পরে আমাদের সম্পর্কটা যেমনই হোক, ওর সাথে পরিচয় বেশ এক শত্রুভাবাপন্ন পরিবেশে। সময়টা ছিল ঠিক এমন এখনকার মত; জানুয়ারির প্রথম দিকে। তাই বছরের অন্য সময় ওর কথা মনে হলেও, এসময়টায় যেন একটু বেশিই মনে হয়। আর মনের অবচেতনেই একে/তাকে ডেকে ওর প্রসঙ্গ পাড়তে লেগে যাই। কিন্তু এবার আগের সবকিছু ছাপিয়ে কেন যে বুকের ভেতর ছলছল বয়ে চলা বোকা-আবেগী নদীটা দুকূল উপচাচ্ছে সে কথা বলতে চাই। বলতে ইচ্ছে করছে; জনে জনে সবাইকেই। ভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারের সেই সুখ-সুখ দিনগুলোতে ওর আগমন কেন যে প্রথমে খুব বিশ্রী ঠেকেছিল সে কথাই বলি আগে। আচমকা সে কথা বলতে চাইছি কেননা আমাদের পরিচয়পর্বটিও সেখানে…… !
পড়ালেখায় যতরকমের ফাঁকিবাজি সম্ভব, সব আমার জানা। পরীক্ষা’র সময়ে শুধু একটু পড়তাম তাও কোনরকমে; হালকা চোখ বুলিয়ে যাওয়া এক ধরণের রিডিং। রিডিংটা অবশ্য পুরো সিলেবাস ধরেই করতাম। মানে একবারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। তবে সেখানেও ফাঁকিবাজি; কোন রকমে দু’বার। আসলে কিছু মুখস্ত করার ক্ষমতা, ইচ্ছা বা ধৈর্য কোনটাই আমার ছিল না। তাই বরাবরই আমি ক্লাসে ভাল ছাত্রী (এভাবে পড়ার প্রধান উপকারিতা হল শিক্ষকের খুঁটিনাটি প্রশ্নগুলোর উত্তর চট করে দেয়া যায়), পরীক্ষার হল –এ রাজা (কেননা প্রশ্ন পেয়েই অনেককে যখন ফিসফাস করতে দেখতাম এটা বা ওটা কমন আসেনি; আমি তখন আনন্দে বিহ্বল হয়ে ভাবতাম – হায় হায় সব প্রশ্নের উত্তরই যে জানি!) এবং পরীক্ষার ফলাফলে লবডঙ্কা (হালকা পড়া দিয়ে আর যাইহোক, কোন উত্তরই ভাল লেখা যায় না)। অর্থাৎ ‘ভাল রেজাল্ট’ বলতে যা বোঝায় তা কখনো করিনি। এমনকি এস এস সি, এইচ এস সি তেও না! এ নিয়ে নিজের কোন অনুতাপ ছিল না। কিন্তু ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষার আগে আগে দেখলাম আম্মার মনটা খারাপ। বেশ খারাপ। আমার বাকি তিন বোনই ছিল দেশের সেরা ইউনিভারসিটি গুলোর অন্যতম সেরা ছাত্রী। আমাকে নিয়েই যত দুশ্চিন্তা! বুঝতে পারছিলাম না কি করব। মোল্লা’র দৌড় মসজিদ পর্যন্ত আর আমার দৌড় রিডিং! তাই আর উপায় না পেয়ে মন দিয়ে রিডিং-ই পড়ে গেলাম। অবাক কাণ্ড জীবনে প্রথম তা কাজে দিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের পছন্দের বিষয়েই পড়ার সুযোগ পেলাম! রেজাল্টে ‘হতভম্ব আমি’ ভয়াবহ আনন্দিতও হলাম। আনন্দের ষোল কলা পূর্ণ করতেই যেন সিটের সেই আকালের দিনেও মফস্বলের আমি থাকবার জায়গা পেলাম আমার আশৈশবের স্বপ্ন সেই ‘রোকেয়া হলে’ই। চারপাশে তখন শুধু আনন্দ আর ভাল খবর। অবশ্য ‘হল জীবন’ শুরু করার আগে অনেকের অনেক নেতিবাচক কথাবার্তা শুনে ভয়ে কিঞ্চিত অস্থিরও হলাম; কেমন না কেমন রুমমেট পাব কে জানে! কত না ছোট জায়গায় কত না জানি চাপাচাপি করে থাকতে হবে! নভেম্বরের দিকে হলে উঠে পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম; নাহ ‘বৃহস্পতি আমার এখন তুঙ্গে’ গানটা আমিও গাইতে পারি গলা ছেড়ে! নইলে কি আর ট্রিপল বেডের সে রুমে দুজনই হয় ঢাকার বাসিন্দা! দুইজন হল-এ থাকে না, সুতরাং নামে ডাবলিং হলেও আমাকে সত্যিকারের ডাবলিং থাকতে হবে না। রুমে থাকা একমাত্র রুমমেট আপুটাও খুব ভাল। সারাদিন ক্লাস, ক্লাসমেটদের সাথে আড্ডা আর হলে ফিরে রুমমেট আপু এবং তাঁর অন্যান্য বন্ধুদের সাথে মধ্যরাত, কখনো কখনো আবার শেষ রাত পর্যন্ত অফুরান গল্প, হাহা … হিহি ও তাস খেলা। কিন্তু সুখের দিনে এবার আসলো বিপত্তি। একচ্ছত্র এ সুখ মনে হল চলে গেল পর করে। হঠাৎ হল-কর্তৃপক্ষ আমাদের নিউ বিল্ডিং এর প্রতিটা রুমেই গণরুমে থাকা মেয়েদেরকে জোরপূর্বক এটাচড করে দিলেন। নিউ বিল্ডিং এর আর সবার মত আমি এবং আমার রুমমেট আপুও যারপরনাই বিরক্ত হলাম। তাই সেই গণরুম থেকে উঠে আসা নতুন মেয়েটি