সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশি ব্যক্তি এবং ব্যাংকের নামে থাকা অর্থের পরিমাণ এক বছরে ৫৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের নামে থাকা অর্থ বেড়েছে সবচেয়ে বেশি হারে। বৃহস্পতিবার সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে তাদের দায় ও সম্পদের পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড’ নামে এক প্রতিবেদনে ২০২১ সালের বার্ষিক ব্যাংকিং পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে সে দেশের ২৩৯টি ব্যাংক।
প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১ সাল শেষে বাংলাদেশের কাছে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকের দায় রয়েছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ। বাংলাদেশি মুদ্রায় (প্রতি ফ্রাঁ ৯৫ টাকা ধরে) যা দাঁড়ায় ৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। ২০২০ সালে যার পরিমাণ ছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ৫ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা। ফলে আগের বছরের চেয়ে বাংলাদেশের নামে থাকা অর্থ অনেক বেড়েছে।
সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন এ পরিসংখ্যান প্রকাশ করল, তার কয়েক দিন আগে জাতীয় বাজেটে আসছে অর্থবছরে বিদেশে থাকা বাংলাদেশিদের অপ্রদর্শিত সম্পদ নির্দিষ্ট হারে কর পরিশোধের মাধ্যমে বৈধতা দেওয়ার ঘোষণা রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বিদেশে থাকা যে কোনো সম্পদের ওপর কর পরিশোধ করা হলে আয়করসহ অন্য যে কোনো কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে প্রশ্ন করবে না। বিদেশে থাকা স্থাবর সম্পত্তি দেশে আনা না হলে তার মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ কর দিয়ে আয়কর রিটার্নে দেখানো যাবে। অস্থাবর সম্পদ বাংলাদেশে না আনলে তার ওপর ১০ শতাংশ কর দিলে একই সুবিধা পাওয়া যাবে। আর বাংলাদেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে নগদ অর্থ আনলে তার ওপর কর মাত্র ৭ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদদের অনেকেই বিশেষত, দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) সরকারের এ পদক্ষেপের সমালোচনা করছে। তাদের দাবি, এ ধরনের সুযোগ বরং অর্থ পাচারকে উৎসাহিত করবে এবং সৎ করদাতা, যাঁদের অনেকেই ২৫ শতাংশ কর দেন, তাঁরা নিরুৎসাহিত হবেন।
সুইস ব্যাংকে থাকা অর্থের একটি অংশ পাচার হয়ে থাকে বলে ধারণা করা হয়। তবে পাচার সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না, এমনকি গ্রাহক আমানত হিসাবে কার কত অর্থ আছে তা-ও জানা যায় না। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক গোপনীয়তার স্বার্থে সব ডাটা সমন্বিতভাবে প্রকাশ করেছে। আলাদাভাবে কোনো গ্রাহক বা ব্যাংকের তথ্য নেই।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ পরিসংখ্যানের ব্যাখ্যায় সমকালকে বলেন, বাংলাদেশের কাছে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশকেন্দ্রিক দায় এবং সম্পদ উভয়েরই তথ্য রয়েছে, যার বেশিরভাগই আমদানি ও রপ্তানির অর্থ।
বাংলাদেশের নামে থাকা তাদের দায়ের ৯০ থেকে ৯২ শতাংশ বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে হিসাব সম্পর্কিত, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কারণে সৃষ্ট। এর মধ্যে প্রায় ৫ শতাংশ গ্রাহকের আমানতের, যাঁদের মধ্যে বাংলাদেশি প্রবাসীও রয়েছেন। প্রায় ৩ শতাংশ অর্থের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই।
মতামত জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সমকালকে বলেন, সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশের নামে থাকা অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধির কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ বলা মুশকিল। তবে ধারণা করা যায়, এর মধ্যে পাচার করা অর্থের একটি অংশ থাকতে পারে। কারণ, সুইস ব্যাংকগুলো গ্রাহকের অর্থের বিষয়ে যথেষ্ট গোপনীয়তা রক্ষা করে। তবে বড় অংশই সরকার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং ব্যাংকগুলোর। সরকার ইচ্ছা করলে আনুষ্ঠানিকভাবে সে দেশের কাছে তথ্য চাইতে পারে। তথ্য পেলে জানা যাবে, সেখানে কার কত অর্থ রয়েছে।
