মানুষ সুখের কাঙাল। সবাই সুখী হতে চায়। সব সময় সুখের পেছনে দৌড়ায়। কিন্তু সুখ কী, সেটা কেউই স্পষ্ট করে বলতে পারে না। অনেকে মনে করেন, সুখের অর্থ নির্মল আনন্দ। কিন্তু এই আনন্দের বোধ আসে কোথা থেকে? বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সুখের বোধের সঙ্গে সংগতি, প্রতিপত্তি, আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ইত্যাদির মতো বিষয়টিগুলো সম্পর্কিত বলে মনে করা হয়ে থাকে। যদিও বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, সুখের সঙ্গে সব সময় আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের যোগ না-ও থাকতে পারে। তাদের মতে, প্রত্যেকের মধ্যে নিজস্ব ছন্দ অনুযায়ী বিকশিত হওয়ার ক্ষমতা থাকে। কেউ যখন সেই অনুযায়ী বিকশিত হওয়ার পথে এগোতে পারে, তখনই প্রকৃত আনন্দের অনুভূতি হয় তার।
সুখের সংজ্ঞা নিয়ে অবশ্য আমজনতা থেকে দার্শনিক এমনকি মনোবিশেষজ্ঞদের মধ্যেও বিস্তর মতপার্থক্য রয়েছে। প্রাচীন ভারতের ধর্মগ্রন্থ ‘বৃহদারণ্যক’ উপনিষদে আছে, ‘সর্বে ভবন্তু সুখিন/ সর্বে সন্তু নিরামায়াঃ/ সর্বে ভদ্রানি পশ্যন্তু/ মা কশ্চিদ দুঃখমাপ্নুয়াত/ ওম্ শান্তি শান্তি শান্তি’। অর্থাৎ, সবাই যেন সুখী হয়, সবার যেন নিরাময় হয়, সব মানুষ পরম শান্তি লাভ করুক, কস্মিনকালেও যেন কেউ দুঃখবোধ না করেন। সবাই শান্তি লাভ করুন (১/৪/১৪।
প্রাচীন ভারতের সেই ভাবনা সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে আর ভোগবাদী ভাবনার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার। আমাদের যে ব্যক্তিগত জীবন, সেই জীবনে ‘সবাই তো সুখী হতে চায়/ কেউ সুখী হয় কেউ হয় না’। মনের মধ্যে অবিরাম পাক খেতে থাকে, ‘সুখের কথা বোলো না আর/ বুঝেছি সুখ কেবল ফাঁকি’। অবিরাম অন্তহীন সুখের অন্বেষণে ছুটে চলাই আধুনিক জীবন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা আনন্দ ও শান্তির তোয়াক্কা না করে দৈহিক ও মানসিক সুখের জন্য দৌড়াই। একসময় জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে মনে হয় ‘সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু অনলে পুড়িয়া গেল/ অমিয় সাগরে সিনান করিতে সকলই গরল ভেল।
তবে মানুষে মানুষে সুখের অনুভূতির রকমফের আছে। ক্ষুধার্ত মানুষের খাদ্যগ্রহণের সুখ আর প্রকৃতিপ্রেমীর সমুদ্রদর্শনের সুখ কখনোই এক নয়। দার্শনিক বেন্থাম ও মিলের ভাবনার মধ্যে যে পার্থক্য, তা এখানেও স্পষ্ট। প্রকৃত সুখের অন্বেষণে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আমরা এক সত্য থেকে আরো গভীরতর সত্যের অভিমুখে অগ্রসর হই।
