দেশে যেসব সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটছে, তা পূর্বপরিকল্পিত। সরকার বা রাষ্ট্র কোনোভাবেই এর দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। সাম্প্রদায়িকতা বা সাম্প্রদায়িক হামলাকে যত দিন পর্যন্ত রাষ্ট্র ও প্রশাসন স্বীকার না করবে, তত দিন পর্যন্ত এর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হবে না।
‘সাম্প্রদায়িকতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এই বৈঠকের আয়োজন করে বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ।
সাম্প্রদায়িক হামলার পেছনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার, ১৯৭২ সালের সংবিধানের পূর্ণ বাস্তবায়ন, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনকে ক্রিয়াশীল করার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে রুখে দেওয়া এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুসহ সব নাগরিকের দায়িত্ব রাষ্ট্রের নেওয়ার বিষয় আজকের আলোচনায় উঠে এসেছে।
অনুষ্ঠানে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, যতগুলো ঘটনা ঘটছে, প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয় বিচ্ছিন্ন ঘটনা। অথচ কোনোটাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সবই একসূত্রে গাঁথা। এই সত্যটা রাষ্ট্র বা প্রশাসন কবে স্বীকার করে নেবে? যত দিন পর্যন্ত স্বীকার করবে না, তত দিন পর্যন্ত যথাযথ প্রতিষেধক ব্যবস্থা নেওয়াও সম্ভব নয়।
সাম্প্রদায়িক সংকট সমাধানে সংবিধান সংশোধন করে তাতে ধর্মনিরপেক্ষ নিয়ে আসা, দ্রুততার সঙ্গে আইন প্রয়োগ করা এবং যারা দায়ী, তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বলে মনে করেন অধ্যাপক মিজানুর রহমান।
সাম্প্রদায়িকতাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সমাজ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর নানা ধরনের নির্যাতনের পদ্ধতি অবলম্বন করা হচ্ছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম। পুলিশ ও প্রশাসনের ব্যর্থতা রয়েছে উল্লেখ করে ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ঘটনা ঘটার আগে পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না।
সাম্প্রদায়িক হামলার সময় জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সাবেক তথ্য কমিশনার অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, সাম্প্রদায়িক ঘটনার সমাধান রাজনৈতিকভাবে করতে হবে।
আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, সাম্প্রদায়িক সংকট সমাধানে রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে। রাষ্ট্রকে জাতিগত ও ধর্মীয় অন্যান্য সম্প্রদায়কে স্বীকৃতি দিতে হবে। তা নাহলে সংকটের সমাধান হবে না। অথচ সাম্প্রদায়িক হামলায় রাষ্ট্রকে দুঃখ প্রকাশ করতেও দেখা যায় না।
মধ্যবিত্তের আবেগ ও চৈতন্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন সাংবাদিক আবেদ খান। সাংবাদিক আবু সাঈদ খান বলেন, রাজনীতি ঠিক না হলে সমাজ ঠিক হবে না। সাম্প্রদায়িক শক্তি দলে ঢুকে গেছে। বাম দল দুর্বল হয়েছে এবং আওয়ামী লীগ পথ হারিয়েছে।
দেশে সাম্প্রদায়িক অবস্থার যা বর্ণনা করা হচ্ছে, অবস্থা তার চেয়ে ভয়াবহ উল্লেখ করে সাংবাদিক মোজাম্মেল বাবু বলেন, মানুষের মনোজগৎ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা উত্তরণে আরব সংস্কৃতির বদলে বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে হবে।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পূজা উদ্যাপন পরিষদের সভাপতি জে এল ভৌমিক। তিনি বলেন, ধর্ম অবমাননার নামে এ দেশে হিন্দুশূন্য করার প্রক্রিয়া চলছে। এটা বন্ধ করতে হবে। তা না হলে এই দেশ টিকে থাকতে পারবে না।
পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক চন্দ্রনাথ পোদ্দার বলেন, পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক হামলা, নির্যাতন–নিপীড়ন ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত রয়েছে। সাম্প্রদায়িক ঘটনার শেষ কবে হবে, আমরা কেউ কি বলতে পারি, প্রশ্ন রাখেন তিনি।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার, সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, সম্প্রীতি বাংলাদেশের আহ্বায়ক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সদস্যসচিব অধ্যাপক মামুন–আল মাহতাব, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস।