ভয়াবহ বন্যায় ভাসছে সিলেট। পানিবন্দি লাখ লাখ মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত লক্ষাধিক মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। শহরের পানি নামতে শুরু করলেও জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। নতুন করে বেশ কিছু এলাকাসহ জেলার প্রায় ৮০ শতাংশ এখনও পানির নিচে। তবে সিলেটের সাথে ঢাকার রেলযোগাযোগ চালু হয়েছে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় সিলেটের সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়েছে।
অন্যদিকে বৃষ্টি না হওয়ায় সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতির দিকে। গতকাল সকাল থেকেই শহরের বিভিন্ন এলাকায় জমে থাকা পানি নামতে শুরু করেছে। এর ফলে লোকজন বাড়ির বাইরে বের হওয়া শুরু করেছে। খুলেছে দোকানপাট। কেউ হাঁটুসমান পানি ডিঙিয়ে, কেউ বা নৌকায় চড়ে প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। প্রায় ৬০ ঘণ্টা পর বিকাল ৫টার দিকে টেলিযোগাযোগ স্বাভাবিক হয়েছে।
এদিকে সুনামগঞ্জ ও সিলেটে এবারের বন্যায় এসএসসি পরীক্ষার্থীসহ দুইজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান। তাদের একজন স্রোতে ভেসে গেছেন, অপরজন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে। রোববার দুপুরে সচিবালয়ে নিজের কার্যালয়ে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি।
সিলেটের জৈন্তাপুর, জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, কোম্পানিগঞ্জ, বিশ্বনাথ এবং ওসমানীনগরসহ সবগুলো উপজেলা এখন পানিতে টইটুম্বুর। সেসব অঞ্চলের বাসিন্দারা বলছেন, এতো প্রবল স্রোত এর আগে কখনোই দেখা যায়নি। রাস্তাঘাট তলিয়ে যাবার পর পানি ঢুকেছে বাড়িঘরেও। চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। আটকে পড়াদের উদ্ধারের পাশাপাশি দুর্গত এলাকায় ত্রাণ দিচ্ছে সেনা ও নৌবাহিনীর সদস্যরা।
সিলেট শহরের একাংশে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু হলেও, বন্যাদুর্গত এলাকায় এখনও বিদ্যুৎ নেই। এতে বিঘিত হচ্ছে মোবাইল ও ইন্টারনেট যোগাযোগ।
শনিবার (১৮ জুন) রাত থেকে গতকাল রোববার সকাল পর্যন্ত বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় কিছু জায়গায় পানি কমেছে। তবে সিলেটের নদীগুলোর উজানে পানি বাড়ায় বিকেলে ভাটিতে পানি বাড়ার আশঙ্কা আছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, আজ ও কাল মঙ্গলবার দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতির দিকে যাবে।
সিলেটের বিভিন্ন সড়ক থেকে পানি কিছুটা নেমে গেছে। নিচতলা থেকে পানি সরে যাওয়ায় বিদ্যুৎ সংযোগ পুনঃস্থাপিত হয়েছে এম এ জি ওসমানী হাসপাতালে।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, সিলেট সদরের দিকে নদীর পানি কিছুটা কমলেও উজানে পানির উচ্চতা বেড়েছে। রোববার সকাল ৯টায় সিলেট জেলায় সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ১৪৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, যা শনিবারের চেয়ে ৩৫ সেন্টিমিটার বেশি।
তবে সিলেট শহর পয়েন্টে এ নদীর পানি বিপদসীমার ৬৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, যা শনিবারের চেয়ে ২৫ সেন্টিমিটার কম।
এদিকে গতকাল শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, সুনামগঞ্জ পৌর এলাকার হাসন নগর, ষোলঘর, বিলপাড়, নতুন পড়া, মরাটিলাসহ বিভিন্ন এলাকার পানি কমে এসেছে। দুপুরের দিকে আকাশে সূর্য উঠতে দেখা গেছে। তবে বন্যা পরিস্থিতির খানিকটা উন্নতি হলেও খাদ্যসামগ্রী ও সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ জানিয়েছে, বন্যার কারণে অনেক মিটার ও এমডিবি বক্স ডুবে থাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করা হচ্ছে না। বিভিন্ন এলাকার মিটার পরিদর্শন করা হচ্ছে, পানি নেমে গেলে সোমবার (আজ) বিকালে বিদ্যুৎ চালু করা হতে পারে।
