ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে গত মাসে বন্যা পরিস্থিতিতে তীব্র দুর্ভোগের রেশ কাটতে না কাটতেই সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলায় ফের বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জির ভারী বর্ষণে সৃষ্ট ঢলে সিলেট ও সুনামগঞ্জের বহু এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। গতকাল বুধবার (১৫ জুন) পর্যন্ত এই দুই জেলার ১২টি উপজেলার অন্তত ৪ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অনেক রাস্তাঘাট ডুবে গিয়ে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফসলেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।এদিকে গত কয়েক দিনের মতো গতকাল বুধবার ভোর থেকে অবিরাম বৃষ্টিপাত হচ্ছিল। এরই মধ্যে বহু গ্রাম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। অনেক বাসাবাড়িতে পানি উঠে রান্নার চুলা ডুবে গেছে। বুধবার সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখার সময়েও সিলেটে আকাশ কালো করে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। এর আগে দুপুরের দিকে সুরমা নদীর পানি উপচে সিলেট নগরীর অভিজাত এলাকা উপ-শহর, কাজীরবাজারসহ নদী তীরবর্তী এলাকায় আবারও পানি ঢুকতে শুরু করে। নগরীর বিভিন্ন এলাকার বাসাবাড়ি ও দোকানপাটে ইতিমধ্যে পানি প্রবেশ করেছে। নগরীর পাইকারি বাজার কালিঘাট ও মহাপট্টিতে নদী তীরবর্তী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে গেছে। সিলেটের সীমান্তবর্তী কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলার তিন শতাধিক গ্রাম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্লাবিত হয়েছে।সুনামগঞ্জ জেলা শহরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় পানি উঠেছে। তাহিরপুরে বন্যায় বহু জনপদ প্লাবিত হয়েছে। ছাতক পৌর শহরের প্রধান সড়ক তাহিরপ্লাজার সামনে হাঁটুপানি। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানসহ শহরের সব চুনশিল্প কারখানা, ক্রাশার মিল বন্ধ রয়েছে। সুরমা নদীতে নৌকা-কার্গো লোডিং ও আন লোডিং বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে শত শত শ্রমিক এখানে বেকার। সুনামগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক ইত্তেফাককে বলেন, চলমান বন্যায় তার নির্বাচনি এলাকায় প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সরকার সহায়তা দিচ্ছে। আরো দেওয়া হবে।পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, বুধবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় চেরাপুঞ্জিতে ৮১২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। আর সিলেটের জাফলংয়ে ২৩৮ মিলিমিটার ও লালাখালে ২২৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। বুধবার বেলা ৩টায় কানাইঘাটে সুরমা ১ দশমিক ১৪ সে. মিটার, সিলেট শহরের কাছে ৮ সে. মিটার, কুশিয়ারা অমলসিদে ১ দশমিক ২৩ সে. মিটার, ফেঞ্চুগঞ্জে ১৭ সে. মিটার, সারি নদী ৫৫ সে. মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। শেওলায় কুশিয়ারার পানি বিপত্সীমার কাছে পৌঁছেছে।এতে সুরমা, কুশিয়ারা, বৌলাই, পাঠলাই, সারি, গোয়াইন, লোভা নদীসহ সবকটি পাহাড়ি নদী দিয়ে পানি প্রবল বেগে ভাটির জনপদ প্লাবিত করছে। কিন্তু নিচের দিকে পানি সেভাবে নামছে না বিধায় গ্রাম-জনপদ ডুবছে। এতে নদীভাঙন ত্বরান্বিত করছে।বন্যাকবলিত সিলেটের গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তা, জাফলং, কানাইঘাট, বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ। গোয়াইনঘাট উপজেলা সদরের সঙ্গে সবকটি ইউনিয়নের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ৯০ শতাংশ মানুষ পানিবন্দি। উপজেলার সদর, পূর্ব ও পশ্চিম জাফলং, মধ্য জাফলং, পূর্ব ও পশ্চিম আলীর গাঁও, রুস্তমপুর, তোয়াকুল, লেংগুড়াসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের মানুষ কষ্টে আছেন। কানাইঘাট পৌর শহরের পূর্ব বাজারে পানি প্রবেশ করায় অনেক দোকানপাট তলিয়ে গেছে। সীমান্তবর্তী উপজেলা জকিগঞ্জের নিম্নাঞ্চলের গ্রামগুলোতে শত শত মানুষ পানিবন্দি। কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার রাস্তাঘাট তলিয়ে গেছে।সুনামগঞ্জে পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। বুধবার দুপুরে সুরমা নদীর পানি বিপত্সীমার ৩৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, সুরমাসহ জেলার সবকটি নদীর পানি বেড়েছে। এরই মধ্যে জেলার পাঁচটি উপজেলা বন্যা আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। সুনামগঞ্জ সদর, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, দোয়ারাবাজার ও ছাতকসহ পাঁচটি উপজেলার অন্তত ২ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অনেক স্থানের বাড়ির রান্নাঘরে পানি ওঠায় তাদের খাওয়া-দাওয়ার সমস্যা হচ্ছে। সুনামগঞ্জ পৌর শহরের সাহেব বাড়ি ঘাট, উত্তর আরপিননগর, পুরানপাড়া, বড়পাড়া এলাকার রাস্তাঘাট বানের পানিতে ডুবে যাওয়ায় যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। পানিবন্দি মানুষ জানান, ঢলের পানি ঘরের ভেতরে ঢুকে চুলাও পানির নিচে তলিয়ে গেছে। অনেকে আবার টিনের বড় ড্রামগুলোকে নৌকা হিসেবে ব্যবহার করে সেগুলো দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হচ্ছেন। সুনামগঞ্জের ১২টি উপজেলায় ইতিমধ্যে ২০ মেট্রিক টন করে খাদ্যসামগ্রী বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহুরুল ইসলাম জানান, সুনামগঞ্জে আরো দুই দিন বৃষ্টিপাত থাকবে।
ছাতক সংবাদদাতা জানান, বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে অনেক ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির, মৎস্য খামার, গ্রামীণ রাস্তাঘাট ও হাটবাজার। উপজেলার সর্বত্রই এখন বন্যার পানি থইথই করছে। সুরমা, পিয়াইন, চেলা নদীসহ সব নদনদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। শহরের অদূরে রহমতবাগ এলাকায় তলিয়ে গেছে ছাতক-সিলেট সড়ক। দুপুর থেকে সিলেটসহ সারা দেশের সঙ্গে ছাতকের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ছাতক-দোয়ারা সড়ক, আমবাড়ী, জাউয়া, নোয়ারাইবালিউরা, নরশিংপুর, চৌমুহনী বাজার, কৈতক-হায়দরপুর, জালালপুর-লামারসুলগঞ্জ, জাউয়া-বড়কাপন মুক্তিরগাঁও, লাকেশ্বর, মাদ্রাসা বাজার সড়কসহ গ্রামীণ সবকটি সড়কে পানি।
তাহিরপুর সংবাদদাতা জানান, বন্ধ হয়ে গেছে উপজেলা সদরের সঙ্গে আন্তঃ সড়ক যোগাযোগ। তাহিরপুর-সুনামগঞ্জ সড়ক বন্ধ হয়ে পড়েছে। হাওরের ঢেউয়ের কবলে ভাঙছে বাড়িঘর।