কোভিড-১৯ প্রতিঘাত ও বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছ থেকে বেশিমাত্রায় ঋণ করছে সরকার। সদ্য বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) ঋণ নিয়েছে ৪৬ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। এর আগের বছর (২০২০-২১) নেওয়া হয়েছিল ৪৫৫৩০ কোটি টাকা। জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত নয় মাসের ঋণের অঙ্ক আগের এক বছরের (১২ মাস) চেয়ে বেশি। এসব ঋণ বড় কোনো প্রকল্পের অনুকূলে নেওয়া হয়নি। নানা ধরনের ব্যয় করতে গিয়ে যে অর্থের ঘাটতি দেখা দিয়েছে তা পূরণ করতেই বিদেশ থেকে এই ঋণ করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঋণ সংক্রান্ত এক নথি থেকে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
ঋণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, গত অর্থবছরে যতটা আশা করেছিলাম, তার চেয়েও বেশি ঋণসহায়তা পাওয়া গেছে। এতে করোনার টিকা খাতসহ অন্যান্য খরচ মেটানো গেছে। এছাড়া ‘কোভিড-১৯ মহামারির সময়ে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকাসহ দাতা দেশ ও সংস্থাগুলোর কাছ থেকে দ্রুত ঋণসহায়তা পাওয়া গেছে।
এদিকে চলতি অর্থবছরেও সরকার বিদেশি ঋণের প্রতি জোর দিচ্ছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে। বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছে এ পর্যন্ত ৬.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (৬৫০ কোটি ডলার) ঋণ সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। এরমধ্যে ৪.৫ বিলিয়ন (৪৫০ কোটি) ডলার চাওয়া হয়েছে আইএমএফ’র কাছে। এই ঋণ পাওয়া গেলে বাজেট সহায়তা হিসাবে ব্যবহার করা হবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এমকে মুজেরি যুগান্তরকে বলেন, বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছ থেকে বাজেট সহায়তা হিসাবে ঋণ নেওয়া হয়। সে ধারাবাহিকতায় হয়তো এসব ঋণ নেওয়া হয়েছে। এতে অভ্যন্তরীণ ঋণ ব্যবস্থা বিশেষ করে ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র থেকে কম ঋণ নিতে হয়েছে। এসব ঋণ করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি বলেন, দেশে এখন বৈদেশিক মুদ্রার সংকট আছে। আমাদের প্রয়োজন তাদের ঋণ সহায়তার। এই মুহূর্তে বিদেশি ঋণ পাওয়া গেলে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে অনিশ্চয়তাও কাটবে।
সাধারণত বিদেশি ঋণ দু’ভাবে নেওয়া হয়। এক বাজেট সহায়তা এবং দ্বিতীয় প্রকল্পের অনুকূলে। বাজেট সহায়তার জন্য যে ঋণ নেওয়া হয় সেটি বৈদেশিক মুদ্রার আকারে স্বল্প সময়ের মধ্যে সরকারের কোষাগারে চলে আসে। এই অর্থ সরকারের প্রয়োজন ও ইচ্ছা অনুযায়ী কোনো পরিস্থিতি ও সংকট মোকাবিলায় ব্যয় করতে পারে। আর প্রকল্পের অনুকূলে বিদেশি ঋণ আসতে অনেক সময় নেওয়া হয়। এছাড়া এককালীন না দিয়ে প্রকল্পের বিভিন্ন ধাপে দাতা সংস্থাগুলো অর্থ ছাড় করে থাকে। ওই অর্থ নির্দিষ্ট প্রকল্প ছাড়া অন্য কোথাও ব্যবহার করা যায় না। এই জন্য সরকার বিভিন্ন দাতা সংস্থার কাছ থেকে দ্রুত অর্থ পেতে বাজেট সহায়তার ঋণকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। গত নয় মাসে যে ঋণ নেওয়া হয়েছে সেটি বাজেট সহায়তা হিসাবে আসছে। এছাড়া আগের বছরের ঋণও বাজেট সহায়তা খাতেই নেওয়া হয়।
নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ এই ৯ মাসে যে বিদেশি ঋণ নিয়েছে সরকার এরমধ্যে সর্বোচ্চ এসেছে গত ফেব্রুয়ারি মাসে। সে সময় বিদেশি ঋণের অঙ্ক ছিল ৯ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঋণ নেওয়া হয় ডিসেম্বরে। সে মাসে ঋণ আসে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা। আর ২০২১ সালের আগস্ট মাসে আসে তৃতীয় সর্বোচ্চ ঋণ গ্রহণ করা হয়েছিল। সে মাসে ঋণ পাওয়া গেছে ৬ হাজার কোটি টাকা।
ঋণ পাওয়ার তালিকায় পর্যায়ক্রমে জুলাই মাসে ১ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা, সেপ্টেম্বরে ৪ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা, অক্টোবরে ৪ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা এবং নভেম্বরে ৩ হাজার ২০২ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়। আর জানুয়ারি ও মার্চে পর্যায়ক্রমে ঋণ নেওয়া হয় ৩ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা এবং ৫ হাজার ৮১১ কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান সংকট কাটাতে বিদেশি ঋণের প্রয়োজন আছে। তবে স্বল্প সময়ের মধ্যে বিদেশি ঋণের উলম্ফন ভবিষ্যতে বিপদের কারণ হয়ে উঠতে পারে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। তারা বলছেন, দেশে এ মুহূর্তে ডলারের তীব্র সংকট চলছে। এ অবস্থায় বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও চাপে থাকতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই মুহূর্তে বিদেশি ঋণকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতি সংকুচিত হয়ে পড়েছিল। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়া বৃদ্ধি পায়। সে ধকল কাটিয়ে উঠার আগেই শুরু হয় ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ। এই যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্যসহ অন্যান্য পণ্যের মূল্য বেড়েছে। এতে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৫.৫ বিলিয়ন থাকলেও বর্তমানে ৩৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল, গ্যাস, খাদ্য পণ্যের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি আমদানি ব্যয় অনেক বেড়েছে। ডলারের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে দেশীয় বাজারে চরম সংকট তৈরি হয়েছে। এই সংকট কাটাতেও সরকার বৈদেশিক ঋণের ওপর আগামীতেও বেশি জোর দিচ্ছে।
সূত্র মতে, একই সময়ে (জুলাই-মার্চ) অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছিল ৪৫ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। এরমধ্যে ব্যাংক থেকে ২৯ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র থেকে ১৬ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা।
এ পর্যন্ত যত বিদেশ ঋণ গ্রহণ : ২০১৬-১৭ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত এই পাঁচ বছরে বৈদেশিক ঋণ নিয়েছে ৩১.৫৬ বিলিয়ন (৩১৫৬ কোটি) ডলার। ওই হিসাবে প্রতিবছরে গড়ে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করা হয় ৬.৩১ বিলিয়ন (৬৩১ কোটি) ডলার। একই সময়ে দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ঋণের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে ৬১.৯৯ বিলিয়ন ডলার। ওই হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ঋণের প্রতিশ্রুতি মিলছে ১২.৩১ বিলিয়ন ডলার।