দেশের বাইরে থাকা বাংলাদেশি প্রবাসীরা সরকারের বন্ড কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। অন্য দিকে আগের চেয়ে বন্ডের অর্থ বেশি ভাঙছেন তারা। সরকার বন্ডে সুদহার কমিয়ে দেওয়া, বিনিয়োগের সীমা বেঁধে দেওয়া, নবায়নের সুবিধা তুলে দেওয়া ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বন্ডে প্রবাসীদের বিনিয়োগে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রবাসী বন্ড বিক্রির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আসে। এমন এক সময়ে এ বন্ডের বিনিয়োগ কমছে যখন বাজারে ডলার সংকট চরমে। চলতি অর্থবছরের (২০২২-২৩) প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) তিন ধরনের প্রবাসী বন্ড বিক্রি হয়েছে ২০৭ কোটি টাকার। অথচ ভাঙানো হয়েছে ৪২১ কোটি টাকার। ফলে প্রবাসী বন্ডে সরকারের নিট ঋণ কমে দাঁড়িয়েছে ২১৪ কোটি টাকা।
বর্তমানে ওয়েজ আর্নার্স ডেভেলপমেন্ট, ইউএস ডলার প্রিমিয়াম ও ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট—এই তিন ধরনের প্রবাসী বন্ড রয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, করোনা ভাইরাসের আগেও এসব বন্ডে বিনিয়োগে ইতিবাচক প্রবণতা ছিল। তখন বিনিয়োগেও কোনো সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারিত ছিল না। কিন্তু সরকার ২০২০ সালের ২১ ডিসেম্বর তিনটি বন্ডে প্রবাসীদের জনপ্রতি বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সীমা ১ কোটি টাকায় বেঁধে দেয়। আবার স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিনিয়োগ নবায়নের সুবিধাও বন্ধ করা হয়।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর ইত্তেফাককে বলেন, প্রবাসী বন্ডে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কারণ হচ্ছে সরকার এসব বন্ডের বিনিয়োগকে নিরুত্সাহিত করছে। বিনিয়োগে ১ কোটি টাকায় লিমিট বসিয়ে দিয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশের মতো বাংলাদেশে এটি একটি স্থিতিশীল বিনিয়োগ মাধ্যম। এখন আমাদের দরকার হলো যত মাধ্যমে হোক যত বেশি পারা যায় সব জায়গা থেকে দেশে ডলার নিয়ে আসা। তবে জনপ্রিয় এ বিনিয়োগ মাধ্যমে সরকার নিজেই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। এ খাতে সরকারের পলিসি পরিবর্তন করে লিমিট তুলে দিয়ে আগের অবস্থায় গিয়ে বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শ নিয়েছেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক এ কর্মকর্তা।
উল্লেখ্য, গত এপ্রিলে বিদ্যমান তিন ধরনের প্রবাসী বন্ডে সুদ হার কমানো হয়। প্রবাসীরা বৈদেশিক মুদ্রায় এসব বন্ডে বিনিয়োগ করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ১২৬ কোটি টাকার ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড বিক্রি হয়েছে। এ সময়ে প্রবাসীরা আগের কেনা বন্ডের আসল পরিশোধ হয়েছে ২৮৩ কোটি টাকা। এতে নিট ঋণ কমেছে ১৫৭ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডের ৩৪ কোটি টাকা বিক্রি হলেও পরিশোধ হয়েছে ১২১ কোটি টাকা। এখানে নিট বিক্রি কমেছে ৮৭ কোটি টাকা। তবে ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ডে ৩১ কোটি টাকা বিক্রি বেশি হয়েছে। প্রথম দুই মাসে ৪৭ কোটি টাকা নতুন বিক্রির বিপরীতে পরিশোধ হয়েছে ১৬ কোটি টাকা।
মন্তব্য জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান ইত্তেফাককে বলেন, বিশ্বব্যাপী উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। প্রবাসীদের আয় কমে গেছে। এসব বন্ড থেকে যে সুদ পাওয়া যাচ্ছে সেটি চলে গেছে মূল্যস্ফীতির নিচে। যারা বিনিয়োগ করবে তারা দেখছে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশে বেশি হয়ে গেছে। ডলারে বিনিয়োগ করে তারা রিটার্ন পাচ্ছে টাকায়। কমে গেছে টাকার মূল্যমান। রেমিট্যান্স কমে যাওয়াও বিনিয়োগ কমে যাওয়ার একটি কারণ বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। সেপ্টেম্বর মাসে তা কিছুটা কমে ৯ দশমিক ১০ শতাংশ হয়েছে। আগস্ট মাসে গত ১১ বছর ৩ মাসের (১৩৫ মাস) মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। এর আগে ২০১১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ২০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। ২০১১ সালের মে মাসের পর মূল্যস্ফীতি আর কখনোই ৯ শতাংশের বেশি হয়নি।
সুদহার কমানোর আগে তিন বছর মেয়াদি ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডে সব ক্ষেত্রে সুদহার ছিল ৬ শতাংশ। বর্তমান সুদহার ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ৫ শতাংশ, ১ লাখের বেশি ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ৪ শতাংশ এবং এর বেশি হলে ৩ শতাংশ। তিন বছর মেয়াদি ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ডে আগে সাড়ে ৭ শতাংশ সুদ পাওয়া যেত। এখন ১ লাখ টাকা পর্যন্ত সাড়ে ৫ শতাংশ, ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত সাড়ে ৪ শতাংশ এবং এর বেশি হলে সাড়ে ৩ শতাংশ সুদ মিলছে। পাঁচ বছর মেয়াদি ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ডে সব ক্ষেত্রে সুদ ছিল ১২ শতাংশ। বর্তমানে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত সুদহার আগের মতোই আছে। তবে ১৫ লাখের বেশি থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত ১১ শতাংশ, ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ১০ শতাংশ এবং ৫০ লাখ টাকার বেশি হলে ৯ শতাংশ সুদ নির্ধারণ করা হয়েছে।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, আগে মেয়াদ শেষ হলে বন্ডগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবেই নবায়ন হতো। এখন নবায়নের জন্য গ্রাহকদের ব্যাংক বা এক্সচেঞ্জ হাউজে যেতে হয়। তাই নবায়নের হার কমে গেছে। অন্য দিকে নগদায়ন বা বন্ড ভাঙানোর প্রবণতা বেড়ে গেছে। আবার যাদের বেশি বিনিয়োগ ছিল, তারাও বিনিয়োগ কমিয়ে ফেলছেন। এসব বন্ডে বিনিয়োগের বড় অংশই প্রবাসী ব্যবসায়ীদের।
তবে গত সোমবার ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড ও ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ডে বিনিয়োগে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা তুলে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কারো এনআইডি না থাকলে এখন থেকে পাসপোর্ট নম্বরকে ‘ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন নম্বর’ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ডলার সংকট কাটিয়ে উঠতে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ সহজ করলেও বাংলাদেশে কিছু শর্ত আরোপ করা হয়।