১৯০১ সালে ফরাসি কবি ও গদ্যকার সুলি প্রুদোমকে পুরস্কার প্রদানের মধ্য দিয়ে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের গোড়াপত্তন করা হয়েছিল। এর পর যেসব ফরাসি কবি ও লেখক নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন; তাঁদের মধ্যে প্রায় সবাই বাঙালি পাঠক সমাজের কাছে সুপরিচিত; যেমন মিস্ত্রাল, রম্যাঁ রল্যাঁ, আনাতোঁল ফ্রাঁস, অঁরি বের্গসনর, আঁদ্রে জিদ, আলবেয়ার কাম্যু, সঁ-ঝ পের্স, জঁ-পল সাত্রে, ক্লদ সিমো এবং লে ক্লেজিও। ২০১৪ সালে ঔপন্যাসিক পাত্রিক মোদিয়ানোকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। ফরাসিদের গৌরবোজ্জ্বল এ তালিকায় এ বছর যাঁর নাম সংযুক্ত হলো, তিনি ৮২ বছর বয়সী কথাসাহিত্যিক আনি আরনো (জন্ম ১৯৪০)। বলা হয়ে থাকে, গত ১০০ বছরের ফরাসি সাহিত্যে তাঁর অবদান পর্বতপ্রমাণ।
যদিও বাজিকরদের তালিকায় তাঁর নাম ছিল, কিন্তু সাহিত্যের পণ্ডিতদের কেউই ভাবেননি- এ বছর নোবেল পুরস্কার শেষাবধি আনি আরনোকে দেওয়া হবে। এর কারণ প্রায় সবার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল- ভৌগোলিক বিবেচনায় এ বছর নোবেল শিরোপার গন্তব্য হবে ইউরোপের বাইরে। এ বছর জাপানের হারুকি মুরাকামি, কেনিয়ার নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত সালমান রুশদির নাম ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হয়েছে। তবে গত বছর তানজানিয়ার লেখক আবদুলরাজাক গুরনাহ নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় সংগতভাবেই মনে হয়েছিল, নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গো এ বছরও বাদ পড়বেন।
নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পর সাংবাদিকরা যেসব প্রশ্ন করেছেন, তার প্রথমটি ছিল- কেন ইউরোপের বাইরে একজন কবি বা লেখককে এ বছরের জন্য নোবেল পুরস্কার দেয়া হলো না। সাধারণত নোবেল পুরস্কার ঘোষণার আগে নোবেলজয়ীর সঙ্গে ফোনে আলাপ করে নেওয়া হয়। এ বছর ব্যতিক্রম। আনি আরনোকে ফোনে পাওয়া যায়নি। অনুমান করা যায়, নোবেল নিয়ে এ বছর তাঁর কোনো প্রত্যাশা ছিল না। তবে ইতোমধ্যে পৃথিবীর বড় বড় সাহ্যিত্য পুরস্কার তিনি লাভ করেছেন। সম্ভবত টিভির খবর শুনে তিনি জেনেছেন যে, ইতোমধ্যে তিনি একজন নোবেল লরিয়েটে পরিণত হয়েছেন।
সুইডিশ একাডেমি সবসময় বিশ্বের সাহিত্যামোদীদের একটু চমক দিয়ে থাকে। গায়ক বব ডিলান বা বেলারুশিয়ার সাংবাদিক আলেক্সিয়েভিচ স্বেতলানাকে নোবেল দিয়ে তারা বিশেষ চমক সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু আনি আরনোর বিষয়ে সে কথা বলা যাবে না। কারণ এই লেখিকা ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘ক্লিনড আউট’-এর পর থেকে ক্রমাগত লিখে গেছেন এবং ফরাসিভাষী বিশ্বে পঠিত হয়ে ক্রমে ক্রমে বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন। ২০১৯-এ প্রকাশিত ‘দ্য ইয়ারস’ উপন্যাসটি তাঁকে এনে দেয় বিশ্বজোড়া খ্যাতি। সত্তরের দশক থেকে ফরাসি সাহিত্যে তিনি স্বকীয় একটি অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন। তাঁর উপন্যাসের ভিত্তিতে তৈরি চলচ্চিত্র ‘হাপেনিং’-এর জনপ্রিয়তা সুবিদিত।
