রাজধানীসহ সারাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোর ৮৫ ভাগেরই পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি বিকল। সিটিস্ক্যান, এক্স-রে, ইসিজি, এমআরআই এর মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা করতে পারছেন না রোগীরা। সরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফি যেখানে দুই হাজার টাকা, সেটা বাইরের বেসরকারি হাসপাতালে করতে লাগছে ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। যে পরীক্ষা সরকারি হাসপাতালে ফি, সেই পরীক্ষাও বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে দুই হাজার টাকার বেশি লাগে। সরকারি হাসপাতালে আগত রোগীদের মধ্যে ৮০ ভাগই দরিদ্র। সারাদেশে ডেঙ্গুর ভয়াবহ থাবা। অনেক ডেঙ্গু রোগীদের কয়েক দফা পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন পড়ছে।
সোমবার সকাল ৮টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত একদিনে সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৩ হাজার ১২৩ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সরকারি হাসপাতালগুলোর যন্ত্রপাতি বিকল হওয়ায় ডেঙ্গু রোগীদের দুর্ভোগ যেন মরার উপর খাড়ার ঘা। তবে এতে লাভবান হচ্ছেন এক শ্রেণীর ডাক্তার ও কর্তৃপক্ষ। তারা রোগীদের বেসরকারি হাসপাতালে পাঠিয়ে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ কমিশন পাচ্ছেন। আর এই কমিশন পাওয়ার আশায় এক শ্রেণীর ডাক্তার ও কর্তৃপক্ষ সচল যন্ত্রপাতি নষ্ট বলে রেখে দেয়। আবার সত্যিকার অর্থে নষ্ট হলেও তা মেরামতের কোন উদ্যোগ নেন না। এক শ্রেণীর বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য), সিভিল সার্জন, জেল সদর হাসপাতালের সুপার ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকরা বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে কমিশন নিয়ে পেয়ে থাকেন। আবার মেরামতের জন্য ঢাকায় পাঠালে মন্ত্রণালয় হয়ে পাশ হয়ে আসতে তা কয়েক মাস লেগে যায়। মন্ত্রণালয়ের, অধিদপ্তর, বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ও সিভিল সার্জন অফিসের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা হাসপাতালগুলোর যন্ত্রপাতি মেরামতের চেয়ে কেনাকাটাসহ যেগুলোতে অর্থ পাওয়া যায় সেদিকে বেশি মনোযোগ দেন। এ কারণে কোন কোন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যন্ত্রপাতি মেরামতের উদ্যোগ নিলেও তা কাজ হয় না। আবার ঢাকায় যেখানে মেরামত করতে পাঠানো হয়, সেখানে মেশিন পাঠালে ভালোর চেয়ে বেশি খারাপ হয়। দেখা যায় ১০/১২ দিন মেশিন চালানোর পর আবার তা বিকল হয়ে পড়ে। অর্থাৎ যন্ত্রপাতি মেরামতের নামেও কোটি কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে। অনেক ডাক্তার উচ্চতর ডিগ্রি নিচ্ছেন। তাদের হাতে-কমলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা স্বচক্ষে দেখা-তাদের কোর্সের অংশ। কিন্তু যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ায় তারা সেই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এমআরআই মেশিন ৭ মাস ধরে নষ্ট। অবশেষে মেরামত করতে এক কোটি ৮৫ লাখ টাকা ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। রাজধানীর বৃহত এই হাসপাতালে যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে সারাদেশের কি চিত্র তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ২০০ যন্ত্রপাতি বিকল অবস্থায় আছে। তবে বিকল ঘোষণা করতে হলে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের অনুমোদন লাগবে। সরকার সরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে যাদের গুরুতর কিংবা শক সিনড্রোম দেখা দেয়, তাদের সিটিস্ক্যান, এক্স-রে, ইসিজি, এমআরআই সহ বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা বেশি প্রয়োজন হয়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, যন্ত্রপাতি নষ্ট হলে তা মেরামতের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে পাশ হতে কয়েক মাস লেগে যায়। তাই হাসপাতালগুলোতে মেরামতের ব্যবস্থা করা উচিত। যাতে তাৎক্ষণিক যন্ত্রপাতি সচল করতে পারে। এতে রোগীদের দুর্ভোগ কমবে। কোন হাসপাতালে যন্ত্রপাতি নষ্ট, আবার কোন হাসপাতালে যন্ত্রপাতি সচল রয়েছে। তবে ওই সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে যন্ত্রপাতি সচল কিংবা নষ্ট যাই হোক না কোন রোগী গেলে সরকারি হাসপাতালে সামনে ও আশপাশে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠিয়ে দেন এক শ্রেণীর ডাক্তাররা। তবে ঢাকার বাইরে ৬০ ভাগ কমিশন পান। রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার জন্য ওই বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নিয়োজিত দালালরা নিয়মিত সরকারি হাসপাতালে বসে থাকে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. মো. শামিউল ইসলাম বলেন, শুধুমাত্র ময়মনসিংহ বাদে দেশের বাকি সাতটি বিভাগে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সভাপতিত্বে মিটিং হয়েছে। সেখানে বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য), হাসপাতালগুলোর পরিচালক, সিভিল সার্জন ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন। ওই সব মিটিংয়ে যেসব হাসপাতালের যন্ত্রপাতি নষ্ট আছে তা দ্রুত মেরামত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। যেগুলো মেরামত করা যাবে না, সেগুলো বাতিল করার সিদ্ধান্ত হয়। যদি যন্ত্রপাতি কেনার প্রয়োজন হয় তাহলে চাহিদা দিতে বলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। এগুলো ইতিমধ্যে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। হাসপাতালগুলোতে বায়োমেডিক্যাল টেকনিশয়ার নিয়োগ শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে ২০২ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা যন্ত্রপাতি নষ্ট হলে দ্রুত মেরামত করতে পারবে। এতে রোগীরা উপকৃত হবে তিনি জানান।
বরিশাল অফিস জানায়, রোগ নির্ণয়ের গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি বছরের পর বছর বিকল থাকায় বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল এর রোগীদের নিঃস্ব হতে হচ্ছে। মেডিকেলের একটি মাত্র এমআরআই যন্ত্র ছয় বছর ধরে বিকল। পুরোপুরি নষ্ট অবস্থায় পড়ে রয়েছে মেশিনটি। দুটি সিটিস্ক্যান যন্ত্র একসঙ্গে নষ্ট হয় আরও ২ বছর আগে, এ সময়ে মেডিকেলে কোনো সিটিস্ক্যান বন্ধ ছিলো। দুই মাস পূর্বে একটি চালু হলেও তা চলছে সেখানকার কর্মরতদের মেজাজ-মর্জি অনুযায়ী। পাঁচটি আলট্রাসনোগ্রাম যন্ত্রের মধ্যে তিনটিই অচল ৩ বছর ধরে। দুটি যন্ত্র দিয়ে আন্তঃ ও বর্হিবিভাগের রোগীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেহাল অবস্থা এক্স-রে বিভাগের। ১৩টি এক্স-রে যন্ত্রের মধ্যে বিকলই ১০টি। হাসপাতালের ইকোকার্ডিওগ্রাম বিগত তিন মাস নষ্ট থাকার পর চালু হলেও সেখানে চিকিৎসা হয় চিকিৎসকদের ইচ্ছের উপর। ক্যাথল্যাব স্থাপন করা হয় ২০১৪ সালের জুনে। তবে এটি বন্ধ থাকায় মাঝে টানা তিন বছর এনজিওগ্রামও বন্ধ ছিল। যন্ত্রটি বারবার মেরামত করে সচল রাখতে হচ্ছে। তিন বছর ধরে এনজিওগ্রাম চালু থাকলেও গড়ে মাসে ৫টির মেশিন এনজিওগ্রাম হয়নি।
বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালের পরিচালক ডা. এইচ এম সাইফুল ইসলাম বলেন, প্রতি সপ্তাহে ও মাসে কয়েকবার মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি যার ফলে দু-একটি মেশিন ঠিক করা হয়েছে। বাকি যেগুলো আছে সেগুলো ঠিক করার মত নয়; সেগুলো মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অকশনে দেয়া হবে। এর পরে হয়তো নতুন মেশিন পাওয়া যাবে। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে যাতে আমাদের চাহিদানুযায়ী মেশিনগুলো ঠিক করা যায় এবং রোগীদের সেবা প্রদান করা যায়। এছাড়াও এনজিওগ্রাম, সিটি স্ক্যান, এক্সরে সহ পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিভাগগুলোতের কর্মকর্তারা আন্তরিক হলে আরও সেবা দেয়া সম্ভব।
রংপুর অফিস জানায়, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যাথ ল্যাব – সিটি স্ক্যান সহ ছোট-বড়-মাঝারি ৫৩৭টি যন্ত্র অচল হয়ে আছে। এর মধ্যে এমআরআই বা সিটি স্ক্যানের মতো বড় যন্ত্র যেমন আছে। পালস্ অক্সিমিটারের মতো ছোট যন্ত্রও আছে। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মোহাম্মদ ইউনুস আলীর কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি হাসপাতাল কিছুদিন আগে পরিচালকের পদে যোগ দিয়েছি। নষ্ট যন্ত্রপাতির তালিকার বিষয়টি আমার কাছে খুব একটা পরিষ্কার নয়।প্রতিটি বিভাগ ধরে ধরে যন্ত্রপাতির নতুন একটি তালিকা তৈরি হচ্ছে।
চট্টগ্রাম অফিস জানায়, এমআরআই মেশিন নষ্ট হয়েছে প্রায় দেড় বছর হবে। মহিলাদের জরায়ুর ক্যান্সার থেরাপির ব্র্যাকিথেরাপি মেশিনটি ১ বছর ৩ মাস যাবত অচল রয়েছে। আর কার্ডিওলজি বিভাগে রোগীর এনজিওগ্রাম করার ক্যাথল্যাব মেশিন ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে অচল অবস্থায় রয়েছে। রেডিওলজি বিভাগে মহিলাদের ব্র্যাস্ট ক্যান্সার নির্ণয়ের মেমোগ্রাফি মেশিন নষ্ট প্রায় ৬ মাস। এই মেশিনের প্রিন্টার নষ্ট থাকায় সার্ভিস বন্ধ রয়েছে। আর গত প্রায় ৩ মাস যাবত একমাত্র সিটিস্ক্যান মেশিনটি অচল হয়ে পড়েছে। এটির সফটওয়্যার ও টিউবে ত্রুটি দেখা দিয়েছে। প্রতিটি মেশিন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে জটিলতার কারণে মেরামত কাজ আটকে রয়েছে।
এ ব্যাপারে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান ইত্তেফাককে বলেন, অচল থাকা এসব ভারী যন্ত্রপাতি মেরামত প্রক্রিয়ায় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। আর সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে আলোচনা করে মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। আমরা মেশিনের অচল অবস্থা নিয়ে মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার চিঠির মাধ্যমে অবহিত করেছি। আমাদের করার কিছু নেই।’
ঢাকার বাইরে দ্বিগুণ হারে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী: এদিকে রাজধানীর পাশাপাশি গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গু। গতকাল রাজধানীর চেয়ে দ্বিগুণ বেশি রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। গতকাল আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭৭৪ জন, আর ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২৩৪৯ জন। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ১০ হাজার ১৫৬ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন আছেন। ঢাকার সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ৩ হাজার ৫৮১ জন এবং অন্যান্য বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ৬ হাজার ৫৭৫ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন।