‘কর্মকর্তা’ বহুল পরিচিত একটি শব্দ। এর দ্বারা সচরাচর কোনো প্রতিষ্ঠান বা দপ্তরের প্রথম সারি কিংবা ঊর্ধ্বতন পদ-পদবিতে কর্মরতদের বোঝানো হয়। সাধারণ মানুষকে সেবাদানের উদ্দেশ্য নিয়ে এসব দপ্তরের বিভিন্ন পদ-পদবিতে চাকরি করেন তারা। এক্ষেত্রে জনগণের সেবা দেওয়াই তাদের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দুঃখজনকভাবে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে দেখা যাচ্ছে। উপজেলা প্রশাসনের প্রধান নির্বাহী অফিসার কিংবা জেলা প্রশাসক বা উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গকে সম্বোধনে ‘স্যার’ শব্দটি ব্যবহার না করায় তাদের মধ্যে একধরনের ক্ষোভের উদ্রেক লক্ষ করা যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। এ নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে বারবার বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে বটে, তবে তাতে কোনো কাজ হচ্ছে বলে মনে হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সংবাদসংশ্লিষ্ট কাজে গিয়ে সাংবাদিকেরা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ‘স্যার’ না ডাকায় তারা ক্ষেপে উঠেছেন! ক্ষেত্রবিশেষে দুর্ব্যবহার করেছেন! এ ধরনের প্রবণতা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
উল্লেখ করা দরকার, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের সংবিধানে কোথাও ‘কর্মকর্তা’ বলে স্বীকৃত কোনো শব্দ নেই। সংবিধান অনুযায়ী, সরকারি চাকরিজীবীরা সবাই ‘কর্মচারী’। ২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইনে বলা আছে, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত কর্মচারী।’ অর্থাৎ, ‘কর্মকর্তা’ বলে কোনো শব্দ নেই—এ বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। কিন্তু এর পরও দেশের প্রথম সারির নাগরিকদের কাছ থেকে এমন ঔদ্ধত্য আচার-আচরণ প্রত্যাশিত নয়। খেয়াল করলে দেখা যাবে, ২০১৮ সালের সরকারি কর্মচারী বিধিমালায় ‘নাগরিকদের সঙ্গে যে কোনো অসদাচরণ শাস্তিযোগ্য হবে’ মর্মে উল্লেখ আছে। অর্থাৎ, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ সরকারি কর্মকর্তার কাছে কাজের জন্য গিয়ে যদি কোনোভাবে হয়রানির শিকার হন কিংবা স্যার না ডাকায় অপমাণিত হন, তবে তা সংবিধান অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। সরকারি চাকরিজীবীদের অবশ্যই মনে রাখা উচিত, রাষ্ট্রের মালিক দেশের সাধারণ জনগণ। জনগণের কষ্টার্জিত অর্থে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন হয়। কাজেই জনগণ কোনোভাবেই সরকারি অফিসারকে স্যার ডাকতে বাধ্য নয়। আশা করা যায়, চাকরিতে প্রবেশের আগে প্রশিক্ষণকালে অফিসারদের এই বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে বলে দেওয়া হয়। তার পরও এ ধরনের আচরণ কোনোমতেই মেনে নেওয়া যায় না।
জনগণের ‘স্যার’ ডাকা-না ডাকা নিয়ে যেমন বিতর্ক-বিক্ষোভ আছে, তেমনি পালটা জনগণকে সম্মান দিয়ে ‘স্যার’ বলছে প্রথম সারির অনেক চাকরিজীবী—এমন উদাহরণও কিন্তু আছে এই বাংলায়। দেখা গেছে, বরিশাল জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অবস্থিত সমাজসেবা অফিসের দপ্তরে প্রতিদিন যত লোক আসেন, তাদের সবাইকেই ‘স্যার’ সম্বোধন করেন ঐ অফিসের কর্মকর্তা সাজ্জাদ পারভেজ। ২০১৮ সাল থেকে তিনি সেবাপ্রত্যাশীদের ‘স্যার’ সম্বোধনের চর্চা করে আসছেন, যা অবশ্যই আমাদের অনেক চাকরিজীবীর জন্য অনুকরণীয়। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, এমন বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে উঠে আসতে সাহায্য করতে পারে একমাত্র আমাদের সুস্থ মানসিকতা। পাশাপাশি আমাদের এ-ও মনে রাখতে হবে, জোর করে শ্রদ্ধা-ভক্তি আদায় না করে বরং ভালো ব্যবহার এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে স্বীয় দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের মধ্য দিয়ে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেওয়া যায়।