কোনরকম স্বাগত সম্ভাষণ পেলো না তার নতুন আবাসে এসে। বরং যতরকম নেতিবাচক আচরণ সম্ভব তার সবই করলাম মেয়েটির সাথে। নিজেরা গল্প, হাসাহাসি করি কিন্তু তাকে সাথে নেই না; আমরা দুজন একসাথে খাই কিন্তু তাকে অফার করি না। হাউজ টিউটরদের ওপর টুকিটাকি বিবিধ যত রাগ ছিল আমাদের সব গিয়ে পড়ল নিউ বিল্ডিং এর প্রতি রুমে হঠাৎ এসে পড়া এই নতুন মেয়েগুলির ওপর। এখন মনে হলে লজ্জায় কুঁকড়ে যাই, ছিঃ! ছোট সে রুমের ভেতর চলাফেরা না হয় আরেকটুখানি সঙ্কুচিতই হয়েছিল; তা বলে আমারই বয়সী একটি মেয়ের সাথে প্রথম দু/তিন দিন ঠিকমত কথাই বলিনি। যেখানে তার কোনই দোষ নেই, হাউজ টিউটরদের নির্দেশে এমন অযাচিত হওয়া ছাড়া। যাহোক সেদিন ছিল শুক্রবার; সম্ভবত ও আমাদের রুমে আসার চতুর্থ দিন। ছুটির দিনে দুপুরে খালার বাসায় গিয়ে বিকেলে হল এ ফিরেছি। রুমে ঢুকতেই দেখি সে তটস্থ হয়ে একটা বই (আমার তখনকার ভীষণ প্রিয় বই) আমার বুক শেল্ফের যথাস্থানে রেখে দিল। উচ্ছ্বসিত আমি ভুলে গেলাম যে ও আমাদের শত্রুপক্ষ; জিজ্ঞেস করে বসলাম “কি আশ্চর্য! ‘আমি সুভাষ বলছি’ দেখছিলে? বাহ! এত বই থাকতে এইটাই পড়ছিলে! আচ্ছা, ‘সুভাষ বসু’ কি তোমারও খুব প্রিয়?” ব্যাস! সেই শুরু। এরপর অনেক্ষন আমরা থামতে পারিনি; একটানা শুধু সুভাষ-কথা আর কাহিনী।
পরিচিত, অপরিচিত সবার সাথেই আমার বকবক করার অভ্যাস। তাই এই ছটফটে আমি যে প্রচুর কথা বলি তা সবাই জানতো। কিন্তু ঐ শান্ত, স্নিগ্ধ, নিরিবিলি এবং একটু বাড়াবাড়ি রকমের সুন্দর মেয়েটিও যে এত কথা বলতে পারে তা কারোর কল্পনায় ছিল না! আমাদের দুজনের কথায় ‘ঢাকা-সিলেটের আন্তঃনগর রেলগাড়ি’ চলা শুরু হলে আশপাশের সবাই তাতে খুব অবাক হয়ে যেত। মুখচোরা সে মেয়েটি তার উনিশ বছর বয়সী জীবনের ষাট ভাগ কথাই নাকি বলেছিল আমার সাথে; ঐ একবছরেই। প্রথমদিকে আমাদের সব কথাই হত মূলত প্রিয় কোন বই কিংবা প্রিয় লেখক নিয়ে। আর বাকি কথা আমার ছোট্ট মফস্বল শহর সাতক্ষীরা এবং তার গ্রাম হলদিপুর (মংলা’র একটি গ্রাম) কে ঘিরে। কি আশ্চর্য এখনও তার নাম বলিনি! তার কথা বলতে গেলে আমি যে তার নামটাই বলি সবচেয়ে আগে। নাম আগে বলি কারণ কেউ যদি আমার এই ‘অদ্ভুত’ ‘অন্যরকম’ হারিয়ে যাওয়া বন্ধুটির খোঁজ বলে দিতে পারে! কিন্তু আজ বলিনি। যাক গিয়ে; ওর নাম সাজু। সাজু বিশ্বাস।
পরবর্তীতে আরো এক সিনিয়র আপু আসেন আমাদের ঐ নিউ বিল্ডিং ৩১ এ। তিনিও ছিলেন চমৎকার। আমাদের সবার সাথেই সবার খুব ভাব ছিল। ছিল বলছি কেন! ভাব তো এখনও আছে। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবারের যুগে সবার সাথে সবার নিয়মিত যোগাযোগও যে আছে। শুধু আমাদের কারোরই যোগাযোগ নেই সাজুর সাথে। তো যে কথা বলছিলাম- ‘ভাব’। আমাদের রুমমেটদের এই অভাবনীয় মিল/ভাব অন্যরুমের মেয়েদের কাছে বেশ একটু ঈর্ষার বিষয় তখন। সমবয়সী নাকি সমমনা নাকি অন্য কোন কারণে জানি না; আমাদের রুমমেট এই চারজনের মাঝেও আবার আমরা দুজন গল্প করতে করতে আলাদা হয়ে হারিয়ে যেতাম। প্রায়ই! নিজের সম্পর্কে যখন ও কিছু বলত আমি অবাক হয়ে শুনতাম! বিশ্বাস করা কঠিন মনে হত। যদিও আমি জানতাম এক চুলও মিথ্যা সে বলছে না। বলবে কিভাবে! মিথ্যা কিভাবে বলতে হয় তাই যে সে জানতো না! সাজু নাকি এমনই এক গ্রামের মেয়ে যেখানে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি (ওর সাথে আমার আলাপ যে সময়ে আমি তখনকার কথাই বলছি; এখন হয়তো অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে)। ট্যাপ অন করলে যে পানি আসে তা নাকি ও প্রথম দেখেছিল ওর জেলা শহরে; যেদিন সে এস এস সি পরীক্ষা দিতে গিয়েছিল। ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকা ওদের গ্রামে পৌঁছাতে নাকি কখনো কখনো এক সপ্তাহও পার হয়ে যেত। ওর বাবা- ই ছিলেন পরিবারের সবচেয়ে শিক্ষিত ব্যক্তি, যিনি স্কুল শেষ করলেও কলেজে পড়বার সুযোগ পাননি। এসবই সত্যি হতে পারে; এগুলোর কোনটাই অবিশ্বাস্য নয়। অবিশ্বাস্য লেগেছিল এই ভেবে যে, অমন জায়গায় অমন পরিবারে বেড়ে ওঠা একটা উনিশ বছর বয়সী মেয়ে কেমন করে এত ভেতরে ভেতরে তেজী, দৃঢ়চেতা, মন-মানসিকতায় চরম উদার এবং পরম আধুনিক হতে পারে! ও হ্যা, গ্রামের অত শত অভাব-অসঙ্গতির ভিড়েও কিছু পুরনো গল্পের বই এ ভর্তি ছোট্ট একটা আলমারি ছিল ওর স্কুলে (‘স্কুল-লাইব্রেরি’ হিসেবে)। অসাধারণ একজন অঙ্ক-স্যার ছিলেন ওদের হলদিপুর বিদ্যাপীঠে। আর সাজুর ছিল প্রাচীন দেখতে কিন্তু সত্যিকারের আধুনিক এক দিদিমা (অল্প বয়সে বিধবা; যার অধিকাংশ আত্মীয়-স্বজনই যুদ্ধের সময়ে বা পরবর্তীতে দেশ ছাড়লেও মেয়ে নিয়ে মাটি আঁকড়ে নিজের দেশেই থেকে গিয়েছেন), থাকতেন সাজুদেরই সাথে। যার সাথে সাজুর ছিল সীমাহীন সখ্যতা, যার হাতেই হয়েছিল সাজুর গান শেখার হাতে খড়ি। যিনিই সাজুর বাবাকে বুঝিয়েছিলেন তিন কন্যা জন্মানো মানেই বিপদ বা অভিশাপ নয়। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এই ‘মহীয়সী দিদিমা’ নাকি কখনো স্কুলের চৌকাঠ ডিঙোননি! সাজু যখন তার দিদিমা’র কথা বলতো, শুনতে শুনতে কেমন বিভোর হয়ে যেতাম। মনে হত “সাতকাহন” এর শেষ দিকে বদলে যাওয়া দীপা’র সে ঠাকুমা’র কথা শুনছি।
সাজু’র খুব ইচ্ছে ছিল কোন এক ছুটিতে আমি যেন ওদের হলদিপুরে যাই। হলদিপুরের মত সুন্দর কোন গ্রাম নাকি বাংলাদেশ তো বটেই সারা পৃথিবীতেই কোথাও নেই। ওর এই কথাটা অবশ্য আমি বিশ্বাস করতাম না। বলতাম ‘না তুমি ঠিক বলছ না! পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর জায়গা হচ্ছে সাতক্ষীরা!’ এমনিতে হাজারটা ছেলেমানুষি থাকলেও, আমার এ কথার পরে সে বেশ বিচক্ষণ ভঙ্গিতে বলত, ‘আরে শোন, সাতক্ষীরা হচ্ছে সেরা সুন্দর মফস্বল শহর আর হলদিপুর সবচাইতে সুন্দর গ্রাম’। এভাবে বলায় অবশ্য খুশি হয়েই মেনে নিতাম ওর কথা। তবে মিথ্যে বলব না আমার খুব যেতে ইচ্ছে হত। সত্যিই খুব যেতে ইচ্ছে হত স্বপ্ন-স্বপ্ন গ্রাম সে হলদিপুরে। কেমন যেন রূপকথার এক সোনালী-রূপালী গ্রাম মনে হত হলদিপুরকে। গাড় হলুদ হয়ে আসা ঘুম-ঘুম দুপুরগুলোয় ওখানে নাকি উদাস রাখাল বাঁশি বাজাতো। বাড়ির না ঘুমানো সদ্য কৈশোর পেরুনো যেকোন মেয়েই নাকি মন কেমন করা সে বাঁশীতে কল্পনার জল-তরঙ্গে ভাসতে বাধ্য (অবাক হতাম, আমাদের যান্ত্রিক কোলাহলের যুগেও এমন মিহি সুর আছে যা কাউকে ভাসাতে পারে!) হলদিপুরের পৌষ-মাঘের ভোরগুলোয় লাল-নীল চাদরে আষ্টেপৃষ্ঠে মুড়ে শীতে কাঁপতে কাঁপতে সব বাচ্চারা নাকি হাজির হত মেম্বার চাচা’র বড় উঠোনটিতে। একটু অবস্থাপন্ন এ বাড়ির উঠোনে বসে তারা সারি সারি উনুনের বিছানো পাতিলে খেজুরের রস জ্বাল দেয়া দেখত। গুড় হয়ে গেলে ওদের জন্য নাকি বেশ খানিকটা বেশিই লাগিয়ে রাখতেন মেম্বার চাচী বিরাট সে পাতিলগুলোয় (গুড়ের বড় অংশ যদিও বিক্রির জন্য পাটালি করতে নিয়ে যেতেন)। সারা পাড়ার সব ছেলে মেয়ে একযোগে শান দেয়া চকচকে ঝিনুকে কেখে কেখে সেই গুড় মুখে তুলত অমৃতের মত। সাজু বলেছিল পৃথিবীর সেরা গুড় নাকি শুধু ঐ মেম্বার চাচীর হাতেই হত। হলদিপুরের সন্ধ্যাগুলো ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়। সন্ধ্যার পর নাকি ওদের পাড়া’র সব বাচ্চাকাচ্চারা এক হয়ে এক দিন সাজুর দিদিমা, আরেক দিন রাহেলা’র দাদী তো অন্য আরেকদিন ময়না খালাম্মার কাছে হাজির হত, রূপকথার গল্প শুনতে। আর যে সন্ধ্যায় খুব করে জ্যোৎস্না নামতো, সারা গাঁ রূপালী রূপে রূপসী হত, সেদিন কোন গল্প নয়; সবাই নাকি গলা ছেড়ে সে সন্ধ্যায় গান গাইতো, কোন নিয়ম না মেনে যেমন খুশি তেমন করে…! নাহ আমার যাওয়া হয়নি; যাব যাব করেও যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তবে ঈদে/পুজোয়/গরমে ছুটিতে আমি সাতক্ষীরায় গেলে সে আমাকে চিঠি লিখত। চিঠি লিখত তার গ্রাম হলদিপুর থেকে। এখনো মনে আছে ঐ চিঠিগুলো থেকে ছিমছাম নিরিবিলি শান্ত দুপুরের অদ্ভুত এক হলুদ গন্ধ বের হত। খামটা ছিঁড়ে চিঠি বের করতেই ঐ নেশা-নেশা দুপুরের একরাশ গন্ধ আমার গায়ে মেখে যেত।
সাজুর সাথে আমার মিল ছিল অনেক; অমিলও ছিল শতেক। আমি হৈ হৈ করে সবার সাথে আড্ডা দিয়ে বেড়াতাম, সে অপেক্ষায় থাকত চুপচাপ একা ঘরের কোণে ঘুমিয়ে পড়বার। বরাবরই আমার একটু পরিপাটি থাকা পছন্দ, আর ও থাকতো এলোমেলো। নিজের ভেতরে বুঁদ হয়ে, নিজের মত করেই সে ছিল অসহ্য রকমের অগোছালো। নিজের বই-পত্র, কাপড় চোপড় কিছুই সে গুছিয়ে রাখতো না; সেজন্য দরকারের সময় ওগুলো হাতের কাছেও পেত না। আর তাই ক্লাস শেষে হল-এ ফিরে আমার একেক টা জিনিস একেক দিন দেখতাম পাওয়া যাচ্ছে না। ওকে কিছুতেই বোঝাতে পারতাম না যে অন্যের জামা কাপড়, খাতা, কলম, থালা-বাসন- হাঁড়ি-পাতিল ইত্যাদি সবকিছুই না বলে যখন তখন ব্যবহার করা যায় না। খুব মন দিয়ে সে শুনত; তারপর হাসত। হাজার বোঝালেও যে সে কিছু বুঝত তা কখনো মনে হয়নি। কারণ একই কাজ সে আবার করত; হয়তো পরের দিনই। প্রয়জনের সময়ে আমার জিনিস আমি হাতের কাছে না পেয়ে যখন বিরক্ত হতাম ওর ওপর, ও তখন খুব অবাক হয়ে বলত – ‘আরে নৌ, আমি কি সবার জিনিস এমন করে ব্যবহার করি? আমি তো শুধু তোমার টা করি!’ কি বলার থাকতে পারে এর পর! সাজু অনেক সিরিয়াস ছিল পড়ালেখায় , অনেক জেদ ছিল শুধু ভাল মেয়ে হিসেবে নয় পরিপূর্ণ এক মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলবার। তুখোড় নজরুল সঙ্গীত গাইত; একনিষ্ঠ কর্মী ছিল উদীচীর। আবার এই সাজুই বড় বেশি সরল ছিল কোন কোন ক্ষেত্রে। একদিনের কথা মনে পড়ছে। এক বইমেলায় ‘এটা আমার একার গল্প’ বইটা আমি আমার প্রিয় দুই জন মানুষের কাছ থেকে উপহার পেয়েছি। যারা দিয়েছে তাদের একজন- ‘প্রিয় বন্ধু এবং কাজিন এশা’, আরেকজন – ‘বিশেষ বন্ধু ইফতি’। দুজনই আমার কাছের মানুষ সেটা সাজু জানে এবং এও জানে বইটা আমার খুবই প্রিয়। বেশ কিছু ছোট গল্পের দারুণ এই বইটা পাওয়ার মাত্র এগারো দিনের ভেতর চারবার পড়ে ফেলেছিলাম! এখনো মনে আছে! যাইহোক সেই বই সাজুরও পড়ে খুব ভাল লেগে গেল। এবং এতই ভাল লেগে গেল যে আমাকে না জিজ্ঞেস করেই সে তার ফিঁয়াসে কে (যিনি কখনোই কোন গল্পের বই এক পৃষ্ঠার বেশি পড়তে পেরেছিলেন কিনা তা নিয়ে সাজু’রই যথেষ্ট সন্দেহ ছিল) বইটা পড়তে দিয়ে দিল। জানার পর থেকেই ক’দিন পরপর তাকে তাগাদা দেই, বই ফেরত নিয়ে আসতে। সাজুও বলে চলে ‘এখনো তো পড়া হয়নি পুষ্পজিৎ এর’। শেষমেশ মাস তিন/চার পরে সে বই ফেরত আসলো কিন্তু বই এর অবস্থা ততদিনে শতচ্ছিন্ন। আমি তো রেগে আগুন! সাজু সে আগুন পাত্তাই দিল না। কিছুক্ষন পর অবাক হলাম; আমার রাগ পাত্তা না দিলে কি হয়েছে সে নিজেও রেগে অস্থির! ওকে তো রাগতে দেখা যায় না। খুশি হয়ে ভাবলাম, যাক পুষ্পদা বই এর যত্ন নেয়নি বলে রেগেছে নিশ্চয়ই! কিন্তু না; নিজের মত করে রাগে গজগজ করছে আর বলছে, ‘চিন্তা করতে পারো, অনার্স ফাইনাল দিয়েছে যে মানুষ, হাতে যার অফুরন্ত সময় সেই মানুষ কি না এত চমৎকার একটা বই মাত্র চার পৃষ্ঠা পড়েছে! নৌ বলতে পারো কিভাবে ওঁর সাথে থাকব! গোটা একটা জীবন!!’ আমিও এবার চরম ক্ষেপে বললাম, ‘দিয়েছ কেন? আমার কত প্রিয় একটা বই উনি ছিঁড়ে কি জঘন্য করে ছেড়েছেন!’ সাজু তা নিয়ে মোটেই ভাবিত হল না; গটগট করে ক্যান্টিনের দিকে রওনা দিল। যাবার আগে শুধু নিজের মনে বলে গেল ‘ছিঁড়ে গিয়ে আর তেমন কি অসুবিধা হয়েছে! এখনও তো পৃষ্ঠা মিলিয়ে নিয়ে পড়া যাবে। আর তাছাড়া ও বই তো তোমার আছেও দুটো। সমস্যা যে অন্যখানে; এমন অসাধারণ ছোট গল্পের একটা বই যে সে পড়তেই পারল না’!
