আদব শব্দটি আরবি, যা একইভাবে উর্দু ও ফারসি ভাষায়ও ব্যবহৃত হয়। ইংরেজিতে বলা হয়, Best Behavior। বাংলা ভাষায় যার অর্থ হলো, বিনয়, নম্রতা, ভদ্রতা, সভ্যতা, কৃষ্টি, সুশিক্ষা, নৈতিকতা, মানবিকতা, শোভনতা। এক কথায় বলা হয়, শিষ্টাচার। আভিধানিক অর্থে রুচিপূর্ণ ভদ্র ব্যবহারই শিষ্টাচার। শিষ্টাচার ও সৌজন্য উভয় শব্দ সমার্থক হলেও দুয়ের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য বিদ্যমান। শিষ্টাচারে সবাই মুগ্ধ হন, সৌজন্য বাইরের ব্যবহার। ভদ্রতার সামাজিক রীতিনীতির সৌন্দর্যের বিকশিত মহিমা। উত্তম চরিত্রের বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ ঘটানোকে আদব বলে। সুন্দর আচরণ বা ব্যবহারই আদব বা শিষ্টাচার। কাজকর্মে, চলন-বলনে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আদব কায়দা মেনে চলা, ভদ্র ব্যবহার ও সৌজন্যবোধ দেখানো মূলত শিষ্টাচার। এজন্য রাজা সলোমন বলেছেন, ‘অহংকার মানুষের পতন ঘটায়, কিন্তু বিনয় মানুষের মাথায় সম্মানের মুকুট পরায়। ফারসিতে একটি প্রবাদ আছে, ‘বেআদব মাহ রোম গাশ্ত আয ফজলে রব, অর্থাৎ বেআদব রবের তায়ালা (আল্লাহর) সব ধরনের দয়া-মায়া থেকে চির বঞ্চিত। শিষ্টাচার ব্যক্তি সমাজ জীবনের গৌরবময় আচরণের জনক।
আদব হলো বুদ্ধির পরিপূরক ও ব্যক্তিত্বের দলিল। শিষ্টাচার বা আদব প্রতিটি মানুষকে সুন্দর ও সার্থকতায় পরিপূর্ণ করে তোলার মহাশক্তি। শিষ্টাচারের ধর্ম নিজের অসুবিধা করে, পরের সুবিধা করে দিতে উৎসুক। মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে ইবাদতের জন্য, মানব সেবা ও সৃষ্টির খেদমতও ইবাদত। মহান আল্লাহ বলেন, তোমরাই (মানব) শ্রেষ্ঠ জাতি। মানুষের কল্যাণের জন্য তোমাদের আবির্ভাব, তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অসত্কাজ থেকে বিরত রাখবে। এজন্য মুসলমানকে সব মানুষের কল্যাণ কামনার জন্য বলা হয়েছে। রসুল (স.) বলেন, সদুপদেশ দেওয়ায়ই দিন। নবি করিম (স.) আরো বলেন, জমিনে যে আছে, তার প্রতি তোমরা দয়া করো, আসমানে যিনি আছেন, তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।
ইসলামে শিষ্টাচার বা আদবকে ইমানের অংশ বলা হয়েছে। ফলে মানব জীবনে আদব অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইসলামে আদবকে সারবস্তু বলা হয়েছে। আদর্শ ও সুশৃঙ্খল সমাজ গঠনে এবং মানব সভ্যতার ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে শিষ্টাচারের ব্যবহার সমাজে অতি গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামি শিষ্টাচারে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রসভ্যতা পার্থিব জীবনের সব দিক সুন্দরভাবে টিকে থাকতে শিষ্টাচারের কোনো বিকল্প নেই। আগুন দৃষ্টিশক্তির জ্যোতি, শিষ্টাচার হচ্ছে বিবেকের জ্যোতি। দার্শনিকরা বলেছেন, জ্ঞানবুদ্ধি ছাড়া শিষ্টাচার হয় না। আর আদব ছাড়া জ্ঞানও হয় না। একটি আরেকটির পরিপূরক।
সমাজের প্রতিটি কাজ একটি নীতি-আদর্শানুসারে পরিচালিত হওয়ায়ই আদব। আদব অনুসরণ করলে ব্যক্তি, সমাজ ও সভ্যতার ভারসাম্য বজায় থাকে। আদবের বিভিন্ন দিক কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। আদবের শিক্ষা দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তুমি ক্ষমার নীতি গ্রহণ করো, লোকদের সৎ কাজের আদেশ দাও এবং মূর্খদের এড়িয়ে চল। সমাজে ভালো ও মন্দ কখনো একসঙ্গে সমানভাবে চলতে পারে না। উত্তম দ্বারা অনুত্তমকে প্রতিহত করাই আদব। এই গুণের অধিকারী কেবল তারাই হতে পারে, যারা ধৈর্যধারণ করে, সমাজ সভ্যতা ধরে রাখার চেষ্টা করে এবং পরকে আপন করে তারাই মহাভাগ্যবান। সে ব্যক্তি প্রথমে সালাম দেয়, আল্লাহর নিকট সেই উত্তম। সমাজ জীবনে মানুষের প্রত্যহিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই আদব প্রচারিত হয়। পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা ও লজ্জাশীলতা মানুষ প্রাণীর সঙ্গে উত্তম ব্যবহার হলো উত্তম আদব। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার সঙ্গে সুন্দর আচরণ করা, ভালো কথা বলা, ভদ্র ও মার্জিত রুচির পরিচায়ক। একমাত্র সদাচরণই মানুষ মানুষকে কাছে টেনে সমাজ সভ্যতা টিকে থাকার শক্তিশালী এক হাতিয়ার।
ইসলাম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সাংস্কৃতিক পার্থক্য স্বীকৃতি, জীবনযাপনের বিভিন্ন পর্যায়ে সর্বজনীন, শিষ্টাচার আদব-কায়দা মেনে চলার নির্দেশনা রয়েছে। মানুষের সেবা, সদাচরণ করা মানবের দায়িত্ব ও কর্তব্য। উত্তম মুসলমান সেই ব্যক্তি, যার চরিত্র সুন্দর। যার আচরণ সর্বোত্তম, সেই পরিপূর্ণ মুসলমান। যে ব্যক্তি লেনদেন, কাজ-কারবারে সত্যবাদী ও বিশ্বাসী, ওয়াদাপূর্ণ করে, দায়িত্ব পালন করে, মানুষকে ধোঁকা দেয় না, আমানতের খেয়ানত করে না, মানুষের হক নষ্ট করে না, ওজনে কম দেয় না, মিথ্যা কথা বলে না, সুদ-ঘুষসহ যাবতীয় অবৈধ উপার্জন থেকে বিরত থাকে, সেই ব্যক্তি প্রকৃত মুসলমান এবং একজন শিষ্টাচারী। খাঁটি মুসলমান সেই ব্যক্তি, যার জিহ্বা ও হাত থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে। কোনো ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে নিজের জন্য যা পছন্দ করে, তার ভাইয়ের জন্যও তা পছন্দ করবে।
মানুষ যতদিন অরণ্যচারী ছিল, ততদিন শিষ্টাচার বা সৌজন্য বোধ প্রকাশের প্রয়োজন মনে করেনি। সমাজবদ্ধ হওয়ার পর শিষ্টাচার ও ভদ্রতাবোধের প্রয়োজন অনুভব করে। মধ্যযুগে আরবজাতির মধ্যে আদবের অভাবে বেআদব আচরণ, আরব জাতির জীবনে ছিল হতাশার কুপ্রথা। কুসংস্কারের পঙ্কিলতায় আচ্ছন্ন। আদি যুগেও মানুষের মধ্যে আদব বা শিষ্টাচার ছিল না। আমাদের সমাজে অসত্যকে সত্য বলে স্বীকার করে নেওয়ার নীতিটি সামাজিক একটি বড় ধরনের ব্যাধি। শিষ্টাচারের সঙ্গে দৃঢ়তার মিশ্রণই এই ব্যাধির সঠিক চিকিৎসা। অমায়িক, লোকপ্রিয়, সত্যবাদী, ন্যায়পরায়ণ, মানবতাবাদী মানুষের অভাব এখন সমাজে। আদব-শিষ্টাচার নামক স্বভাবটি সমাজ থেকে পালিয়ে গেছে। সমাজের মাথায় পচন শুরু করেছে। বেআদবের দখলে সমাজ, নীতি-নৈতিকতার অভাবে খুনখারাবি, মাস্তানি, বিশৃঙ্খলা চলছে। কোথায়ও ভালো মানুষের স্থান নেই, সবাই এখন নিজে রাজা।
পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, সমাজনীতি, ধর্মকর্মে আদব বা শিষ্টাচার অপরিহার্য থাকলেও অশিষ্টাচার অসৌজন্যহীনতার নিষ্ঠুর চিত্র বিরাজমান। সমাজে সৌন্দর্য-সুকুমার প্রবৃত্তিগুলোর দেখা নেই। নৈতিকতার মানুষও যেন লুকিয়ে গেছে। বিত্তমান, নির্লজ্জদের দাপট সর্বত্র। সমাজের নীতিবান, চরিত্রবান মানুষগুলো পর্দার আড়ালে। মানুষকে সম্মান নয়, অপমান করতে পারলেই সমাজের তৃপ্তি। একবিংশ শতাব্দীর এ সময়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক উন্নতি ও অগ্রগতি হলেও বিজ্ঞানের মাত্রাতিরিক্ত অপব্যবহারে সমাজ সভ্যতা একেবারে দেউলিয়া হওয়ার পথে। আদব-শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধের দুর্ভিক্ষ চতুর দিকে। আগ্রাসি ইন্টারনেট সমাজকে গিলে খাচ্ছে। অশ্লীলতার দিকে সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা না বুঝে, খেয়াল না করে সমাজ ধ্বংস করছি। ছোট শিশুদের