দেখা যায়, লেখক জীবনের শুরু থেকেই আনি আরনোর ঝোঁক আত্মজৈবনিক কথাসাহিত্যের দিকে। লেখক জীবনের শুরুতে পরপর তিনটি আত্মজৈবনিক উপন্যাস রচনার পর তিনি তাঁর সাহিত্যের দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করেছেন। পরবর্তী তিনটি উপন্যাসকে collective autobiography বলা হয়ে থাকে। এগুলো হলো- ‘এক নারীর কাহিনী’, ‘একজন পুরুষের অবস্থান’ এবং ‘লজ্জা’। এ তিনটির মধ্যে যদিও তিনি তাঁর নিজের এবং পিতা-মাতার জীবনকে ্য করেছেন; একই সঙ্গে যে সামাজিক পরিমণ্ডলে তিনি বড় হয়েছেন, তাঁদের কথাও তুলে এনেছেন। উপন্যাসের চরিত্র সবাই তাঁর জীবনের অংশভাক।
তিনি নিয়মিত ডায়েরি লিখে থাকেন। ফলে উপন্যাস লেখার সময় স্মৃতির বিশ্বাসঘাতকতার ঝুঁকি থাকে না। এসব ডায়েরির অনেক অংশ তিনি গ্রন্থাকারে ইতোমধ্যে প্রকাশও করেছেন। দুটির নাম ‘আমি অন্ধকারে আছি’ এবং ‘হারিয়ে যাওয়া’। একটি গ্রন্থে তিনি ১৯৩০ থেকে দীর্ঘ ৩০ বছরের ফ্রান্সের সাংস্কৃতিক ইতিহাসকে উপজীব্য করেছেন।
আনি আরনোর দীর্ঘ জীবন নাটকীয় ঘটনাবলিতে পরিপূর্ণ; তা নয়। কিন্তু নিজ জীবনের ঘটনাগুলোকে তিন সর্বজনীন আবেদনসহ ধারণ করেছেন বিভিন্ন উপন্যাসের আখ্যানভাগে। প্রথম উপন্যাস ‘ক্লিনড আউট’ তাঁর নিজেরই অবৈধ গর্ভপাতের মর্মস্পর্শী কাহিনি। নিজের ক্যান্সার, মায়ের আলঝেইমার, তাঁর অসুখী দাম্পত্য জীবন- সবই তিনি উপজীব্য করেছেন। ‘এক তরুণীর গল্প’ শিরোনামীয় উপন্যসটি তাঁর কুমারীত্ব বিসর্জনের কাহিনি। তিনি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এটি কোনো ধর্ষণের ঘটনা ছিল না। ধর্ষণের ঘটনা হলে হয়তো অনেক আগেই এ নিয়ে লিখে ফেলতাম। তিনি বলেছেন, ‘আমি বাধা দিইনি- এ কথা স্পষ্ট মনে পড়ে।’ কার্যত নিজ জীবনের সবকিছুই তিনি তাঁর সাহিত্যের উপজীব্য করেছেন।
একজন লেখিকার জীবন তো সাধারণ মানুষ থেকে চমকপ্রদ কিছু নয়। সাধারণ মানুষের জীবনের আকাঙ্ক্ষা ও ব্যর্থতা, আদর্শ ও দুর্বলতা, উত্থান ও পতন, দুঃখ ও লজ্জা, অর্জন ও অপমান- সবই তাঁর উপন্যাসের কাহিনিতে স্থান পেয়েছে। জীবনের রূঢ় বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তোলার বিষয়ে তাঁর পক্ষপাত রয়েছে।
আনি আরনোর ভাষাভঙ্গি প্রাঞ্জল এবং পৃথিবীর পথে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ক্ষণে নানা মানুষের সঙ্গে পরিচয় এবং মিথস্ট্ক্রিয়ার ঘটনাগুলো তিনি তুলে ধরেছেন বিশ্বস্ততার সঙ্গে। জীবনের অভিজ্ঞতাকে তিনি সিঞ্চিত করেছেন কল্পনার প্রতিভা ও দার্শনিকতায়। ফলে তাঁর উপন্যাসের কাহিনির নোঙর সর্বদাই মানুষের জীবনের মধ্যে প্রোথিত থাকে। ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সর্বশেষ উপন্যাস ‘দ্য ইয়ং ম্যান’। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২৪। এগুলোর বাইরেও তাঁর অসংখ্য লেখালেখি রয়েছে।
আনি আরনো সম্যক অবহিত যে, আত্মজৈবনিক উপন্যাস ও আত্মজীবনী অভিন্ন নয়। আত্মজীবনী একজন মানুষের পুরো জীবনের নির্বাচিত স্মৃতি সংকলন। অন্যদিকে, আত্মজৈবনিক উপন্যাসে একজন লেখক স্বীয় জীবনের বিশেষ কোনো স্মৃতি বা ঘটনাকে অবলম্বন করে কাহিনিভাগ রচনা করেন। তাঁর দার্শনিক চিন্তা প্রতিফলিত হয় কথাসাহিত্যের অবয়বে। আদ্যোপান্ত আত্মজৈবনতা থাকলেও আনি আরনো তাঁর উপন্যাসগুলোকে সর্বজনীন করে তুলেছেন। আর এখানেই তাঁর বিশেষ কৃতিত্ব।