তিনি বলেন, এটি ঠিক যে দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ থেকে প্রচুর অর্থ পাচার হয়। তবে এখন পাচার করা অর্থ বিদেশের ব্যাংকে কম থাকে। পাচার করা বেশিরভাগ অর্থ রিয়েল এস্টেট বা অন্য সম্পদে বিনিয়োগ করা হয়। অনেক উন্নত দেশ এখন সম্পদের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন না করেই বিদেশিদের বিনিয়োগের সুযোগ দিচ্ছে।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের বাজেটে বিদেশে থাকা সম্পদ থেকে কর আদায় করতে এবং নগদ অর্থ ফেরত আনতে যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তাতে সাড়া মিলবে বলে তিনি মনে করেন না।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) অর্থ পাচার নিয়ে কাজ করে। সংস্থাটি বাণিজ্যের আড়ালে কোন দেশ থেকে কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়, তার প্রাক্কলন করে। জিএফআই ২০২০ সালের মার্চে এ বিষয়ে তাদের সর্বশেষ বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। জিএফআইর প্রাক্কলন অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি ও রপ্তানির মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে বছরে গড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের কোনো নাগরিক বা প্রতিষ্ঠান যদি নিজের বদলে অন্য দেশের নামে অর্থ গচ্ছিত রেখে থাকে, তাহলে তা সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রকাশিত বাংলাদেশের নামে থাকা পরিসংখ্যানের মধ্যে আসেনি। একইভাবে সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত রাখা মূল্যবান শিল্পকর্ম, স্বর্ণ বা দুর্লভ সামগ্রীর আর্থিক মূল্যমান হিসাব করে এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অনেক দেশের নাগরিকই মূল্যবান সামগ্রী সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকের ভল্টে রেখে থাকেন।
জানা গেছে, কয়েক বছর আগে এ পরিসংখ্যান প্রকাশের পর বিএফআইইউ সুইজারল্যান্ডের এফআইইউর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। কিন্তু ব্যক্তির তালিকাসংবলিত কোনো তথ্য তারা দেয়নি। সুইজারল্যান্ডের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, অবৈধভাবে কেউ অর্থ নিয়ে গেছে- এমন প্রমাণ সরবরাহ করলে তারা তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারে।
২০১৭ সালে এ বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের বিষয়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদে জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ ও সুইজারল্যান্ডের মধ্যে ব্যাংকের মাধ্যমে যে লেনদেন হয়, তা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে এবং এটি অর্থ পাচার নয়। তবে কিছু অর্থ পাচার হয়। বাংলাদেশ থেকে যে উল্লেখযোগ্য অঙ্কের অর্থ পাচার হয়, তা সরকারও বিভিন্ন সময়ে স্বীকার করেছে।
পরিসংখ্যানে যা আছে :এসএনবির পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায়, বাংলাদেশের নামে সে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থায় মোট দায়ের মধ্যে ৮৪ কোটি ৪৫ লাখ ফ্রাঁ বা ৮ হাজার ২৩ কোটি টাকা এ দেশের ব্যাংকগুলোর কাছে। অন্যদিকে, গ্রাহক আমানত রয়েছে ২ কোটি ৬৩ লাখ ফ্রাঁ বা ২৫০ কোটি টাকা। এর বাইরে সম্পদ ব্যবস্থাপকের মাধ্যমে বিভিন্ন সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ রয়েছে সামান্য অর্থ।
প্রকাশিত পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের কাছে সুইজারল্যান্ডের পাওনার তথ্যও রয়েছে, যা সে দেশের ব্যাংকগুলোর ‘সম্পদ’ হিসেবে দেখানো হয়েছে। বাংলাদেশের কাছে সুইজারল্যান্ডের পাওনা ৫৩ কোটি ৩২ লাখ ফ্রাঁ বা ৫ হাজার ৬৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর কাছে তাদের পাওনা ৪৯ কোটি ১০ লাখ ফ্রাঁ বা ৪ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে বাংলাদেশি গ্রাহকদের সুইস ব্যাংকগুলো ঋণ দিয়েছে ৩ কোটি ৯৪ লাখ ফ্রাঁ বা প্রায় ৩৭৫ কোটি টাকা।
এদিকে সুইস ব্যাংকে ভারত ও পাকিস্তানের অর্থ আগের বছরের চেয়ে ২০২১ সালে বেড়েছে। ভারতের নামে রয়েছে ৩৮৩ কোটি ফ্রাঁ, যা ২০২০ সালে ছিল ২৫৫ কোটি ফ্রাঁ। অন্যদিকে পাকিস্তানের কাছে দায় ৭১ কোটি ফ্রাঁ। আগের বছর যা ছিল ৬৪ কোটি ফ্রাঁ। শ্রীলঙ্কা ও নেপালের নামে থাকা অর্থের পরিমাণ কমেছে।