পুতুল, খেলনা, বই-খাতা, কলমের পরিবর্তে মোবাইল হাতে তুলে দিচ্ছি। গ্রাম-শহরের মোড়ে মোড়ে শিশু-কিশোরদের গ্যাং সারাদিন মোবাইল হাতে নিয়ে পর্নোগ্রাফিতে ব্যস্ত। কিশোরদের মোবাইলের টিকটক নিয়ে খুনখারাবি হচ্ছে। মোবাইলে প্রকাশ্যে মেয়েরা যৌনাচারের আহ্বান করছে। ধর্ম-কর্মে আদরের খেয়াল নেই। মসজিদে নামাজরত অবস্থায় মোবাইল বেজে ওঠে। রমজান মাসে অনেকেই নামাজের আগের কাতারে গিয়ে বসেন, কয়েক রাকাত তারাবি শেষ হতে না হতেই মাথার ওপর দিয়ে পা তুলে বের হন। জুমার নামাজেও তাই। জুমার নামাজে কেউ কেউ মাত্র দুই রাকাত ফরজ পড়ে বেরিয়ে যান। রমজানে ইতিকাফে মুসল্লি অযথা কথাবার্তা বলতে নিষেধ থাকলেও সব দুনিয়াবি গল্প ও মোবাইলে সময় কাটান। যুগ যুগ ধরে দেখে আসছি ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার নামাজের পর নীরবে খুতবা শুনে মোনাজাত করে মুসল্লিরা ঈদগাহ থেকে বের হন। এখন অধিকাংশ মুসলমান খুতবা শোনেন না, মুনাজাতও করেন না। এটা আদবের বড় বরখেলাপ। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, গণপরিবহনে, ট্রেনে বেআদবের চরম দৌরাত্ম্য। লজ্জাবোধকে পরাজিত করে অশ্লীলতা এগিয়ে যাচ্ছে। সমাজ সভ্যতায় ক্ষয় শুরু হয়েছে, সামনে বিপর্যয় অনিবার্য ।
জাতীয় রাজনীতিতেও শিষ্টাচারের চরম সংকট। দলবাজ নেতাকর্মীদের সেলফি, ফটোবাজির কারণে রাজনীতি কলুষিত হচ্ছে। আগে রাজনীতিতে আদবের কঠোরতা ছিল, ছিল উত্তম ব্যবহার। যাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, নীরবে দাঁড়িয়ে তা পালন করছে। এখন তা নেই, নেতা থেকে কর্মী বড়। বয়স্ক, আদর্শ-নীতিবান নেতারা এখন কোনো অনুষ্ঠানে যেতে ভয় পান। রাজনীতির মঞ্চের সামনে এখন শ্রোতা দেখা যায় না। মঞ্চে নেতার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার ঠেলাঠেলি ও ধাক্কাধাক্কি দেখা যায়। এমন সংস্কৃতির রাজনীতির আদব, সৌজন্যবোধ ধ্বংস করছে। রাজনীতি যেন আদর্শহীন হয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একাধিক অনুষ্ঠানে নেতাকর্মীদের মঞ্চত্যাগের নির্দেশ দিলেও কেউ কথা শোনেনি। তিনি রাগান্বিত হয়ে বক্তব্যও বন্ধ করার দৃশ্য গণমাধ্যমে দেখা যায়। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মিছিলে ব্যানার হাতে নিয়ে দাঁড়াতে পারেননি নির্লজ্জ কর্মীদের কারণে। তাকেও ধাক্কাধাক্কি করতে দেখা যায়। রাজনীতিতে এখন শিষ্টাচারসংকট। অভদ্র সুবিধাবাদীদের কারণে রাজনীতি কলুষিত হচ্ছে। মোবাইল সাংবাদিকতার কবলে আসল সাংবাদিকতা হারিয়ে যাচ্ছে। এসব কিছুই সমাজের অশনিসংকেত। শিষ্টাচারহীনতার পথে এগোচ্ছে যেন সমাজ।
কথায় আছে, কোনো ব্যক্তি সব হারালেও তার কিছুই হারায়নি। কিন্তু যদি চরিত্র হারায়, তবে সব হারিয়ে গেল। ঠিক তেমনিভাবে আমাদের জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে উন্নতি, অগ্রগতি হলেও যদি সমাজে শিষ্টাচারের সংকট বা পচন ধরে যায়, তাহলে সভ্যতা ও মানবতা ধ্বংস হয়ে যাবে। সমাজে বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। অর্থনৈতিক, প্রাকৃতিক, মানব সৃষ্ট দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হলেও আদব বা নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় সহজে সমাজে পূরণ করা সম্ভব নয়। তাই শিষ্টাচারের ক্ষয়রোধে নৈতিক শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। দেশের হক্কানি আলেম সমাজসহ সচেতনমহলকে আদবসংকট মোকাবিলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। নতুবা সমাজ সভ্যতা হারিয়ে যাবে বেআদবের তলে।