চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি এলাকার বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের দুই দিন পরও ধোঁয়া বের হচ্ছে। আগুন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এলেও পুরোপুরি নেভেনি। গতকাল সোমবারও তাই ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা আগুন নিভিয়ে ফেলার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেননি। গতকাল সতর্কতার সঙ্গে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে আগুন নেভানোর কাজ করা হয়।
কোথাও বিস্ফোরক আছে কি না, তা-ও তল্লাশি করে দেখা হয়।
এদিকে এই অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা সংশোধন করে জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, মৃত ৪১ জনের মধ্যে ২৫ জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
গতকাল আগুন নিয়ন্ত্রণে না আসায় আলামত যাচাই করে বিস্ফোরণের কারণ নিশ্চিত হতে পারেননি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তবে তদন্ত কমিটির সদস্যরা এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছেন। দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলছেন, ঘটনায় কোনো পক্ষের অবহেলা বা ত্রুটি থাকলে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
গতকাল দুপুর ২টার দিকে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। পরে তিনি আহতদের দেখতে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যান। সেখানে সাংবাদিকদের বলেন, যে অপরাধ করেছে, আইন অনুযায়ী তার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখানে যে দুর্ঘটনা ঘটেছে তার তদন্ত করা হচ্ছে।
গতকাল তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহ্মুদ, দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহ্মুদ ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তাঁরাও বিষয়টির নেপথ্য কারণ খতিয়ে দেখে কোনো গাফিলতি পেলে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন।
তবে গতকাল বিএম কনটেইনার ডিপোর মালিকপক্ষ বিস্ফোরণের ঘটনাকে নাশকতা বলে দাবি করেছে। তারাও ঘটনার তদন্তের তাগিদ দিয়েছে।
আগুন নেভানোর চেষ্টা চলছে
আগুনের পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল উদ্ধার তৎপরতা চলাকালীন দুর্ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফুল ইসলাম জানান, ভেতরে আরো চারটি কনটেইনারে রাসায়নিকের সন্ধান পাওয়া গেছে। এগুলো আলাদা করে রাখা হয়েছে।
কনটেইনারগুলো আলাদা করে রাখার সময় আবারও বিস্ফোরণের আশঙ্কায় দুর্ঘটনাস্থলের আশপাশ থেকে সংবাদকর্মী, প্রশাসনের কর্মকর্তা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদেরও নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে দেওয়া হয়।
উদ্ধারকারীরা জানিয়েছেন, গতকাল বিকেল থেকে আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও রাত ৯টা পর্যন্ত পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা দেওয়া হয়নি। দিনে বিভিন্ন স্থানে কাপড়ের স্তূপে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। সন্ধ্যার পর সেসব জায়গায় তল্লাশি চালানো হয়। তখনো ধোঁয়া উঠতে দেখা গেছে। দিনভর কনটেইনারগুলো আগুনের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। রাসায়নিক থাকায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ধীরে ধীরে পুরো এলাকা বিপদমুক্ত করার চেষ্টা করেন। গত রাত পর্যন্ত পাঁচটি বড় ইউনিটের আগুন নেভানো, তল্লাশি ও রাসায়নিক সরানোর কাজ চলছিল।
বিকেলে বৃহত্তর কুমিল্লা ফায়ারস্টেশনের সহকারী পরিচালক মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, আগুন যেখানে জ্বলছে সেখানে কাপড়ের স্তূপ আছে। এর ফাঁকে রাসায়নিক বা বিস্ফোরক আছে কি না, তা দেখে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। ’ রাত পৌনে ৯টার দিকে সীতাকুণ্ড ফায়ারস্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার নূরুল আলম দুলাল বলেন, ‘এখন তেমন আগুন নেই। তবে ধোঁয়া আছে। পুরোপুরি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আগুন নিভে যাওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হবে না। ’
এলাকাবাসী আতঙ্কিত
গতকাল সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, উৎকণ্ঠা ও কৌতূহল নিয়ে গতকালও স্থানীয় লোকজন দুর্ঘটনাস্থলের কাছে ভিড় করেছে। সোনাইছড়ির কেশবপুর গ্রামের বাসিন্দা কৃষক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘শনিবার থেকে আগুন জ্বলছে। এই কয়েক দিন যতবারই খবর নিয়েছি ততবারই বলা হয়েছে যে আগুন নিভছে না। কেন এই আগুন নিভছে না তা আমরা বুঝতে পারছি না। এখন তো আমরা রাতে নিরাপদে ঘুমাতেও পারছি না। শনিবার রাতে ঘুমে থাকা অবস্থায় কয়েক হাজার ঘরবাড়ির দরজাজানালা যেভাবে ভেঙে উড়ে গেছে তাতে এখন আবার যদি বিস্ফোরণ ঘটে তাহলে কী হবে তা আল্লাহই জানেন। ’
মোল্লাপাড়ার বাসিন্দা আজগর আলী বলেন, এখন তো আরেক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। এলাকায় এমনিতেই ছিল পানির সংকট। তারপর ফায়ার সার্ভিস পাম্প লাগিয়ে পানি তুলে নিতে নিতে ডিপোর পাশের কয়েকটি পুকুর, ডোবাসহ পাঁচ-ছয়টি জলাশয় পানিশূন্য হয়ে গেছে। এখন সামান্য আগুন লাগলেও নেভানোর পানি নেই।
সীতাকুণ্ডের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন বলেন, এই অগ্নিকাণ্ডে এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যে শনিবার থেকে গতকাল সোমবার বিকেল পর্যন্ত কখন আবার কী হয়—এমন একটি দুশ্চিন্তা মাথায় কাজ করছিল। তবে গ্রামবাসীর নিরাপত্তাসহ সব বিষয় মাথায় রাখা হয়েছে।
বিস্ফোরক আলামত সংগ্রহ করা হবে
বিস্ফোরণের আলামত সংগ্রহ করতে দুর্ঘটনাস্থলে গেছে অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক ইউনিটের ক্রাইম সিন দল। বিস্ফোরক পরিদপ্তরও আলামত যাচাই করবে বলে জানা গেছে। জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটিও আলামত পরীক্ষার প্রতিবেদন দেখবে। তবে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ডিপোর ভেতরে আগুন ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা থাকায় পরীক্ষার আলামত সংগ্রহ করা যায়নি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ডাম্পিংয়ের জন্য অপেক্ষা করছেন। তবে ফায়ার সার্ভিস প্রাথমিকভাবে কিছু রাসায়নিক কনটেইনার ও আগুনের আলামত নিয়ে পরীক্ষা শুরু করেছে।
সিআইডির ফরেনসিক ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার রোমানা আক্তার বলেন, ‘আগুন নিয়ে কাজ চলায় আমরা আজ (গতকাল) বিকেল পর্যন্ত ক্রাইম সিনের আলামত নিতে পারিনি। ডিএনএ পরীক্ষার আলামত নিয়ে কাজ করছি। আমাদের ক্রাইম সিন টিমও সেখানে আছে। ’
হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড নেই বিস্ফোরকের তালিকায়
হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের কারণে বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের সময় বড় ধরনের বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই রাসায়নিক উপাদান বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। তবে এই উপাদান বিস্ফোরক পরিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণের বাইরে আছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক মোহা. নায়েব আলী গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড আমাদের নিয়ন্ত্রণ আইটেমের তালিকায় নেই। ফলে এটা আমাদের নজরদারির বাইরে। ’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সেখানে অন্য কোনো বিস্ফোরক ছিল কি না, বা কারণ কী, সেটা নিয়ে আমরাও কাজ করছি। আমাদের চট্টগ্রামের পরিদর্শক তদন্ত কমিটির সদস্য। আগুন নিয়ন্ত্রণ-পরবর্তী সময়ে আমরা আলামত সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে দেখব। ’
এখনো নিখোঁজ ফায়ার সার্ভিসের তিন সদস্য
ফায়ার সার্ভিসের নিহত ৯ কর্মীর মধ্যে গতকাল সর্বশেষ একজনের লাশ শনাক্ত করা হয়েছে। তাঁর নাম ইমরান হোসেন মজুমদার। তিনি কুমিরা ফায়ারস্টেশনে কর্মরত ছিলেন। গতকাল পর্যন্ত আরো তিনজন ফায়ারকর্মী নিখোঁজ আছেন। তাঁরা হলেন কুমিরা ফায়ারস্টেশনের ফায়ারফাইটার শফিউল ইসলাম, সীতাকুণ্ড ফায়ারস্টেশনের ফায়ারফাইটার রবিউল ইসলাম ও ফরিদুজ্জামান।
ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা শাহজাহান শিকদার জানান, দগ্ধ আরো ১৫ জন সদস্য বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে দুজনকে ঢাকায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে।
নাশকতা দাবি মালিকপক্ষের
গতকাল কনটেইনার ডিপোর মালিকানা প্রতিষ্ঠান স্মার্ট গ্রুপের শীর্ষ কর্মকর্তারা পুরো দুর্ঘটনাকে নাশকতা বলে দাবি করেছেন। গ্রুপের পরিচালক আজিজুর রহমান বলেন, ‘২০১১ সাল থেকে আমরা রাসায়নিকের ব্যবসা করে আসছি। কত রাসায়নিক বিদেশে গেছে আবার এসেছে। কিন্তু কখনোই এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেনি। এখন কেন ঘটল? ডিপোতে ৮০০ থেকে ৯০০ কনটেইনার ছিল। কোনোটাই বিস্ফোরিত হয়নি। একটা কনটেইনারে কেন বিস্ফোরণ ঘটেছে? এখানে নাশকতার বিষয়টি স্পষ্ট। ’ তবে পুরো ঘটনা তদন্তে বেরিয়ে আসবে বলে তিনি দাবি করেন।