বিশ্বের দৃষ্টি এখন তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েনের লাতিন আমেরিকা সফরের ওপর। সাইয়ের এ সফরকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে উত্তেজনার পারদ ওপরের দিকে উঠবে—এটাই স্বাভাবিক। তাইপে-বেইজিং সম্পর্ক যখন দিনকে দিন খাদের কিনারার একেবারে তলানির দিকে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময়ে হন্ডুরাসের বেইজিংয়ের পক্ষ অবলম্বন করার ঘটনায় নড়েচড়ে বসে তাইওয়ান। মিত্রদের সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঝুলে থাকা সম্পর্ককে ঝালিয়ে নিতে লাতিন আমেরিকা সফরে বেরিয়ে পড়েন তাইওয়ান প্রেসিডেন্ট সাই। সাই ইং-ওয়েনের এ সফর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এজন্য যে, একই সময়ে চীন সফর করছেন তাইওয়ানের সাবেক প্রেসিডেন্ট মা ইং-জিউ। একই সঙ্গে, একই সময়ে সাবেক ও বর্তমান দুই প্রেসিডেন্টের এভাবে পরস্পর বৈরীভাবাপন্ন দুই দেশ (যুক্তরাষ্ট্র-চীন) সফরের ঘটনা ইতিহাসে বিরল। তাইওয়ান ও এর অংশীদাররা এই ঘটনাকে কীভাবে দেখছে এবং এর বিপরীতে চীনের পক্ষ থেকেই-বা কী ধরনের প্রতিক্রিয়া আসতে পারে, তা নিয়ে লিখেছেন আটলান্টিক কাউন্সিলের দুজন বিশেষজ্ঞ
অধিক আক্রমণাত্মক হলে
লোকসান হবে চীনেরই!
ওয়েন-টি সুং
তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েনের যুক্তরাষ্ট্র সফর নিয়ে চীন যে বেশ নাখোশ, এ বিষয়ে সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই। এর জবাবে চীনের তরফ থেকে নিন্দা ও অসন্তোষ প্রকাশ, তাইওয়ানের সংশ্লিষ্ট রাজনীতিবিদদের কালো তালিকাভুক্ত করাসহ কিছু ক্ষেত্রে শর্তযুক্ত নিষেধাজ্ঞার খড়গ নামতে পারে। সীমিত পরিসরে হলেও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে—এমন আশঙ্কাও আছে। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে বড় উদ্বেগ হলো, তাইওয়ান প্রণালি ঘিরে চীনের সামরিক মহড়া ও শক্তি প্রদর্শনের আশঙ্কা। তাইওয়ান প্রণালিতে অতীতে সামরিক মহড়ার ফলে উত্তেজনা ছড়িয়ে থমথমে অবস্থা বিরাজ করতে দেখা গেছে এ অঞ্চলে!
একটা বিষয় বলে রাখা দরকার, প্রেসিডেন্ট সাইয়ের যুক্তরাষ্ট্র সফরের প্রতিক্রিয়ায় চীন যদি কোনো সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তহব তা কোনো সুসংবাদ বয়ে আনবে না বেইজিংয়ের জন্য। প্রধানত দুটি কারণে চীনের সামরিক মহড়ার ফলাফল বেইজিংয়ের কৌশলগত স্বার্থের পক্ষে যাবে না—তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি এবং তাইওয়ানের সাবেক প্রেসিডেন্ট মার চীন সফর। বিষয় দুটির দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক।
প্রথমত, চীন-তাইওয়ান ইস্যুতে তৃতীয় পক্ষ তথা ইউরোপ কিংবা পশ্চিমা শক্তি চীনের অযথা উত্তেজনা বৃদ্ধির প্রচেষ্টাকে খুব একটা ভালোভাবে নেবে না। তাইওয়ান পরিস্থিতিকে একদমই ‘উত্তপ্ত’ দেখতে চাইবে না এই পক্ষ। কোভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে এই পক্ষ এমনিতেই অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে। এই অবস্থায় তাইওয়ান নিয়ে নতুন করে ঝামেলায় পড়তে চাইবে না তারা—এটা নিশ্চিত করে বলে দেওয়া যায়। সত্যিকার অর্থে, পশ্চিমাপক্ষ খুব ভালোমতো বোঝে, তাইওয়ান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একই টেবিলে দেখলে তা সহজভাবে নেবে না চীন। এ কারণে ম্যাকার্থি-সাই বৈঠকের আয়োজন করতে বেছে নেওয়া হয়েছে আমেরিকার মাটি। কোনো সন্দেহ নেই, ম্যাকার্থি যদি তাইওয়ান সফরে যেতেন, তবে চীনা সামরিক জাহাজকে তাইওয়ান প্রণালি চষে বেড়াতে দেখা যেত এতক্ষণে! সাইয়ের মার্কিন মুলুকে উড়ে যাওয়া মূলত এই চিন্তা থেকেই। যাহোক, তাইওয়ান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অপেক্ষাকৃত কম উত্তেজক, বিকল্প, সহজ পথ বেছে নেওয়ার এ সিদ্ধান্তকে ‘ভালো উদ্যোগ’ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে এ কারণে, ম্যাকার্থি তাইপে সফরে গেলে বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে উত্তেজনা বাড়ত, যেমনটি দেখা গিয়েছিল গত বছর মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরকে কেন্দ্র করে। বেইজিং এখনো ২০২২ সালের আগস্টে পেলোসির তাইওয়ান সফর নিয়ে ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে! এ অবস্থায়, যেহেতু আমেরিকা ভেবেচিন্তে নিজ ভূমিতে সাইয়ের সঙ্গে বসেছে, তাই চীনের অতি বাড়াবাড়িকে ওয়াশিংটন ও এর মিত্ররা খুব একটা আমলে নেবে বলে মনে হয় না। এক্ষেত্রে চীনও উত্তেজনাকর পরিস্থিতি এড়িয়ে চলবে বলেই ধরে নেওয়া যায়। এর পরও যদি চীনের পক্ষ থেকে তীব্র ও অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া আসে, তবে সেক্ষেত্রে স্বভাবতই হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না বিপরীত পক্ষও!
দ্বিতীয়ত, চীন সফর করছেন তাইওয়ানের সাবেক প্রেসিডেন্ট মা। মার এ সফরকে অত্যন্ত গুরুত্ববহ হিসেবে দেখা হচ্ছে এ কারণে যে, এর মধ্য দিয়ে অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময়ের মধ্যে কোনো সাবেক বা বর্তমান তাইওয়ান প্রেসিডেন্টের পা পড়ল চীনের মাটিতে! বলা বাহুল্য, এ সফর চীন-তাইওয়ান দুই দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্ববহ। এ দিক থেকে বিবেচনা করলে, সাইয়ের সফর নিয়ে বেইজিং খুব একটা মাথা ঘামাবে না বলেই ধরা যায়। কারণ, বেইজিং কোনোভাবেই এমন কিছু করতে চাইবে না, যাতে করে মার চীন সফর মাটি হয়ে যায়! নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার পরিবেশ সৃষ্টির এই বিরল সুযোগটি হাতছাড়া করতে চাইবে না শত্রুভাবাপন্ন দুই দেশের কেউই। এর পরও যদি বেইজিং সাইয়ের মার্কিন সফরকে অতিরঞ্জিত করে দেখে, তবে তা বুমেরাং হবে তার জন্যই—এতে কোনো সন্দেহ নেই। আজকের চীনকে খুব বুঝেশুনে পা ফেলতে দেখা যাচ্ছে বিধায় সাইয়ের যুক্তরাষ্ট্র সফর ঘিরে বেইজিংয়ের তরফ থেকে কোনো বাজে প্রতিক্রিয়া আসবে না বলেই মনে হচ্ছে!
সাইকে ডেকে নেওয়া ‘বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত’
লেভ নাচম্যান
তাইওয়ান প্রেসিডেন্টের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবতরণ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক একটি বিষয়। কাগজে কলমে কিংবা মার্কিন প্রোটোকল অনুযায়ী এতে ভুল কিছু দেখছি না। তাইওয়ানের বেশ কয়েক জন প্রেসিডেন্ট—হোক ডেমোক্রেটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি (ডিপিপি) কিংবা কুওমিনতাং (কেএমটি) দলের—অতীতে যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের সফর করেছেন। এমনকি সাবেক প্রেসিডেন্ট মা আছেন এই তালিকায়, যিনি বর্তমানে চীনে আধাকূটনৈতিক সফরে রয়েছেন। প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হরহামেশা সফর করতে দেখা গেছে তাকে। অন্যদিকে, এমন নয় যে, এবারই প্রথম যুক্তরাষ্ট্র সফর করলেন সাই। বরং এর আগে ২০১৯ সালে যখন কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন তিনি, সে সময় পিপলস রিপাবলিক অব চায়নার (পিআরসি) পক্ষ থেকে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। বরং পিআরসি অনেকাংশে নীরব ছিল, বলা যায়। সুতরাং, স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, সাইয়ের এবারের সফর ঘিরে এত কথা কেন? তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে উড়ে যাওয়া নিয়ে এত মাতামাতি কেন? এসব প্রশ্নের সোজাসাপটা উত্তর হলো, অতীতে একে স্বাভাবিক ও ছোট ঘটনা হিসেবে দেখা হলেও পিআরসি এখন একে ‘বৃহত্ ঘটনা’ হিসেবে মনে করে। বিরোধীপক্ষের সঙ্গে গোপন মোলাকাত হিসেবে বিবেচনা করে। চীনের বিরুদ্ধে অপতত্পরতা বৃদ্ধিমূলক কর্মকাণ্ড হিসেবে গণ্য করে।
যাহোক, তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের যুক্তরাষ্ট্র সফর নিয়ে চীনের অস্বস্তির বড় কারণ হলো, বর্তমানে মার্কিন-চীন-তাইওয়ান উত্তেজনা সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। চীন-তাইওয়ান সম্পর্কের প্রতিটি ইস্যু আজকের দিনে অনেক বেশি রাজনৈতিক হয়ে ওঠে। ঠিক এমন এক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে সাইয়ের মার্কিন সফরকে কেন্দ্র করে বেইজিংয়ের ‘অতিরঞ্জিত প্রতিক্রিয়া’ লক্ষ করা গেলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। তবে ২০২২ সালের আগস্টে তাইওয়ানে মার্কিন স্পিকার পেলোসির সফর ঘিরে যে ধরনের বড় আকারের সামরিক মহড়া দেখা গেছে চীনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে, এবার তেমনটা ঘটার আশঙ্কা কম।
আমি মনে করি, ম্যাকার্থির সঙ্গে সাক্ষাতে সাইয়ের উড়ে আসাকে স্মার্ট, বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত এ কারণে, এতে করে অন্তত ২০২২ সালের আগস্টের পুনরাবৃত্তি (পেলোসির সফর ঘিরে উত্তেজনা) দেখতে হচ্ছে না আমাদের। ম্যাকার্থি তাইওয়ানে গেলে নিশ্চিতভাবে যে ধরনের বাজে পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো, তা থেকে সাইয়ের আমেরিকায় উড়ে আসার ফলে বরং লাভই হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত চীনের তরফ থেকে ‘অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া’ না এলেও, বেইজিং যে এটা ভুলে যাবে সহজে, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই! তাইওয়ান ভূখণ্ডের ওপর চীনা ফাইটার জেট উড়ে যাওয়া কিংবা পিআরসির পক্ষ থেকে ‘কঠোর বিবৃতি’ যেহেতু স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে আজকের দিনে, সুতরাং, দেখা যাক—সামনের দিনে আদতে কী ঘটে!