ও এমনই। চরিত্রের অদ্ভুত কিছু বৈপরীত্য নিয়ে ও বরাবর এমনই। নিজের বা পরের বলে নয়, কারো কোন কিছুতেই তার যত্ন নেই কখনো। কিন্তু মায়া ছিল, অসীম ভালবাসা ছিল সবার জন্য। মনে আছে আমি রান্নাবান্না তেমন কিছু পারতাম না। শুধু জরুরি প্রয়জনের ডিমভাজি, আলু ভর্তা, ঘুঁটা-ল্যাটল্যাটা-খিচুড়ি আর দু/একটা সহজ সব্জি ভাজিই ছিল আমার রান্নাবান্নার দৌড়। রুমের সবাই শেয়ার করে রান্না-বাজার করার কথা থাকলেও রুমমেটরা আমাকে বেশিরভাগ সময়েই বাঁচিয়ে দিত। আর সবচাইতে বেশি বাঁচাতো বোধ হয় সে’ই। কমার্স ফ্যাকাল্টির স্টুডেন্ট হওয়ায় সবসময় আমার পরীক্ষা লেগে থাকতো। লেগেই থাকতো, বারো মাসে তের পার্বণের মত! আমার পরীক্ষা মানেই ছিল শেষ মুহূর্তের হুড়োহুড়ি। রান্না-বাজারে অতি ফাঁকিবাজি তখন অতিরিক্ত লজ্জার বিষয় হয়ে যাবে ভেবে রুমে বলে দিতাম, এই চারপাঁচ দিন ডাইনিং এ খাব। আমার অমায়িক রুমমেটরা তা হাসিমুখে মেনে নিলেও, প্রায় দিনই খাওয়ার সময় এলে আর কিছুতেই কষ্ট করে ডাইনিং এ যেতে দিতেন না। আমার সব রুমমেটদের মাঝে সাজুই রুমে থাকতো সব থেকে বেশি। ওই তাই বেশি করত এমন জোর করে রেঁধে-বেড়ে খাওয়াবার কাজ টা। খুব অস্বস্তি লাগতো, এমন রোজ রোজ কাউকে কষ্ট দিচ্ছি ভেবে। কিন্তু কিছুই করার থাকতো না; যখন ওই আরামপ্রিয় এবং খানিক অলস সে মেয়েটি আমার সকাল আটটায় পরীক্ষা তাই খুব ভোরে নিজেই এলার্ম দিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে আমারই পছন্দের কিছু রান্না করত। জোর করেই আবার তা মুখে তুলে খাইয়েও দিত। খুব লজ্জা লাগতো, বলতাম ‘এরকম কর কেন সাজু? আমি তো তোমার জন্য এমন কিছু কখনোই করতে পারি না’! ও খুব অবাক হয়ে যেত; বলত, ‘তোমাকে কেন করতে হবে? আমার তো আর তোমার মত মায়ের হাতে তোলা খাবার খেয়ে পরীক্ষা দেবার অভ্যাস ছিল না’!
সাজু পড়ত আর্টস এর এক সাবজেক্টে। বিষয়টা ওর অত পছন্দের ছিল না। তাই পুরো ফার্স্ট ইয়ার জুড়েই সে আবার এডমিশন টেস্ট এর প্রিপারেসন নিচ্ছিল। হলে কি হবে, এর মাঝেও হতভম্ব হয়ে দেখি কম পছন্দের সেই সাবজেক্টেও সে ফার্স্ট ইয়ার ফাইনালে ‘ফার্স্ট ক্লাস’ পেয়ে বসে আছে! এখনো মনে আছে- কি যে অবাক হয়ে ছিলাম, কি যে ভাল লেগেছিল! আমরা ওকে প্রায়ই বলতাম, ভাল একটা পছন্দের সাবজেক্টে তুমি ঠিকই চান্স পাবে কিন্তু তখন যদি কর্তৃপক্ষ তোমার আবাসিক হল চেঞ্জ করে দেয়? ও বলত, ‘যাও! কক্ষনোই তা হবে না। আমি রোকেয়া হলেই থাকবো এবং নিউ বিল্ডিং ৩১ এই থাকব’! হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল। আমার অনেক চিঠি আসতো। সবসময়। ফ্লোরের সবাই এই নিয়ে ইয়ার্কি করে বলত, ‘পুরো রোকেয়া হলে যদি কোন দিন শুধু একটা চিঠিই আসে, আমাদের চিঠি বিলি করা দাদু ঠিকানায় চোখ না রেখেও চোখ বুজে নিউ বিল্ডিং-৩১ এর নৌ কেই সে চিঠি দেবেন’। সাতক্ষীরা থেকে আম্মা আর কাজিনরা, দেশের বাইরে থেকে মেজমামী আর ফুলমামা; লিখতেন একদম নিয়ম করে নিয়মিত। আমার ওপর সাজুর কঠিন নির্দেশ ছিল – মেজমামী আর ফুলমামা’র চিঠি এলে তা পেয়েই খাম ছিঁড়ে পড়তে শুরু করা যাবে না। রুমে সবাই ফিরলে তবে পড়তে পারব। সবাই মিলে একসাথে খুব মজা করে সেই রসিকতায় ভরপুর, আদরের চাদরে মোড়া চিঠিগুলো পড়তে পড়তে হঠাত ভুলে যেতাম আমরা রুমের এই চার মেয়ে চারটা ভিন্ন জেলার ভিন্ন পরিবারের চারটা মেয়ে! খুব করে ভালবাসতে পারা, চমৎকার করে আবার তা চিঠিতে প্রকাশ করতে পারা আমার সেই প্রিয় ফুলমামা আর প্রিয় মেজমামী কে কখনোই বলা হয়নি – তাঁরা সে চিঠিগুলো শুধু আমাকে লিখতেন না; লিখতেন নিউ বিল্ডিং ৩১ এ থাকা সবকটা মেয়েকেই! এবং যৌথ-আনন্দে বিহ্বল হবার সে ব্যবস্থাটি করেছিল আমার হারিয়ে যাওয়া অন্যরকম অদ্ভুত ভাল বন্ধু সাজুই।
এক গরমের দিনের কথা, রোকেয়া হলের বেশ নিরিবিলি একটা দুপুর। উচ্চস্বরে হাসাহাসি’র আড্ডা থামিয়ে হঠাৎ সিরিয়াস ভঙ্গিতে যখন সাজু বলল, “এই নৌ, তুমি আমার মনের বন্ধু হবে”? অবাক হয়ে আমিও একটু গম্ভীর মুখ করে, ‘হ্যা’ বলেই আরেক প্রস্থ হাহা… হিহি… করে নিলাম। বাচ্চাদের মত মন খারাপ করে ফেলল। বলল, ‘ঠাট্টা না, সত্যি বলছি। আসো না আমরা এমন মনের বন্ধু হই যাকে সব বলা যায়। যার সব কথা শোনা যায়! কোনদিন যার সাথে বিচ্ছিন্ন হতে না হয়’! মনে মনে হাতড়ে খুঁজলাম; নাহ সবসময় আমার অসংখ্য বন্ধু তবু মনের বন্ধু/প্রাণের বন্ধু কেউ কখনো ছিল না। ছোটবেলা থেকেই যার সাথে সম্পর্কটা বেশি হৃদ্যতায় যেত, তাকেই