আধুনিক বিশ্বে নতুন প্রজন্মের বিধ্বংসী অস্ত্রের ভয়াবহতা বিবেচনায় বৈশ্বিক শক্তিগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার পথ এড়িয়ে চলে। অর্থাৎ, অত্যাধুনিক অস্ত্রসজ্জিত দেশগুলো পরোক্ষ যুদ্ধে লিপ্ত হতেই বেশি পছন্দ করে থাকে! যেমনটি দেখা গেছে স্নায়ুযুদ্ধের কালে। দুই পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন পরোক্ষ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে, যা বহুকাল ধরে অস্থিরতার জ্বালামুখে ঠেলে দেয় বিশ্বকে। এ ধরনের সংঘাতকে সাধারণ ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ হিসেবে অবিহিত করা হয়। এক্ষেত্রে একে অপরের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ, সংঘাতের রাস্তায় না গিয়ে বরং আড়ালে থেকে কলকাঠি নাড়ে পরাশক্তিগুলো। সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয় বন্ধ দরজার ওপাশ থেকে। যুদ্ধের গতিপথ নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তাও প্রদান করা হয়ে থাকে আড়ালে-আবডালে!
স্নায়ুযুদ্ধের সময় প্রক্সি যুদ্ধের বিশেষ লক্ষ্য ছিল। সম্ভাব্য পারস্পরিক ক্ষয়ক্ষতি ও ধ্বংসলীলা হতে রক্ষা পাওয়ার চিন্তা থেকেই সেসময় এ ধরনের কৌশল বেছে নেয় পক্ষগুলো। সেই সময় যেহেতু কোনো পরাশক্তিই জাতীয় নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে চায়নি, তাই প্রক্সি যুদ্ধের ধারণা তাদের জন্য ‘পছন্দনীয় বিকল্প’ হয়ে ওঠে। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নিজের কার্যকারিতা বাড়াতে প্রক্সি যুদ্ধ আজও পরাশক্তিগুলোর কাছে বেশ পছন্দের! এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে নিজের মিত্রদের একত্রিত করে প্রতিপক্ষের ওপর এবং এমনকি তার প্রক্সিদের বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায় খুব সহজেই। এভাবে নিজ প্রভাবের ক্ষেত্র প্রসারিত করা সহজতর হয়।
বলে রাখা দরকার, স্নায়ুযুদ্ধের যুগে প্রক্সি যুদ্ধ ছিল মূলত আদর্শকেন্দ্রিক। বৈশ্বিক শক্তিগুলো, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলো স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী যুগেও আদর্শগতভাবেই প্রক্সি যুদ্ধ চালিয়ে গেছে। চলে আসছিল এভাবেই। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, সম্প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের বাইরে তথা অপশ্চিমা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো এই কৌশল (প্রক্সি যুদ্ধ—পরোক্ষ সংঘাত) অনুকরণ করতে শুরু করেছে! লক্ষ করলে দেখা যাবে, বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে প্রক্সি যুদ্ধ চলছে!
