বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কেবল সরকারি, আধা-সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চাকরিজীবীরা অবসরের পর পেনশন সুবিধা পেয়ে থাকেন। কিন্তু দেশের সব কর্মক্ষম মানুষকে পেনশন সুবিধার আওতায় আইনে নতুন একটি আইনের প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশের সরকার।
সোমবার ‘সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা বিল-২০২২’ নামে একটি আইনের খসড়া সংসদে উত্থাপন করেছে সরকার। সেটি আইনে পরিণত হলে এবং পেনশন ব্যবস্থা চালু হলে বাংলাদেশের প্রাপ্তবয়স্ক যেকোনো নাগরিক এই পেনশন সুবিধা নিতে পারবেন।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, আগামী এক বছরের মধ্যেই সরকার এই পেনশন ব্যবস্থা চালু করতে চায়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা প্রায় সাড়ে আট কোটি। এর মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী রয়েছেন ১৪ লাখের কিছু বেশি। বিলটি আইনে পরিণত হলে অর্থাৎ সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হলে প্রায় আট কোটি ৩৫ লাখ মানুষ এই ব্যবস্থার আওতায় আসবেন।
নিয়ম অনুযায়ী, সংসদে উত্থাপনের পর এখন বিলটি অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিতে যাবে। সেখানে যাচাই বাছাইয়ের পর বিলটি সংসদে অনুমোদন দেয়া হলে আইনে পরিণত হবে।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে সবার জন্য পেনশন চালু করার অঙ্গীকার ছিল। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৬০ বছরের বেশি বয়সী নাগরিকদের জন্য সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর তাগিদ দেন।
খসড়া বিলে বলা হয়েছে, সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান, বেকারত্ব, ব্যাধি, পঙ্গুত্ব বা বার্ধক্যজনিত কারণে নাগরিকদের সরকারি সাহায্য দেয়া, বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই নিরাপত্তা বলয়ে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে এই সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা তৈরি করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু এখন ৭৩ বছর। ২০৩১ সালের মধ্যে দেশে দুই কোটির বেশি মানুষের বয়স হবে ৬০ এর উপরে। বর্তমানে বাংলাদেশে ৬৫ বছরের উপরে দরিদ্র বয়স্কদের ৫০০ টাকা করে মাসিক ভাতা দেয় সরকার। তবে ৬৫ বছরের উপরে ৪০ শতাংশের বেশি মানুষ কোনো ধরনের পেনশন ও বয়স্ক ভাতা কিছুই পান না।
সার্বজনীন পেনশন নিয়ে যা জানা যাচ্ছে
আইনের খসড়া থেকে জানা যাচ্ছে, প্রথমে একটি জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে। একজন চেয়ারম্যান ও চারজন সদস্যকে নিয়ে গঠিত সেই কর্তৃপক্ষের আওতায় সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হবে।
যেসব শর্তে পেনশন ব্যবস্থা চালু হতে পারে :
১. জাতীয় পরিচয়পত্রের ভিত্তিতে ১৫ থেকে ৫০ বছর বয়সী নাগরিকরা এই স্কিমে অংশ নিতে পারবেন।
২. বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশী নাগরিকরাও অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন।
৩. সরকার প্রজ্ঞাপন জারি না করা পর্যন্ত সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার বাইরে থাকবে। এ ধরনের চাকরিজীবীরা এর মধ্যেই অবশ্য সরকারিভাবে পেনশন সুবিধা পেয়ে থাকেন।
৪. প্রাথমিকভাবে সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তি স্বেচ্ছামূলক থাকবে। তবে পরে সরকার বাধ্যতামূলক করতে পারে।
৫. এই পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তি হওয়ার পর কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা প্রদান করলে পেনশন সুবিধা পাওয়ার যোগ্যতা হবে। চাঁদা দাতার বয়স ৬০ বছর পূর্তিতে পেনশন তহবিলে জমা ও মুনাফার বিপরীতে তিনি পেনশন পাবেন। ইলেকট্রনিক ফান্ড ব্যবস্থাপনায় গ্রহীতার কাছে পেনশন পৌঁছে দেয়া হবে।
৬. প্রত্যেক চাঁদাদাতার জন্য আলাদা আলাদা পেনশন হিসাব থাকবে।
৭. চাকরিজীবীরা চাকরি পরিবর্তন করলেও নতুন করে হিসাব খুলতে হবে না। নতুন কর্মস্থলের বিপরীতে তাদের আগের হিসাবই পরিচালিত হবে।
৮. পেনশন কর্তৃপক্ষ সর্বনিম্ন চাঁদার হার নির্ধারণ করে দেবে। এই চাঁদা মাসিক ও ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে, অগ্রিম বা কিস্তি আকারে জমা দেয়া যাবে। তবে চাঁদার হার কত হবে, তা এখনো নির্ধারিত হয়নি।
৯. কোন কারণে মাসিক চাঁদা জমা দিতে দেরি হলে জরিমানা হবে। পুরন জরিমানার টাকাসহ মাসিক চাঁদা জমা দিয়ে পেনশন হিসাব সচল রাখতে হবে।
১০. পেনশনারগন আজীবন, অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পেনশনের সুবিধা পাবেন।
১১.পেনশনে থাকাকালে ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই মৃত্যু হলে, তার নমিনি অবশিষ্ট সময় (মূল পেনশনারের ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত) মাসিক পেনশন পাবেন।
১২. পেনশন তহবিলে অন্তর্ভুক্ত হয়ে চাঁদা দেয়া শুরু করে ১০ বছর পার হওয়ার আগেই কেউ মারা গেলে, তার সব জমা টাকা মুনাফাসহ তার নমিনিকে ফেরত দেয়া হবে।
১৩. পেনশন তহবিলে জমা দেয়া টাকার ৫০ শতাংশ পর্যন্ত চাঁদা দাতা ঋণ আকারে উত্তোলন করতে পারবেন। তবে সেজন্য ফি দিতে হবে। পরে ফিসহ মূল টাকা আবার পেনশন তহবিলে ফেরত দিতে হবে।
১৪. পেনশন তহবিলে যে টাকা জমা দেয়া হবে, সেজন্য কর রেয়াত পেতে পারে। মাসিক পেনশন হিসাবে পাওয়া টাকাও করমুক্ত আয় থাকবে।
১৫. সার্বজনীন পেনশন পদ্ধতিতে সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অংশ নিতে পারবে। সেক্ষেত্রে কর্মী ও প্রতিষ্ঠানের চাঁদার অংশ জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে দেবে।
১৬. নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য পেনশন তহবিলে চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসাবে দেবে।
প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, সরকারি অনুদান, নাগরিকদের চাঁদা, বিনিয়োগকৃত অর্থের মুনাফা, প্রতিষ্ঠানসমুহের অংশগ্রহণের চাঁদা, ইত্যাদি নিয়ে পেনশন তহবিল গঠিত হবে। এক বা একাধিক ব্যাংক, পোস্ট অফিস এই পেনশন তহবিলের চাঁদা আদায়ের সম্মুখ অফিস হিসাবে কাজ করবে।
পেনশন তহবিল ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জগুলো কী?
বাংলাদেশে ২০১৯ সালে সকল বয়স্ক মানুষের জন্য একটি সার্বজনীন পেনশন স্কিম কিভাবে চালু করা যায়, সেনিয়ে একটি প্রস্তাব তুলে ধরেছিল বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ। সেজন্য একটি নির্দিষ্ট আইন এবং এর তহবিলের কার্যক্রমের জন্য আলাদা কর্তৃপক্ষ করার কথা বলেছিল সংস্থাটি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, যেভাবে সরকার বিশেষ কর্তৃপক্ষ গঠন, তহবিল ব্যবস্থাপনা এবং পেনশন ব্যবস্থার শর্তগুলো দিয়েছে, তা খুব ভালো উদ্যোগ। তবে এটা সব শ্রেণির মানুষের কাছে সঠিকভাবে তুলে ধরতে হবে।
তিনি বলছেন, ‘প্রথমত পুরো পেনশন ব্যবস্থার সুবিধার ব্যাপারে সবাইকে সুস্পষ্টভাবে জানাতে হবে যে কত চাঁদা দিলে কত টাকা পাওয়া যাবে। অনেকে হয়তো এখন অংশ নিলেন, পরবর্তীতে হয়তো কর্মহীন হয়ে গেলেন। সেজন্য সরকারের একটা ভালো ডাটাবেজ থাকতে হবে।’
‘আরেকটি বড় বিষয় হলো, এখানে তো বড় আকারের একটা ফান্ড হবে। সেটা কিভাবে ব্যবহার করা হবে, কিভাবে বিনিয়োগ করা হবে, সেটার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে,’ তিনি বলছেন।
পেনশন তহবিলের কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে বলে তিনি মনে করেন – প্রথমত, পুরো ব্যবস্থাকে ডিজিটাল প্লাটফর্মের মাধ্যমে নজরদারি করা। দ্বিতীয়ত, যে কর্তৃপক্ষ থাকবে, তারা যাতে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত ঠিকভাবে নিতে পারেন সেটা দেখা এবং তৃতীয়ত, স্বচ্ছতা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।