিংবদন্তির নাম গাজী মাজহারুল আনোয়ার। ২০ হাজারেরও বেশি গানের স্রষ্টা তিনি। বাংলা গানের সর্বকালের সেরা গীতিকারদের একজন। শুধু গীতিকারই যে তিনি তা কিন্তু নন। তিনি একাধারে চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, রচয়িতা, গীতিকার ও সুরকার। বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকেও টেলিভিশনের জন্য গান লিখে গেছেন। বিবিসি বাংলা তৈরিকৃত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিশটি বাংলা গানের তালিকায় রয়েছে তার লেখা তিনটি গান। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল অ্যাওয়াার্ড লাভ করেন। চলচ্চিত্রে নানা ভূমিকার জন্য তিনি পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও ২০০২ সালে স্বাধীনতা ও দেশপ্রেম নিয়ে অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা গাজী মাজহারুল আনোয়ার বাংলাদেশের একুশে পদক লাভ করেন। রোববার না ফেরার দেশে চলে গেলেন তিনি। সকাল ৭টার দিকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার। ২০২১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সমকাল অনলাইনে প্রকাশিত হয় তার দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। যেখানে জীবনের নানা বিষয়ে কথা বলেছিলেন তিনি। তার চলে যাওয়ার দিনে সেই আলাপের কিয়দংশ ফের তুলে ধরা হলো
২০ হাজারেরও বেশি গানের রচয়িতা আপনি। প্রকাশ করছেন ৫০ গানের পেছনের গল্প। গান নিয়ে বই প্রকাশ কি চলমান থাকবে?
এসব আমার সন্তানদের উদ্যোগ। তারা উদ্যোগি হয়েই বাবার সৃষ্টিকর্মকে যতটা সংরক্ষণ করা যায় সে চেষ্টা করছে। আমার লেখা অনেক গান অন্যের নামে দেখেছে তারা। বই প্রকাশ বলা যায় আমার গান সংরক্ষণের একটা প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যবহার করছে । একই সঙ্গে জনপ্রিয় সব গানের পেছনের গল্পও পাঠকদের জানানোর একটা উদ্যোগ। আমার সন্তানরা বলছে এ ধারা চলমান থাকবে। আমি তো জীবন সায়াহ্নে এসে পড়েছি। আর জীবনে আর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। এখনও নিয়মিত লিখে যাচ্ছি আমি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখে যেতে চাই।
আপনার এই যে এতো সৃষ্টিকর্ম এর পেছনে পরিবারের ভূমিকা কতটা?
আমি অনেক সুখি একজন মানুষ। আমার মতো এই বয়সে এসে খুব কম মানুষই এমন সুখে থাকতে পারে। জীবনে কোনো অপূর্ণতা নেই আমার। আল্লাহ তা’লা উত্তম একটা পরিবার আমাকে দিয়েছেন। আমার এক ছেলে এবং এক মেয়ে। এখন যুক্ত হয়েছে ছেলের বউ। সবাই আমার সৃষ্টির মূল্যটা বুঝে। কিভাবে বাবা আরও ভালো থাকতে পারে সে দিকে সর্বদা সজাগ তারা। আর আমার স্ত্রীর আমার প্রতি আমার পরিবারের প্রতি তার অবদান বলে শেষ করা যাবে না। ও আমার জন্য সেরা উপহারই বলতে পারি। বাকি জীবনে আমার স্ত্রীর সহায়তা ছিলো বলেই এতো এতো সৃষ্টিকর্ম করা সম্ভব হয়েছে। ও সর্বদা আমার লেখালেখির পরিবেশ করে দিয়েছে। কখনও লেখালেখির প্রতিকূল কিছু হয়নি। পরিবারের ভালোবাসা না পেলে বিশ্ববাসীর ভালোবাসা কিভাবে পেতাম না।
আপনি দেশবাসির কাছে অতিমূল্যবান একজন মানুষ। যদি জানতে চাই নিজেকে নিজে কতটা মূল্যবান মনে করেন?
পৃথবীতে এমন কোন শিক্ষিত দেশ নেই যারা আমাকে পুরস্কার দেয়নি। আমাদের শত্রুরাষ্ট্র পাকিস্তানও আমাকে পুরস্কার দিতে বাধ্য হয়েছে। আমার সৃষ্টিকর্মই তাদের কাছ থেকে পুরস্কার এনে দিয়েছে। এসবের চেয়ে আমার মূল ভালো লাগার বিষয় হচ্ছে সবার ভালোবাসা। এই ভালোবাসাই আমার সবচেয়ে আনন্দদায়ক বিষয়। রাসুল সা. বলেছেন, যিনি নিজেকে মূলব্যান ভাবেন তিনি আসলে মূল্যবান নন। যাদের কাছে মূল্যবান হোন তারা যদি মূল্যদেয় তাহলে সে মূল্যবান। আপনাদের কাছে মূল্যবান হয়ে উঠেছি। তার মানে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য হয়তো আমি কিছু করেছি। এই জন্য সবাই আমাকে মূল্যবান মনে করে পুরস্কারগুলো দিচ্ছে।
আপনার জীবনে কোনো অপ্রাপ্তি আছে কী?
প্রাপ্তি আমার প্রয়োজন নেই, আমি তৃপ্তি নিয়েই চির বিদায় নিতে চাই। আমার এতো বছর বয়স। এ বয়সেও লিখে যাচ্ছি। নতুনদের জন্য লিখছি। একটা চাওয়া রয়েছে- মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যেনো আমার হাতে লেখার কলমটা থাকে। আমৃত্যু গানের সঙ্গে থাকতে পারছি এটাকেই আমি জীবনের বা ক্যারিয়ারের জন্য সেরা স্বীকৃতি হিসেবে দেখি। এখনো তো গান লিখছি। সবার ভালোবাসায় কয়েক প্রজন্ম পেরিয়েও নতুন প্রজন্মের সঙ্গে লিখে যেতে পারছি। আমি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছি একাধিকবার, একুশে পদক দিয়েছে রাষ্ট্র। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য দেশের সর্বপ্রথম পুরস্কার বাংলাদেশ প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি সেই ১৯৭২ সালে। দেশ-বিদেশে বহু পুরস্কার পেয়েছি। ভারত থেকেই প্রায় এক ডজন অ্যাওয়ার্ড আছে। আমার বারিধারার এই ঘর (বারিধারায়) ও মালিবাগের আরেকটা বাড়ি আছে সেখানে এক ঘর ভর্তি রয়েছে নানা রকম পুরস্কার আর স্বীকৃতি-সম্মাননায়। যদিও আমি কখনোই পুরস্কারের জন্য কাজ করিনি। আমার ধারণা কেউ করে না। এগুলো অনুপ্রেরণা হয়ে থাকে মাত্র। দেশ ও মানুষের জন্য কাজ করার চেষ্টা করেছি। এটাই বড় আনন্দ। স্বীকৃতির জন্য নীতি বা মূল্যবোধ বিসর্জন দেইনি কখনো। তাহলে অনেক বড় বড় সুযোগ জীবনে এসেছে, সেগুলো মিস করতে হতো না।
দেশের সংস্কৃতির স্বর্ণযুগের মধ্য দিয়ে এসেছেন আপনারা। সে হিসেবে দেশের এখনকার সংস্কৃতির বেহাল অবস্থা দেখে কেমন লাগে?
আমাকে এতো এতো পুরস্কার দিয়েছে, কেনো দিয়েছে এসব? এই পুরস্কারের পেছনে অবশ্যই আমাদের সৃষ্টির শক্তিটা বড় ছিলো। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এটা বড় মনে হয়েছে বলেই তারা পুরস্কৃত করেছে। এরফলে বাংলাদেশের সংস্কৃতিটাও বিশ্ব দরবারে বড়মাপের সংস্কৃতি বলে প্রমানীত হয়েছে। সেই সংস্কৃতি, সেই চলচ্চিত্র এখন আমাদের নেই কেনো? এই প্রশ্নটা নিয়ে যুদ্ধ গণমাধ্যমকর্মীদের করতে হবে। উত্তর বের করে সবাইকে জানাতে হবে। বিশ্বকে যেভাবে আমরা আগে জানতে পারতাম তার চেয়ে হাজার হাজার গুণ সহজে এখন জানা যায়। রুমে বসেই পৃথিবীর সব জানা যায়। তার পরও আমাদের এই সংস্কৃতির এ দৈন্যতা কেনো? এই কেনোর উত্তর বের করে সমাধানের পথে হাটতে হবে আমাদের।
স্বাধীনতার এতো বছর হলো। এই সময়ে দেশ নিয়ে, দেশের মানুষ নিয়ে কোন আক্ষেপ কাজ করে?
কি কারণে স্বাধীনতার এতো বছর পরও আমাদের দেশে ভালোবাসা, হৃদ্যতায় ভরে উঠলো না ? এখনও কেনো আমরা কেনো দলীয় পরিচয়ে পরিচিত হতে চাই। আমরা কেনো সার্বিকভাবে বাংলাদেশের লোক হিসেবে পরিচিত হতে চাই না। যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন- এতো বড় ইতিহাস পৃথিবীর অন্য কোন দেশ পায়নি। বঙ্গবন্ধু যখন ডাক দিয়ে বলেছিলেন এবারে সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। সেখানে আমি বোধহয় প্রথম লোক যে ঘোষণা দিয়ে বলেছিলাম জয় বাংলা, বাংলার জয়। তার পর আমার মনে একটা প্রশ্ন জেগেছিলো কি কারণে স্বাধীনতা জরুরী হয়ে উঠেছিলো। এটার ব্যাখা না দিলে জনসাধারণ হয়তো স্বাধীনতার অর্থ নাও বুঝতে পারেন। স্বাধীনতার অর্থ কি একটা পোশাক, না টাকা? তাই এমন ৩১টি বিষয় সামনে এনে নতুন গান রচনা করি-বাংলা প্রতিঘর ভরে দিতে চাই মোরা অন্নে…
সেই সময়েও গান হয়েছে এই সময়েও হচ্ছে। এখন যে গান তৈরি হচ্ছে এসব নিয়ে আপনার মন্তব্য কি?
অবাক হই গানে এখন দেয়ালে হিসু করার বিষয়গুলোও লেখা হচ্ছে। গানের কথা তো এমন হতে পারে না। প্রেম, রোমান্স বা যাপিত জীবনের সবকিছুতেই একটা সৌন্দর্য আছে। সেই সৌন্দর্যের প্রকাশ কিন্তু সবাই কলম দিয়ে করতে পারেনা। যারা পারে তারাই লেখক। দেয়ালে হিসু করা নিয়ে যদি গান বানানো হয় আর সেটা প্রকাশও হয় তাহলে সংস্কৃতির সৌন্দর্যটা আঘাতপ্রাপ্ত হয়। আমাদের গান, নাটক, সিনেমা, সাহিত্য যা কিছু সংস্কৃতি প্রায় সবখানেই সৌন্দর্য হারিয়ে গেছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলতেন, গানকে পরিবারের মধ্যে আনতে হবে। কারণ গান পরিবার থেকে বিচ্যুত হলে তার আয়ু খুব কম। বা এভাবেও বলা যায়, যে গান পরিবারের মধ্যে বেঁচে থাকে সেই গানই কালজয়ী হয়। এজন্যই নজরুল-রবীন্দ্রনাথের গান কালজয়ী। কারণ তাদের গান পরিবার থেকে সারাদেশে ছড়াতো। যেমন একটা সময় ছিলো যখন যে বাড়িতে গ্রামোফোন থাকতো সে বাড়ির বউয়েরা সপ্তাহে একদিন পাশের বাড়ির বউদের নিয়ে আয়োজন করে গান শুনতেন। যেসব গান পরিবারের মধ্যে সম্মান পেয়েছে সেগুলোই জনপ্রিয় হয়েছে।
তাহলে এই সময়ে যারা গান লিখছেন, গান তৈরি করছেন তাদের প্রতি আপনার পরামর্শ কি?
আমি মনে করি এখনকার অনেকেই শিল্পচর্চায় জড়িত কিন্তু শিল্পটাই নিজের ভেতর ধারণ করতে পারছে না। শেখার ও জানার পরিধি কম বলেই এমনটি হয় হয়তো। শিখতে হবে- গান বাজনা, আচরণ, সব। শেখার জন্য কোনো আপোষ করা যাবে না। দেখুন, মহানবী (স.) বলে গেছেন, ‘তোমরা শেখার জন্য প্রয়োজনে চীন দেশে যাও।’ একথাটা তিনি কেন বলেছেন? কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তার দেশে শেখার মতো যথেষ্ট তেমন কিছু নেই যা তার জাতিকে জ্ঞানে বুদ্ধিতে শ্রেষ্ট করে তুলবে। সে সময় চীনের সভ্যতা ছিলো বিখ্যাত। মানে হলো যেখানে সঠিক শিক্ষা পাওয়া যাবে সেখানে যেতে হবে। শিখতে হবে। না শিখে ভালো কিছুর আশা করা বোকামি।
এবার জানতে চাইবো ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটি কিভাবে মাথায় এলো?
১৯৭০ সালের ৭ মার্চ, রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিলেন। দেশের মানুষ ঝাপিয়ে পড়লো স্বাধীনতার অর্জনের জন্য। বঙ্গবন্ধু ভাষণ শেষ করলেন ‘জয় বাংলা’ দিয়ে। সেই জয় বাংলার বারুদ দেশের আনাছে কানাছে ছড়িয়ে গেলো। যেদিন ভাষণ দিলেন সেদিনের সন্ধ্যায় ফার্মগেটে একটি স্টুডিওতে আমি বসে আছি। সেখানে ছিলেন সালাহউদ্দিন স্যার। আমার স্কুলের স্যারও তিনি। বললেন, ‘জয় বাংলা’ নিয়ে একটা কাজ করতে পারো। এই মুহূর্তে এটা প্রচার করা খুব জরুরি। আমি ভাবতে থাকলাম ‘জয় বাংলা’ নিয়ে কি লেখা যায়। ভাবতে ভাবতে দেখলাম দ্রুতই গান দাঁড়িয়ে গেল। আনোয়ার পারভেজকে ফোন করে বললাম স্টুডিওতে আসতে। সঙ্গে যেন শাহিনকেও (সংগীতশিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ) নিয়ে আসে। আব্দুল জব্বারকেও আসতে বললাম। এদিকে হঠাৎ ঢুকলেন আলতাফ মাহমুদ। তিনি দেখলেন আমি লিখছি। কাগজটা নিয়েই বললেন, ‘বাহ, দারুণ হয়েছে তো। দে সুর করি।’ কাগজটা নিয়ে হারমোনি টান দিয়ে বসেই সুর করে ফেললেন। পরে আনোয়ার পারভেজ এলো, আলাউদ্দিন আলী এলো, জব্বার, শাহিন। সবাই মিলে গানটি তৈরি করলেনন। এর সুর-সংগীত করলো আনোয়ার পারভেজ। শাহিন আর জব্বার গাইলো। সঙ্গে আরও অনেক শিল্পী ছিলেন। গান তৈরি করে বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে গেলাম। তিনি শুনে খুব পছন্দ করলেন। বললেন এই গান দিয়েই যাত্রা করবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। পরে তো রাতারাতি ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ এর জয়জয়কার।
আর সিনেমার গানের যাত্রা?
আমার ওস্তাদ সত্য সাহা। তার স্নেহ-ভালোবাসা আমার জীবনের জন্য আশির্বাদ হয়ে এসেছে। তার হাত ধরেই সিনেমায় গান লেখা শুরু। মুক্তিযুদ্ধের আগে আগে। আমাকে নিয়ে গেলেন সুভাষ দত্তের কাছে। বললেন আপনার নতুন ছবিতে এ ছেলে গান লিখবে। সুভাষ দত্ত আমার দিকে তাকিয়ে দেখলেন, অল্প বয়স। ভালো করে গোফই উঠেনি। তিনি বিরক্ত হলেন। সত্য সাহার জন্য কিছু বলতেও পারলেন না। গানের প্লটটা বুঝিয়ে দিয়ে তার রুমে গিয়ে বসলেন সুভাস দত্ত। স্টুডিওতে আমি আর সত্য দা চেষ্টা করে যাচ্ছি নতুন একটি প্রেমের গান তৈরির। উনি বললেন, একদম টেনশান করবি না। তুই পারবি। জাস্ট সিচুয়েশনটা কল্পনা করে দেখ মনে কি আসে। ব্যস, লিখলাম প্রথম লাইন, ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’। সেটাই সুরে তুললেন সত্য দা। আরও কয়েক লাইন লিখলাম। গুণগুণিয়ে তখন গানটি করছিলাম আমরা। সেটা শুনে আমাদের কাছে এসে সুভাষ দা বললেন দেখি কি করলি? গান শুনে তিনি বললেন, দারুন হয়েছে তো। শেষ কর গানটা। এভাবেই সিনেমার গানের যাত্রা হলো।
গীতিকারের বর্ণিল ক্যারিয়ারের মাঝেই সিনমা নির্মাণ ও প্রযোজনায় এসেছিলেন কি মনে করে?
গান লিখতে লিখতেই সিনেমায় আসা। প্রথম নির্মাণ করলাম ‘নান্টু ঘটক’ সিনেমাটি। পওে ৪১টির মতো সিনেমা নির্মাণ করেছি আমি। সবগুলোই ব্যবসা সফল ছবি। আর প্রযোজনয আসা হুট করেই। একটা সময় মাথায় ভূত চাপে সিনমা প্রযোজনা করবো। যেই ভাবা সেই কাজ। অথচ আমার হাতে কোন টাকা নেই। শূন্য হাতে সিনেমায় প্রযোজনায় নামলাম। সে সময় নায়ক রাজরাজ্জাকের সঙ্গে দারুণ সখ্যতা হয় আমার। ধীরে ধীরে বন্ধুত্বও গড়ে। চলচ্চিত্রে যদি কেউ আমার বন্ধু থেকে থাকে সে হচ্ছে রাজ্জাক। আমি প্রায় ৪৩টি ছবি প্রযোজনা করেছি, তার প্রায় সবগুলোতেই রাজ্জাক অভিনয় করেছেন। কত বিপদ আপদের বন্ধু সে আমার। ওর মতো বন্ধু থাকলে আড্ডার জন্য তৃতীয় ব্যক্তি খোঁজা লাগে না। একাই জমিয়ে রাখতে পারতো। সে সময় সন্ধি নামের একটা ছবি প্রযোজনা করবো আমি। ঠিক হলো রাজ্জাক-কবরি কাজ করবেন। কিন্তু কবরি করলেন না। ঘটনা শুনে নায়ক রাজ্জাকও বিরক্ত হলেন। তিনি বলে দিলেন, ‘দেখ গাজী, এই ছবিতে বড় তারকাকেই নিতে হবে। প্রয়োজনে আমি পারিশ্রমিকে ছাড় দেবো। তুই ব্যবস্থা কর যেমনে পারিস।’ বিষয়টা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেল। অনেক ভেবে চিন্তে বলিউডের বিখ্যাত গীতিকবি জাভেদ আকতারকে ফোন করলাম। তার স্ত্রী শাবানা আজমিকে কাস্ট করার জন্য। মোটামুটি সব ঠিক হলো। কিন্তু সেখানেও জটিলতা দেখা দিলো। পরে সত্য সাহা ঘটনা শুনে পরামর্শ দিলেন শবনমকে নেয়ার জন্য। ‘উনার নাম মাথাতেই ছিলো না। সত্য দা মনে করিয়ে দিলেন। আমি যেন আকাশ ধরে ফেললাম হাতে। যেভাবেই হোক শবনমকে নিয়েই কাজটি করবো ঠিক করলাম। তিনি পাকিস্তান পিরিয়ড থেকেই তুমুল জনপ্রিয় নায়িকা। তার স্বামী রবিন ঘোষের সঙ্গে আমি কাজ করেছি। খুব ভালো পরিচয়। কথা বললাম। তিনি শবনমের নাম্বার দিলেন, তাকে বলেও দিলেন আমার কথা। শবনম তখন লন্ডনে। ফোনে কথা হলো। তিনি সম্পতি দিলেন। বড় নায়িকাই পেয়ে গেলাম আমরা। আর একজনকে নিলাম তিনি সূচরিতা। তিনি তখন এফডিসিতে এক্সট্রা আর্টিস্ট হিসেব কাজ করতো। একদিন আমার সামনে দিয়ে যাচ্ছে কি মনে করে তাকে বললাম নায়িকা হবি? সে তো আকাশ থেকে পড়ল! পরে মেকাপম্যানকে বললাম তাকে নায়িকা বানিয়ে দে। সে যখন মেকাপ করে সামনে এলো আমি দেখে অবাক হলাম।
সিনেমার কি সুদিন গেছে তখন। এখনকার চলচ্চিত্র ইন্ডাষ্ট্রি এমন হলো কেনো?