প্রকৃত মানুষ হওয়ার লক্ষ্যে মানুষ শিক্ষা লাভ করে। মনুষ্যত্বের গুণগুলো যাতে বিকশিত হয় এবং নিজের অসম্পূর্ণতাগুলো দূরে সরিয়ে মানুষ যাতে সম্পূর্ণতার পথে এগিয়ে চলে, তারই প্রয়াস চালায়। অথচ, আমরা ভোগবাদী মোহের বশবর্তী হয়ে, শিক্ষাকে প্রকৃতভাবে গ্রহণ করতে না পেরে, মনুষ্যত্বের অবমাননা করে চলি। বর্তমানে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে যে কোনোভাবে অর্থ উপার্জন। নিজেকে বাজারের উপযোগী করে তোলাই যেন বিদ্যাশিক্ষার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ মানুষ চিরদিন কামনা করেছে আদর্শের শিক্ষা, মূল্যবোধের শিক্ষা, বিবেকের জাগরণ, মনুষ্যত্বের জয়গান ইত্যাদি। ফুলের সৌরভের মতো ব্যক্তিত্বের মর্যাদাবোধ চিরকাল মানুষকে মোহিত করেছে। ক্ষুদ্র আমি থেকে বৃহৎ আমি’র অন্বেষণে মানুষ অগ্রসর হয়েছে। বৃহতের সাধনার দ্বারাই আমরা মনুষ্যত্বের নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে চেয়েছি। জ্ঞানের যে চোখ আমাদের উদিত হয়, তার সাহায্যেই আমরা সত্যের উপলব্ধি করতে শিখি।
ভারতীয় সাহিত্যে ও সমাজে শিবঠাকুর স্বয়ং দুঃখের দেবতা হয়ে কণ্ঠে বিষ ধারণ করে নীলকণ্ঠ হন। ‘সকল দুখের প্রদীপ’ জ্বালিয়ে পথ চলা শুরু করেন। বৈষ্ণবীয় আধারে দুঃখের নতুন ব্যাখ্যা শুরু হয়, ‘যেটারে দেখিছ দুঃখ, তাহা সুখ, অতি মাত্রায় সূক্ষ্ম’। যতীন্দ্রনাথ তাই ঘোষণা করেন, ‘মিথ্যা প্রকৃতি মিছে আনন্দ মিথ্যা রঙিন সুখ/সত্য সত্য সহগ্রগুণ সত্য জীবনের দুখ’। কবি কঙ্কন মুকুন্দদাস দুঃখসমৃদ্ধ জীবন থেকে কীভাবে দুঃখকে জয় করে জীবন যাপন করতে হয়, তা ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে তুলে ধরেছেন। অভাবের সংসারের চরম দারিদ্র্যকে কীভাবে জয় করে সাবলীলভাবে জীবন যাপন করতে হয়, তারই মহামন্ত্রের সন্ধান এখানে দিয়ে গেছেন তিনি।
রাজার দুলাল সিদ্ধার্থ রাজভোগ-রাজসুখ অস্বীকার করে জরা-ব্যাধি-মৃত্যুর রহস্য তথা বোধি’ লাভের জন্য ঘরে ছেড়ে বনে গিয়েছিলেন। আবার জীবনানন্দের কবিতায় বিপন্ন বিস্ময়ের পাশাপাশি ব্যক্তিজীবনে তথাকথিত সুখী মানুষটির আত্মহত্যার প্রসঙ্গও রয়ে গেছে। ঠিক যেন আধুনিক জীবনে ভোগ্যবস্তু সংগ্রহে ক্লান্ত নিজ মনুষ্যত্বের হত্যাকারী ব্যক্তিমানুষের বেদনার চিত্র উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
সুখের অন্বেষণে জীবনের আদর্শের মানদণ্ডটি দিনে দিনে পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। তাই বোধ হয় মূল্যস্ফীতি, যুদ্ধ, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অসহিষ্ণুতা, দূষণ, বিশ্ব উষ্ণায়ন, ক্ষতিকারক প্লাস্টিকের ব্যবহার, জলসংকট, মোবাইল সংক্রান্ত বিকিরণ প্রভৃতি জীবনকে জর্জর করে তুললেও ‘বি মাইন্ডফুল, বি গ্রেটফুল, বি কাইন্ড’ স্লোগানে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তের প্রতিটি মানুষের সুখী হয়ে ওঠার কামনা করছে ‘বিশ্ব সুখ দিবস!