কেন জানি না স্কুল বদলাতে হত নয়তো বা তার বাবা-মা কে বদলি হতে হত। খুব মন খারাপ লাগতো। ভাবতে ভাবতে এবার আমিও সিরিয়াস হলাম। জানালাম, ‘না সাজু কারো অত কাছে যেতে ভাল লাগে না; সে হঠাৎ দূরে চলে গেলে তখন অনেক কষ্ট’। উত্তেজিত হয়ে জানালো, ‘আরে না, আমাদের দুজনের এত মিল! আমরা কখনোই দূরে যেয়ে থাকতে পারব না… …’! … আঠারো-উনিশ বছর বয়সেই মেয়েরা অনেক বড় হয়ে যায়। ছেলেমানুষির খোলস ছেড়ে বেশ পরিপক্ক মানসিকতার হয় তারা। তবু সে দুপুরে ‘রোকেয়া মূর্তি’র পাদদেশে বসা দুই তরুণী হঠাৎ আবেগপ্রবণ দুই কিশোরী হয়ে গিয়েছিল। চোখের দু/এক ফোঁটা পানি মিশিয়ে কঠিন এক প্রমিজও করে ফেলেছিল। তারা ঠিক করেছিল, তারা সারা জীবন বন্ধু থাকবে। সবসময় এমন কাছাকাছি থাকবে। সময়ে সবাই কত বদলে যায়; তারা কখনো বদলাবে না। তারা পড়া শেষে হলদিপুরে আর সাতক্ষীরায় ফিরে যাবে। তারপর নিজেদের শৈশবের সেই স্বর্গকে সত্যিকারের স্বর্গে পরিনত করবার (এখন সেগুলো অনেকের কাছেই বড্ড ছেলেমানুষি মনে হবে) হাজারটা রঙ্গিন পরিকল্পনাও তারা কি নিখুঁত ভাবে যে ছকে ছকে বেঁধে নিয়েছিল … তারা কখনো দেশ ছাড়বে না; চিরকাল এখানে এমনই থাকবে।
তারপর? তারপর খুব দ্রুত কিছু ঘটনা। এবং ধীরে ধীরে শুরু হল সাজু কে হারিয়ে ফেলা। এখন বুঝি প্রায় পুরো দোষটাই ছিল আমার। পরের বছরের এডমিশন টেস্টে যথারীতি ভাল রেজাল্ট করে পছন্দের সাবজেক্ট নিল। তারপরের কয়েকদিন বেশ আনন্দ উচ্ছাসে কাটলেও আমাদের আশঙ্কাই সত্যি হল। ও কুয়েত মৈত্রী হলে চলে গেল। কি যে মন খারাপ, কি যে বুক কেঁপে কেঁপে আসা অন্যরকম এক কষ্ট! ভাবতেই পারছিলাম না এইরুমে আমরা সবাই থাকব অথচ সাজু থাকবে না! যার না থাকার ভাবনা ভাবতেই পারছিলাম না, সেই তাকেই আমি হারিয়ে ফেললাম বলতে গেলে আমারই উদাসীনতায়, ব্যস্ততায়। ও আসতো, প্রায়ই আসতো। যেহেতু আমি একটু বেশিই বহির্মুখী ছিলাম ও এসে আমাকে হল এ তেমন পেত না। ছোট্ট একটা চিরকুট লিখে চাপা দিয়ে যেত আমার টেবিলে, আমার প্রিয় কোন বই দিয়ে। আমি হল এ ফিরে ওর অভিমানী চিরকুটটি পড়েই ডিসিসন নিয়ে ফেলতাম, আগামীকালই যাব ওর হল এ। কিন্তু ঢাকা শহর জুড়ে সব আত্মীয় স্বজনের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ, তাঁদের প্রতি বিভিন্ন দায়িত্ব-কর্তব্য, কমার্স ফ্যাকাল্টির লাগাতার ইনকোর্স, মলচত্বরে বন্ধুদের জোরাজুরির আড্ডা, আইবিএ’র ক্যান্টিনে বাজি ধরে ইন্টারন্যাশনাল ব্রিজ খেলা কিংবা ঐ সময়ের জীবনে আচমকা এসে পড়া কিছু জটিলতা – সব এসবই আমাকে ভয়ঙ্কর ভাবে দখল করে রাখতো। নিজে থেকে আর ওর কাছে যাওয়া হত না। দূরে থাকা আমার কাছের বন্ধুটি ক্রমশ অস্পষ্ট আর দূরের হতে লাগলো। কি জানি ‘সত্যিকারের আপন জন’ এর গুরুত্ব হয়তো তখনো দিতে শিখিনি। না কি ভেবে নিয়েছিলাম ও তো আছেই; থাকবে। কি জানি! আমার কাছে এভাবে একতরফা আসা কমিয়ে দিলেও তখনো একেবারে বন্ধ করেনি। ওর ফোন ছিল না। সেল ফোন সে সময়ও ছাত্রছাত্রী দের হাতে ব্যাপক আকারে আসেনি। আমি ফোন নিয়েই নম্বরটা ওকে দিয়ে রাখলাম। এবার ওর আসা একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল। মাঝে মাঝে শুধু ফোন করে। হল এ টাকা দিয়ে দাদুদের মোবাইল ফোন থেকে কল করা যেত। হঠাৎ একদিন বিকেলে একটা মেসেজ দিল পরিচিত কারো ফোন থেকে – ‘আমার খুব মন খারাপ। কাল আসবে? জানোই তো পুষ্পজিৎ এবং তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই এ শহরে… তুমি কাল আসবে? আমি অপেক্ষায় থাকবো … প্লিজ এসো, সারা দিনে যে কোন সময়ে’। বুকের ভেতর হুহু করে উঠলো! বুঝতে পারলাম গাফিলতির ফল ভাল হবে না। কোন সম্পর্কই একা টিকিয়ে রাখা যায় না। খুব কেমন যেন লাগতে শুরু হল – এই এত দিন বাদেও মন খারাপ হলে সাজু আমাকেই মনে করে? সেই বিকেলেই শাহবাগে ছুটলাম। ওর জন্য ওর প্রিয় লেখকের বই কিনে হলে ফিরে বইটাতে অনেক কিছু লিখলাম। উপহার দিতে গিয়ে বইতে কেউ এত কথা লেখে না। খুব হাস্যকর দেখায়! কিন্তু আমি জানি ও একটুও হাসবে না! ঘুমুতে যাবার আগ পর্যন্তই ওকে নিয়ে ভাবলাম; কি যে ভাললাগা সে ভাবনায় – প্রিয় বোন নাকি প্রিয় বন্ধু নাকি সব ভাল সম্পর্কের অদ্ভুত মিশেল এই সম্পর্ক সেসবই মূলত ভাবছিলাম। ঘুম ভেঙ্গে গেল মধ্যরাতে। ভীষণ হৈ হট্টগোলে। তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নেমে দেখি, সব মেয়েরা নিচে নেমে এসেছে। প্রভোস্ট, হাউজ টিউটর ম্যাডামরাও নিচে। পাশের