এর আগে গত বুধবার (১৫ জুন) ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিপাতে সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) রাতে পানির উচ্চতা বাড়তে থাকায় একে একে প্লাবিত হতে থাকে সুনামগঞ্জ পৌর শহরের ঘরবাড়ি। বহু ঘরবাড়িতে বুকসমান পানিতে আটকে পড়েন মানুষ। বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটার সাথে সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বিদ্যুৎ সংযোগ। দুর্ঘটনা এড়াতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয় বিদ্যুৎ বিভাগ। বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইল অপারেটরগুলোর টাওয়ারও বিকল হয়ে পড়ে। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ৪টা নেটওয়ার্ক না থাকায় সারাদেশ থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সুনামগঞ্জ। পানি উপচে তলিয়ে যায় সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক। ফলে সড়কপথেও সুনামগঞ্জে যোগাযোগ স্থাপনের পথ বন্ধ হয়ে যায়।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় জানিয়েছে, বন্যাকবলিতদের উদ্ধারের পাশাপাশি খাদ্যসামগ্রী বিতরণ চলছে। ৪ লক্ষ মেট্রিক টন চাল ও অন্যান্য শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। সব আশ্রয় কেন্দ্রে রান্না করা খাবার দেওয়া হচ্ছে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন ও সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র নাদের বখত মাঠে রয়েছেন। তারা বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শনের পাশাপাশি ত্রাণ নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন।
সিলেটে সেনাবাহিনী প্রধান
সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ ত্যাগের মানসিকতা নিয়ে আন্তরিকতার সাথে কাজ করার জন্য সেনাবাহিনীর সদস্যদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। গতকাল রোববার সিলেটের বিভিন্ন বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শন ও ত্রাণ বিতরণকালে তিনি সেনা সদস্যদের প্রতি এ আহবান জানান।
পরিদর্শনকালে সেনাবহিনী প্রধান কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাইটেক পার্ক ও নিকটবর্তী বন্যা কবলিত এলাকায় বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেন এবং বন্যা কবলিত মানুষদের সাথে কথা বলেন।
এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মাস্টার জেনারেল অফ অর্ডন্যান্সের মো. আবু সাঈদ সিদ্দিক, জিওসি ১৭ পদাতিক ডিভিশন মেজর জেনারেল হামিদুল হক, সেনাসদরের ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাগণ, সিলেট জেলার পুলিশ সুপার এবং গণমাধ্যম কর্মীবৃন্দ ।
সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ সেনাবাহিনীর সদস্যদের নিরলসভাবে উদ্ধার তৎপরতা অব্যাহত রাখা, জরুরী ত্রাণকার্য পরিচালনা, চিকিৎসা সহায়তা প্রদান এবং বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় সর্বাত্মকভাবে আত্মত্যাগের মাধ্যমে সহায়তা করতে নির্দেশনা প্রদান করেন।
সেনাবাহিনী প্রধান উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় সকলকে এগিয়ে আসার আহবন জানিয়ে আরো বলেন, আমরা সবাই মিলে যদি সম্মিলিতভাবে কাজ করি এই দুর্যোগ মোকাবেলা করতে পারব। তাই সেনা সদস্যদের সর্বাত্মকভাবে ত্যাগের মনোভাব নিয়ে আন্তরিকতার সাথে কাজ করতে হবে। এছাড়া বন্যা পরবর্তী সময়েও সকল ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন সেনাবাহিনী প্রধান।
তার নির্দেশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অনান্য সকল অঞ্চলের পরিস্থিতি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করছে এবং অসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। সেনাবাহিনী প্রধান বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত জাতির আস্থার প্রতীক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে এই মানবিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখার নির্দেশনা প্রদান করেছেন।