তবে সুখের সূচকে গত বারের তুলনায় বাংলাদেশের অবনমন ঘটেছে ২৪ ধাপ। বিশ্ব সুখ দিবসের প্রাক্কালে এবার বাংলাদেশের জন্য দুঃসংবাদ দিয়েছে ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট। জাতিসংঘের এই বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, ২০২২ সালে সুখ কমেছে দেশের মানুষের মনে।
মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি), সামাজিক সুরক্ষা, কাঙ্ক্ষিত গড় আয়ু, সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা, মানবিকতা, দুর্নীতির ধারণা এবং সার্বিক দুর্দশা—এই সাত মানদণ্ডের ভিত্তিতে বিচার করে একটি দেশের মানুষ কতটা সুখে আছে, তা বোঝার চেষ্টা করা হয় এই প্রতিবেদনে। সেই হিসাবে ১০ ভিত্তিক স্কেলে এবারের সূচকে বাংলাদেশের সুখের ঝুলিতে সংগ্রহ ৪ দশমিক ২৮২ পয়েন্ট, বিশ্বের ১৩৭ দেশের মধ্যে অবস্থান ১১৮তম। আগের বছর ১৪৬টি দেশের মধ্যে ৫ দশমিক ১৫৫ পয়েন্ট নিয়ে বাংলাদেশ ছিল ১৪৬টি দেশের মধ্যে ৯৪তম অবস্থানে।
উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ২৮ জুন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এক অধিবেশনে প্রতি বছর ২০ মার্চ সুখ দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দিনটি পালনসংক্রান্ত প্রস্তাবে বলা হয়, ‘সাধারণ পরিষদের সব সদস্য এ বিষয়ে একমত যে, সবারই জীবনের মূল উদ্দেশ্য সুখে থাকা।’
শুধু তাই নয়, সার্বিকভাবে ‘একটি সার্বিক ও ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও প্রয়োজন, যার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ, সর্বোপরি পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য প্রতি বছরের ২০ মার্চ দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
আন্তর্জাতিক সুখ দিবস পালনের প্রেক্ষাপট যাই হোক, এটুকু সহজেই অনুমেয় যে পশ্চিমের শিল্পোন্নত ও কল্যাণমূলক দেশগুলোই থাকবে এই তালিকার প্রথমে। অতএব তালিকার প্রথম চারে ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, আইসল্যান্ড বা ডেনমার্কের থাকা নিয়ে আমাদের হীনম্মন্যতা অনুভবের বিশেষ কোনো কারণ নেই।
আমরা বরং আনন্দিত হতে পারি এই ভেবে যে, আমাদের পরেও অনেক দেশের নাম আছে। বিশেষ করে এই তালিকায় আমাদের প্রতিবেশী ভারতের অবস্থান ১২৬তম। তবে আমাদের আফসোস শুধু একটাই, তালিকায় পাকিস্তান আমাদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে! বৈশ্বিক এই র্যাংকিংয়ে দেশটির অবস্থান ১০৮তম।
পাকিস্তানের মতো দেশ বাংলাদেশের ওপরে স্থান পাওয়ার যৌক্তিকতা মেনে নেওয়া শক্ত, কারণ এই দেশে জননিরাপত্তা বলে কিছু নেই। জঙ্গি হামলায় অকাতরে বলি হওয়া যে দেশের নিয়মিত দৃশ্য, যে দেশের অর্থনীতি ডুবন্ত নৌকার মতো, সেই পাকিস্তান নামক দেশটির বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও ভারতের ওপরে স্থান পাওয়াটা কিছুটা বিস্ময়ের জন্ম দেয় বৈকি!
এক রসিক ভদ্রলোক বলেছিলেন, নিজের ভায়রার চেয়ে যার রোজগার ১০০ টাকা বেশি, সে-ই সুখী! ইয়ার্কির অংশটুকু বাদ দিলে একটা কাজের কথা পড়ে থাকে, আমরা সুখী কি না, সেটা বোঝার একমাত্র পথ তুলনা। হয় চারপাশের লোকদের সঙ্গে তুলনা অথবা নিজের অতীতের সঙ্গে তুলনা। এ যে সুখের দাঁড়িপাল্লা। উলটো দিকে অন্য কাউকে না রাখলে সুখের পরিমাণ বোঝার উপায় নেই। আমরা আপাতত ভারতের চেয়ে এগিয়ে, এটাই সবচেয়ে বড় সুখ!
তা ছাড়া আমাদের নিজস্ব মানদণ্ডে আমরাই সবচেয়ে সুখী দেশ। আমাদের মনের মধ্যে সারাক্ষণ দোলা দেয় বসন্তের হাওয়া। আমাদের সুখের নিজস্ব স্টাইল আছে। পেটে ভাত না থাকুক, পরনে কাপড় না থাকুক, আমরা সমালোচনা করে সুখী, অকারণে অন্যের পশ্চাতে বাঁশ দিয়ে সুখী, হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ধনী আরাভ খানকে নিয়ে আলোচনা করে সুখী, মাহিয়া মাহিকে গ্রেফতারে সুখী, তাকে ছেড়ে দেওয়ায় সুখী, কোক স্টুডিওর গান নিয়ে সুখী, শিল্পী অনিমেষ রায়ের সমালোচনা করে সুখী, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল নিয়ে সুখী। জিনিসপত্রের দাম, সুশাসন নিয়ে কিছু অসন্তোষ থাকলেও শেষ পর্যন্ত ফেসবুকে কিছু বাণী ঝেড়ে সুখী। শেষ বিচারে সুখ দিবস ও সুখী দেশের তালিকা সম্পর্কে আমাদের অভিমত :পাগলের সুখ মনে মনে, দিনের বেলা তারা গোনে!