শামসুন্নাহার হল থেকে চিৎকার-চ্যাঁচ্যাঁমেচি আর কান্নার শব্দ কাঁপিয়ে দিচ্ছে আকাশ-বাতাস-রোকেয়া হল এর দেয়াল। ৭১ -এ ২৫শে মার্চের রাতের পর এই প্রথমবারের মত (এবং আশা করি শেষ বার) পুলিশ ঢুকেছে মেয়েদের হল এর ভেতর। শুরু করেছে জঘন্য অত্যাচার। মেয়েদের অপরাধ তারা বর্তমান সেই সরকারের আমলে আগের টার্মের প্রভোস্ট কে হল এর দায়িত্বে রেখে দেবার আন্দোলন শুরু করেছিল। বোকা মেয়েরা বুঝতে পারেনি, যেই দলের সরকার সেই দলের দলীয় লোকেই ভর্তি থাকবে প্রশাসনের সব কিছু, যতই ভাল, দক্ষ বা যোগ্য মানুষ হন না তিনি, তাঁর পদে থাকার অধিকার হারায় দেশে ক্ষমতা বদলের সাথে সাথে। যাইহোক, এরপরের বিশাল আন্দোলনের ঘটনা সবার কম বেশি জানা। পরদিনই সব হল খালি করে দেয়া হয়। প্রত্যক্ষ আন্দোলনে জড়িয়ে থাকা আমরা কিছু মফস্বলের ছেলে মেয়ে বাদে ঢাকার বাইরের সবাই ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হল। থাকার জায়গা নেই যে! আন্দোলন করে সেই ভয়ঙ্কর ভিসি কে তাঁর পদ থেকে নামাতে পারলেও, আন্দোলনে আমাদের সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের জয় হলেও; আমি চিরতরে হারিয়ে ফেললাম আমার বন্ধুটিকে। প্রায় ৩/৪ মাসের অনির্দিষ্ট কালের বন্ধের পর ভার্সিটি খুললে ওর হলে গিয়ে ওকে আর পাইনি। পাইনি ওকে ওর ডিপার্টমেনটে , পাইনি খোঁজ ওর উদীচীর বন্ধুদের কাছে। তারপর কোনদিন আর কোন ফোন কলও তার আসেনি!
পরবর্তীতে সময় যত গিয়েছে, সাজু ততই আমার কাছে নতুন করে স্পষ্ট হয়েছে। এরপরের যাবতীয় সুখে,দুঃখে,নতুন ভাল বন্ধুত্বে কিংবা বন্ধুহীনতায় শুধু সাজুকেই মনে পড়েছে। প্রায়ই ভাবি একটা জলজ্যান্ত মানুষ কি এভাবে উধাও হতে পারে! কতভাবে যে তাকে খুঁজেছি, কত শত জন কে যে তার কথা জিজ্ঞেস করেছি! পেপারে মংলার কোন খারাপ খবর থাকলে ভয়ে ভয়ে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলি। পড়া শেষে নিশ্চিন্ত হই; নাহ আমার বন্ধু ভালই আছে। যেখানেই থাকুক মন বলে সে ভাল আছে। উইশফুল থিঙ্কিং কিনা জানি না কিন্তু মন এমনই বলে। লোকে বলে ফেসবুকে নাকি জীবিত যে কোন মানুষেরই সন্ধান পাওয়া যায়। আমিও পেয়েছি খুঁজে অনেক অনেককাল আগের হারিয়ে যাওয়া অনেক পরিচিত/বন্ধু কে। পাইনি শুধু সাজুকেই। অথচ সাজুকে পাওয়া যে দরকার! খুব ভাল করে স্যরি যে বলতেই হবে অন্তত একবার। মাঝে মাঝেই বড্ড অস্থির লাগে তাহলে কোনদিনই কি আর জানা হবে না কেন সেদিন যেতে বলেছিল। কেন ছিল সেদিন মন খারাপের হাহাকার! হয়তো হবে না। কতকিছুই তো হয় না জানা এই জীবনে; এই এক জীবনে! হয়তো এও থাকবে তেমনি।
তবে গত ৪/৫ মাস যাবৎ এ নিয়ে তেমন আর বিষণ্ণ হইনি। মন এক আশ্চর্য আশার আলো দেখতে পেয়েছে। ঠিক করেছি, এবার দেশে গিয়ে মংলায় ওদের হলদিপুরে যাব। ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছি; তো কি হয়েছে? গ্রামে গেলে ওর খবর ঠিক ঠিকই পাব। তাছাড়া আমি নিশ্চিত ও হলদিপুরেই আছে। আমি আমার প্রমিজ ভুললে কি হবে, সাজু নিশ্চয়ই তার কথা রেখেছে। এই ভাবনা আসার পর থেকেই কেমন যে একটা ভারমুক্তির মত হয়েছে! আহ সাজুর সাথে দেখা হবে, কি না জানি সে বলবে এতদিন বাদে দেখা হয়ে! আমি উড়ছি, মনে মনে গ্লানি মুক্তির আনন্দে উড়ছি। ভাসছি, ভালোলাগায় ভাসছি আর ভাবছি একজন আসল বন্ধু কতখানি আপন হতে পারে যার জন্য এত টান জমিয়েছি! কিন্তু এই গত সপ্তাহে; অভ্যাসবশত সেদিনও ফেসবুকের সার্চ বাটনে হাত চলে গেল। মনের অবচেতনেই বোধ হয় নামটা টাইপ করেছিলাম। করেই ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম! চিৎকার দিয়ে আনন্দে কেঁদে ফেললাম। আবার দেখলাম; হ্যা ঠিকই আছে এটা সাজু। এবার ফেসবুক থেকে সরে এসে মুহূর্তেই চোখ বুজে কিছু প্ল্যান করে নিলাম। ওর সাথে এখানে কোন যোগাযোগ করব না। এখান থেকে ঠিকানা, বিস্তারিত খবরাখবর জেনে ওকে চিঠি লিখব ঠিক আমি ওর হলদিপুরে পৌঁছার দুদিন আগে। সাজু সারপ্রাইজ পছন্দ করত। এখনও নিশ্চয়ই করে। কেমন না জানি সারপ্রাইজড হবে সে ভাবনা সাথে নিয়ে আবার ফেসবুকে ফিরলাম। হ্যা এই তো সাজু; এখনও সেই আগের মতই অনেক সুন্দর ঝকঝকে একটা মেয়ে। স্বাস্থ্য কি একটু ভাল হয়েছে? চোখের কোণের সেই কৌতুকময় হাসিটা অবশ্য নেই। চোখ-মুখ কি কিছুটা বিষণ্ণ মনে হচ্ছে? … ছবি দেখা বাদ দিয়ে প্রোফাইল ভালমত দেখতে শুরু করলাম। কিন্তু একি? এ আমি কি দেখছি? এ কিভাবে সম্ভব! ‘লিভস ইন কলকাতা’?? … সাজু তো এমন না, কিছুতেই না!
