দেশজুড়ে জনসংখ্যা বাড়লেও প্রকৃত মানুষের সংখ্যা কমেছে। যথার্থ মানুষের সংখ্যা যেমন কমেছে, তেমনি কমেছে মানবিকতা, মানবিক মূল্যবোধ, সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি নৈতিকতা, ভালোবাসা। আমরা দিন দিন হারিয়ে ফেলছি আমাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, স্নেহ, মমতা, আদর্শ, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, মমত্ববোধ। যার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। দিন দিন হিংস্র হয়ে উঠেছে তথাকথিত সভ্য সমাজ, পরিবার, ব্যক্তি চিন্তা, ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দলগুলো। আমিত্ব, ব্যক্তিকেন্দ্রিক, ব্যক্তিনির্ভর পরিবার, সমাজ,
রাষ্ট্র যেন ব্যক্তি স্বার্থের সূতিকাগার হয়ে উঠেছে। প্রায় সবাই ব্যস্ত সময় পাড় করছি আপন আপন হীন স্বার্থ ভাবনায়।
প্রত্যেকেই যেন তার নৈতিকতা, মূল্যবোধ, মানবিক গুণাবলীকে বিসর্জন দিয়ে স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক মানুষ হওয়ার চূড়ান্ত প্রতিযোগিতায়। গুজবে কান দিয়ে আমরা আমাদের সহমর্মিতা এবং সম্প্রীতিকে বিভীষিকাময় করে তুলছি। আবার অনেক সময় আমরা সত্যকে না মানতে জড়িয়ে পড়ছি সংঘাত-সংঘর্ষে। অন্যায়ের পক্ষের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে। এভাবে একটি সমাজ ও রাষ্ট্র চলতে পারলেও বেশিদূর এগিয়ে যাওযা সম্ভব নয়। আমি এবং আমার এই ব্যক্তি চিন্তা ও অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আমাদের নিজেদের স্বার্থে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এবং ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশের জন্য। আর তা না হলে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বন্ধন ব্যাহত হবে। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে দেখা দেবে চরম বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য, সামাজিক বৈষম্য। মুখোশপরা একদল মানুষ বাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে বিদেশে পাচার করে দিচ্ছে। ভেঙ্গে পড়েছে বাজার অর্থনীতি।
ক্রমান্বয়ে বেড়েছে সাধারণ মানুষের দীর্ঘশ্বাস। অপমৃত্যুতে ভারি হয়ে উঠেছে মুক্ত বাতাস। সনদপত্র কেন্দ্রিক শিক্ষা বাড়লেও শিক্ষার মান এবং শিক্ষার বিকাশ মুখ থুবড়ে পড়েছে। স্বার্থপর বিশ্বাসে কুঠারাঘাত করতে হবে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে।
দেশে নারী ও শিশুর ওপর সহিংসতা বেড়েছে। শারীরিক, মানসিক, যৌন নির্যাতন ছাড়াও ধর্ষণ ও হত্যা-আত্মহত্যার মতো ঘটনা ক্রমেই বেড়েই চলছে। তারা বেশির ভাগই রাস্তায়, নিজ বাসায় ও স্বজনদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার। ঘরকেই সর্বোচ্চ নিরাপদ স্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও অনেক নারী ও কন্যাশিশুর জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠেছে সেই ঘরও। এসব ঘটনা খুবই উদ্বেগজনক।
রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম জাতীয় কন্যাশিশু দিবস উপলক্ষে ‘কন্যাশিশু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন-২০২২’ প্রকাশ করে। ২০২২ সালের প্রথম ৮ মাসে দেশের ২৪টি জাতীয়, স্থানীয় ও অনলাইন সংবাদমাধ্যম থেকে কন্যাশিশুদের প্রতি নির্যাতনের তথ্য সংগ্রহ করে এ ফোরাম। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৫৭৪ জন কন্যাশিশু শিকার হয় ধর্ষণের। এর মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ৮৪ এবং ৪৩ জন প্রতিবন্ধী কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়। প্রেমের অভিনয় ও বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ৪৯ জন কন্যাশিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২০ জনকে। ৮৭ জন কন্যাশিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ৭৬ জন। ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের মতো জঘন্যতম অপরাধের শিকার হতে হচ্ছে এক বছর বয়সের শিশুদেরও। এর মধ্যে কয়েকজন তাদের নিকটাত্মীয়ের মাধ্যমে ধর্ষিত হয়েছে।
বিদেশে পাচার, নির্যাতন, অপমৃত্যু, হত্যার পরিসংখ্যান তথ্য খুবই ভয়ংকর। কোনো সভ্য এবং গণতান্ত্রিক দেশে এই পরিসংখ্যান এবং এই ঘটনার ক্রমাগত বৃদ্ধি কাম্য নয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির বিষবাষ্প যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে সুস্থভাবে বেঁচে থাকা এবং মুক্ত চিন্তার বিকাশের মাধ্যমে একটি সুস্থ ও সমৃদ্ধ জাতিগঠন আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।
পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি আমাদের এবং আগামী প্রজন্মকে স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলছে। নিত্যপণ্যের বাজারে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং কৃত্রিম সংকটের মাধ্যমে অস্থিরতা তৈরি করা হয়েছে। চাল, আটা, ময়দা, ভোজ্যতেল, চিনি, ডিম, মুরগি, বিস্কুট, নুডল্স, কাগজ, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, শিক্ষা উপকরণ, টয়লেট্রিজ পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে অতি মুনাফার কারণে মানুষের জীবনমান গভীর সংকটের মুখে পড়েছে। ফলে একদিকে যেমন সাধারণ মানুষের ঋণের বোঝা বাড়ছে ঠিক অন্যদিকে বাড়ছে কালো টাকা, ঋণ খেলাপী এবং বিদেশে টাকা পাচার। সাধারণ শ্রমজীবী কৃষক, মেহনতী মানুষ কোথাও কোথাও ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। অন্যদিকে কিছু মানুষ রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে বটগাছ হচ্ছে। সেই সঙ্গে দেশের অর্থনীতিকে গভীর সংকটের মুখে ফেলে দিচ্ছে বিদেশে টাকা পাচারের মাধ্যমে।
নিত্যপণ্যের বাজারে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং কৃত্রিম সংকটের মাধ্যমে অস্থিরতা তৈরির প্রমাণ পেয়ে প্রতিযোগিতা কমিশন (বিসিসি) প্রাণ, স্কয়ার, এসিআই, আকিজ, সিটি গ্রুপ, মেঘনা, ইউনিলিভার, বসুন্ধরা গ্রুপসহ ১১ ব্যক্তি ও ৩৬ কোম্পানি এবং ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ৪৪টি মামলা করেছে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গত নয় মাসে দেশে রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে মোট ৩৮৭টি। এতে নিহত হয়েছেন ৫৮ জন এবং আহত হয়েছেন ৫ হাজার ৪০০ জন। এ পরিসংখ্যান উদ্বেগজনক বৈকি। আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্থানীয় নির্বাচনসহ রাজনৈতিক কারণে দেশের প্রায় সব জেলায়
এসব সহিংস ঘটনা ঘটেছে। সারা দেশে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি, দেশজুড়ে কিশোর গ্যাং কালচার দিন দিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। একটি সুস্থ সাংস্কৃতিক ধারার প্রচলন জরুরী হয়ে পড়েছে। চিন্তার বিকাশ এবং চিন্তার মুক্তির মধ্য দিয়ে একটি ইতিবাচক সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আনতে না পারলে কিশোর গ্যাং, যুব গ্যাং, ঘুষ, দুর্নীতি, ঋণ খেলাপী, মানব পাচার, টাকা পাচার, হত্যা খুন, ধর্ষণ, আত্মহত্যা এবং বলাৎকারের মতো অপরাধ শুধু বাড়তেই থাকেবে এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলা চরম আকার ধারণ করবে।
চুরি, ছিনতাই, যৌন হয়রানি, মাদক ব্যবসায়সহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোররা। কিশোর অপরাধীরা বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে হয়ে উঠছে আরও ভয়ঙ্কর অপরাধী, এলাকার ত্রাস। উদ্বেগের বিষয়, ভাড়াটে হিসেবে তারা মানুষ হত্যা কিংবা নির্যাতনের মতো অপরাধেও যুক্ত হচ্ছে। তাদের অত্যাচার থেকে রেহাই পাচ্ছে না জন্মদাতা মা-বাবা ও ভাইবোন। শিক্ষকরা দিন দিন সম্মানের দিক দিয়ে
পিছিয়ে পড়ছেন। তাদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতাও দেখা দিয়েছে। অনেক শিক্ষক শিকার হয়েছেন নির্যাতনের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সমমূলধন উদ্যোক্তা তহবিল (ইইএফ) থেকে বিনাসুদে নেওয়া ৮১২ কোটি টাকা গচ্চা গেছে। এ তহবিল থেকে ৫৭৭টি প্রতিষ্ঠানকে ১ হাজার ৫ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছিল। এসব উদ্যোক্তা ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে ঋণ নিয়েছিল। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে দেওয়া সরকারের নিরীক্ষা বিভাগের একটি প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে শিল্পঋণে খেলাপি ৫৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে প্রায় ৩০ শতাংশ, বিশেষায়িত ব্যাংকে ২৪ দশমিক ৬২ শতাংশ আছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে ২২ দশমিক ৫৬ শতাংশ এবং ১০টি ব্যাংক ও ২১টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ১৫ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋণ বিতরণে যথাযথ নিয়ম মানা হচ্ছে না। ফলে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ঘুরেফিরে ঋণ পাচ্ছেন একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ায় ব্যাংকের টাকা ফেরত দেয় না। আবার কেউ কেউ নামে-বেনামে ব্যাংক থেকে টাকা বের করে বিদেশে পাচার করছে। সাধারণত এসব টাকা আর ফেরত আসে না। ফলে
খেলাপি ঋণ বেড়েই চলেছে। সমাজ ও রাষ্ট্রে একটি ব্যাপক সাংস্কৃতিক পরির্বতন জরুরি। যেখানে মানুষ তার সহমর্মিতা, মমত্ববোধ, পারস্পারিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, মানবিক গুণাবলী ফিরে পাবে।
রক্তের বিনিময়ে, মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত লাল সবুজের পতাকার বাংলাদেশকে সোনার বাংলাদেশ গড়তে প্রয়োজন সোনার মানুষ। আমূল একটি সাংস্কৃতিক পরিবর্তন খুবই জরুরি। যার মধ্য
দিয়ে মানবিক মূল্যবোধ, সততা, নিষ্ঠা, মনুষ্যত্ব জাগ্রত হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন দরকার। যেই শিক্ষার মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের মানুষ মানবিক মানুষ, আগামী প্রজন্ম মানবিক প্রজন্ম হয়ে গড়ে উঠবে।