কি ইন্ডাস্ট্রি কি হয়ে গেল! কলকাতা এখন ভালো করছে। আমরা কেন পারছি না? আমাদের কি মেধা নেই? আমি মনে করি সব আছে। শুধু সমন্বয় নেই, প্রেজেন্টেশন নেই সঠিকভাবে। আসলে কিছুই ঠিক নেই। যেখানে যার থাকার দরকার সে সেখানে নেই। অনেকে বলে কেন প্রযোজনা করি না। কোথায় করবো? কি বানাবো? কাদের নিয়ে? সে ছবি চালাবো কোথায়। জানিনা উত্তরণ হবে কী করে। তবে হবে তো বৈকি। আশায় আছি।
ডাক্তারি পড়ছিলেন আপনি। সেটা ছেড়ে দিয়ে শোবিজে আসার গল্পটা জানতে চাই?
সব পিতা-মাতাই প্রত্যাশা করে ছেলে বড় হবে, নাম করবে। আমার বাবা ও মা-ও সেটা করতেন। সন্তান নিয়ে এটুকু বাবা-মায়ের অধিকার। তবে তাই বলে ছেলের স্বাধীন জীবনে তারা খুব একটা হস্তক্ষেপ করেননি। আমার বাবা আইনজীবী। তিনি চাইতেন ছেলে ডাক্তার হবে। কলেজ শেষ করে ছেলে ভর্তিও হলাম ঢাকা মেডিকেলে। কিন্তু ওষুধের গন্ধ, মরে পঁচে গলে পড়ে থাকা লাশের গন্ধ, হাসপাতালের দিনযাপন সহ্য করতে পারছিলাম না আমি । সিদ্ধান্ত নিলাম ডাক্তারি ছেড়ে দেবো। সুন্দরী ক্লাসমেট অবাক হলো। সে সাহস দিলো, বললো সবরকম সহযোগিতা করবে। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। ওই সুন্দরী সহপাঠিনী হয়তো প্রেমে পেেড়ছিলেন। তবে সেই প্রেম ডাক্তারি পড়ার সাহস দিতে পারেনি। অগ্যতা ‘বিদায় জিন্দাবাদ’ বলে দিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজকে। বাবার কানে যেতেই বাবা বড় বিষাদ-বেদনা নিয়ে বললেন, ‘ইউ আর মাই লস্ট গেম’। ‘প্রথমত বাবা মানতে পারেননি আমি ডাক্তারি ছেড়ে দিয়েছি। তারপর যখন শুনলেন আমি গান লিখে বেড়াচ্ছি খুব হতাশ হয়ে গেলেন। ধরেই নিলেন ছেলের গতি আর হবে না। বড় দুঃখ নিয়ে তিনি আমাকে চিঠিতে লিখেছিলেন, আমি তার হারিয়ে যাওয়া নাম। তবে সেই কথায় তিনি অটল থাকতে পারেননি। যখন বেশ নাম ডাক হলো একদিন ডাকলেন। কাছে যেতেই বুকে জড়িয়ে নিলেন। বললেন, ‘তুমি কখনোই আমার হারিয়ে ফেলা ছেলে নও।’ সেদিন খুব আনন্দ হয়েছিলো।
আপনার সিনেমায় বড় করে প্রযোজক হিসেবে লেখা থাকে আপনার স্ত্রী জোহরা গাজীর নাম। আপনাদের সম্পর্ক শুরুর গল্প কেমন?
১৯৭২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বও আমাদের বিয়ে হয়। জোহরা বিটিভির সংবাদ পাঠিকা, মহিলাবিষয়ক সংস্কৃতি অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টসের রানিং আইটেম চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। বিয়ের পর সব ছেড়ে সে মন দেয় সংসারে। কারণ, স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ব্যস্ত হয়ে পড়লে ভোগান্তির শিকার হবে সংসার-সন্তান। কীভাবে বললে বলা হবে জানি না, তবে আমার স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই এই আমি আজকের যে মানুষটা, এত নাম, সুনাম আর আলোচনা- সবকিছুর পেছনে আমার স্ত্রীই আসল শিল্পী। সে নিজের ক্যারিয়ার স্যাক্রিফাইস করে আমাকে সবরকম চিন্তা থেকে, ব্যস্ততা থেকে মুক্তি দিয়ে সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে থাকার সুযোগ করে দিয়েছে। সংসার সামলেছে, সন্তান মানুষ করেছে। আমাদের আগে কোন পরিচয় ছিলো না। পুরোপুরি পারিবারিক প্রস্তাবে বিয়ে।