চিরতরে ইন্ডিয়ায় মেয়ের কাছে চলে যাবেন তাই হলের এক মাসি কে কিছু টাকা চাঁদা তুলে সাহায্য করায় যেই সাজু আমার উপর ভীষণ ক্ষেপেছিল (টাকা দিলে তাঁর এভাবে দেশত্যাগকে নাকি উৎসাহিত করা হয়); এ কি সেই সাজু? কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। মাথাটা মনে হল ভোঁ ভোঁ করে চক্কর দিয়ে উঠল। এতটা বদলে গেল ও! কিভাবে দেখা হবে ওর সাথে? তাহলে কি আর কোনদিন দেখা হবে না? খুব রাগ হল! রাগে অন্ধ হয়ে গিয়ে মনে মনেই অনেক ঝগড়া করলাম। সারাদিন মনে মনে বলে চললাম, সাজু তুমি ভয়ানক বদলে গেছ! ভয়ানক!
সারারাত কাটলো এলোমেলো দুঃস্বপ্নে। ভোরে ঘুম ভাঙতেই হঠাৎ সব বুঝতে পারলাম। স্লো মোশনে একে একে অনেক দৃশ্য মাথায় ঘুরে ফিরে আসতে লাগলো। নিয়মিত চলতে থাকা মানসিক/বস্তুগত আঘাতের কথা যদি বাদও দেই; পরপর বেশ ক’বারই নির্বাচন পরবর্তী ঘটনা কিভাবে ভুলে অন্ধ হয়ে ছিলাম! ধর্মের নামে রাজনীতি করা সুযোগসন্ধানীর দল জিতলেই কি বা হারলেই কি – ‘সেলেব্রেশন’ এর নামে ঘৃণ্য, জঘন্য অত্যাচারগুলো তো যায় তাদের উপর দিয়েই। নিজ দেশে সারাক্ষণ আতঙ্কিত পরবাসী হয়ে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকার চেয়ে চিরতরে দেশ ত্যাগই তো ভাল। অবশ্যই ভাল। কিন্তু একটাই জীবন, একটাই সে জীবন নিয়ে এই দেশে এই হলদিপুরেই যে সাজুর সব স্বপ্ন-আশা, সব ভালবাসা! আচ্ছা মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে ওখানেও কি গাইতে বসে, ‘খেলিছ এ বিশ্বালয়ে্……’? কল্পনার সাতরঙা পাখা মেলে আর কি সে গল্পের বই পড়তে পড়তে আচমকা থেমে চোখ বুজে ধ্যানীর মত বসে যাবে? কেউ তখন অবাক হয়ে তাকালে ও কি আর বলবে ‘উহ ডিস্টার্ব কোরোনা গল্পের এই দৃশ্যটা একটুখানি হলদিপুরে দেখে নিতে হবে’! ৩/৪ মাস টানা ঢাকায় থাকলেই যে সাজু’র দম বন্ধ বন্ধ লাগতো; ওর তখন বাড়ি যাওয়াই লাগত শান্তিমত নিঃশ্বাস নিতে। এখন ও কিভাবে নিঃশ্বাস নেবে? …ওকে আমি জানি। কতখানি ঝড়ে এলোমেলো হয়ে চলে গেল, সেটা তাই আন্দাজ করতেও ভয় পাচ্ছি। তাছাড়া কি লাভ আর তাতে! ও তো চলে গেছে, প্রচন্ড অভিমানে দেশ ছেড়ে চলে গেছে। তার বদলে আমার জন্য রাশি রাশি গ্লানি আর কষ্ট রেখে গেছে।
আমার কষ্টের পাহাড় সরিয়ে ওর জন্য ভাবতে বসলাম; কি করলে ও ভুলবে। বুকের খাঁজে খাঁজে আটকে থাকা বরফগুলো গলবে! খুব ইচ্ছে করছে ওকে খুব সুন্দর একটা চিঠি লিখতে। ও চিঠি পেতে ভালবাসত; এখনো বাসে নিশ্চয়ই! এই চিঠির প্রতিটা শব্দ আসবে আমার নিঃশ্বাস ফুঁড়ে ফুঁড়ে, বিশ্বাসে মুড়ে। যেই চিঠি পড়লেই এক ঝলকে ওর আমাকে মনে পড়বে, ১৩ বছর আগের দিনগুলোয় সে নিমিষে ফিরে যাবে! যেই চিঠি ওর বুকের জমাটবাঁধা কষ্ট অল্প একটু হলেও হালকা করে দেবে। ওর মন ভাল করে দিতে তাই নিজের এবং দেশের সবার সব অপরাধ একে একে গুছিয়ে নিলাম, সুদীর্ঘ এক চিঠি লিখলাম মনে মনে। সারাদিন চলল অনেক মোছামুছি, অনেক কাটাকুটি। শেষে সন্ধ্যায় ফেসবুক ওপেন করে সাজু বিশ্বাস টাইপ করলাম। আসছে না; বারবার টাইপ করছি তবু আসছে না। কিছুতেই আর গতকালের দেখা সাজুর সেই ফেসবুক আইডি টা আসছে না! বুঝতে পারলাম না; এ কিভাবে সম্ভব! আমি তাহলে ভুল দেখেছিলাম? নাহ, সেই মুখ সেই চোখের সেই সাজুই তো ছিল নাকি ফেসবুক থেকে চলে গেছে এখন? ভয়ঙ্কর অদ্ভুত এক মিশেল অনুভূতি হচ্ছে সেই থেকে! ঠিক বলে বোঝাতে পারবো না এ কেমন এক বিষাদময় যাতনা, পেয়েও হারিয়ে ফেলার হতাশা! অদ্ভুত এক ভারমুক্তির আনন্দও; সাজু’র না হারা! সাথে নতুন আরেক অনুভূতি – ‘স্বার্থপর আমাদের’কে চিনে ফেলার ‘লজ্জা’!!