তবে, পূর্ববর্তী প্রক্সি যুদ্ধগুলোর সঙ্গে হালের প্রক্সি যুদ্ধের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈপরীত্য লক্ষ করা যায়। সাম্প্রতিক প্রক্সি যুদ্ধের প্রকৃতি অনেকাংশে ‘প্রতিরোধমূলক’। এক্ষেত্রে দুই ধরনের প্রতিরোধমূলক প্রক্সি যুদ্ধ সংঘটিত হতে দেখা যায়। প্রথম এবং সবচেয়ে সাধারণ ধরন হলো বিবদমান দলগুলোর মধ্যে ‘সরাসরি প্রক্সি যুদ্ধ’। লিবিয়ার বিভিন্ন উপদলের মধ্যকার গৃহযুদ্ধ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এছাড়া সিরিয়ার দুই বা ততোধিক প্রক্সির মধ্যকার সংঘর্ষও এর জ্বলজ্যন্ত উদাহরণ। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে অন্তত তিনটি পক্ষ রয়েছে—ইরান ও রাশিয়া সমর্থিত বাশার আসাদ সরকার; ওয়াইপিজি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা রাষ্ট্র দ্বারা সমর্থিত পিকেকে-এর সিরিয়ান শাখা এবং তুরস্ক সমর্থিত মূলধারার সিরিয়ার বিরোধী দল।
দ্বিতীয় ধরন একটি আঞ্চলিক বা বৈশ্বিক শক্তি এবং একটি প্রক্সির মধ্যে। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দ্বিতীয় ধরনের প্রতিরোধমূলক প্রক্সি যুদ্ধের একটি টাটকা উদাহরণ। পাশ্চাত্যমুখী বৈদেশিক নীতি অনুসরণ ও ন্যাটোর সদস্য হওয়া থেকে ইউক্রেনকে বিরত রাখার চেষ্টা করছে রাশিয়া। অন্যভাবে বললে, রাশিয়া পূর্বমুখী ন্যাটো সম্প্রসারণবাদ এড়াতে চেষ্টা করছে, যাকে ‘রেডলাইন’ বলে মনে করেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এই আঞ্চলিক সংঘাতকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন বৈশ্বিক শক্তির—প্রক্সি স্টেট বা প্রক্সি নন-স্টেট অ্যাক্টর—মধ্যে হিংসাত্মক বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অহিংস প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে একটি পক্ষ নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করছে, যা অন্য পক্ষের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠছে স্বভাবতই। ফলে আড়ালে থেকেই কলকাঠি নাড়তে বাধ্য হচ্ছে তারা! অর্থাত্’, সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক পরিবর্তন রোধ করার জন্য ‘প্রতিরোধমূলক প্রক্সি যুদ্ধ’ চালানো হচ্ছে একটি পক্ষের তরফ থেকে। উদাহরণস্বরূপ—জর্জিয়া, ইউক্রেন, সিরিয়া ও লিবিয়ার মতো অঞ্চলে প্রক্সি যুদ্ধ চালাচ্ছে রাশিয়া। বিশেষ করে জর্জিয়া ও ইউক্রেনের ক্ষমতাসীন সরকারকে শাস্তি দেওয়ার জন্য একতরফাভাবে এই দুই দেশে যুদ্ধ ও আক্রমণ শুরু করেছেন পুতিন। এক্ষেত্রে রাশিয়ার প্রধান লক্ষ্য হলো, এই দুই রাষ্ট্রের সম্ভাব্য ন্যাটো সদস্যপদ আটকানো ও তাদের পশ্চিমামুখী সরকারের শাসনের ইতি টানা। একইভাবে পশ্চিমা আধিপত্য ঠেকাতে মধ্যপ্রাচ্যেও প্রক্সি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে রাশিয়া। সিরিয়া ও লিবিয়ার সংকটে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের দিকে দৃষ্টি দিলেই এর প্রমাণ মিলবে। অর্থাত্, মিত্রদেরকে সঙ্গে নিয়ে সরাসরি নিজে কিংবা নির্দিষ্ট প্রক্সি রাষ্ট্রকে সমর্থন করার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতা তথা প্রক্সি যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে পুতিনের রাশিয়া।
অতি সম্প্রতি সুদান নতুন ধরনের প্রতিরোধমূলক প্রক্সি যুদ্ধের নতুন ফ্রন্টে পরিণত হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত অভ্যন্তরীণ দলগুলোর হানাহানি, রক্তপাত সুদানকে ঠেলে দিচ্ছে আরেকটি গৃহযুদ্ধের দিকে। গত ১৫ এপ্রিল থেকে চলমান সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত ৫০০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহানের নেতৃত্বে সুদানি সেনাবাহিনী ও মোহাম্মদ হামদান দাগালোর নেতৃত্বাধীন সুদানের আধাসামরিক বাহিনীর (র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস—আরএসএফ) মধ্যে সংঘটিত এই লড়াইয়ে আহত হয়েছেন হাজার হাজার সুদানি।
উদ্বেগের বিষয় হলো, বিভিন্ন আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তি ক্রমশ জটিলতর হয়ে ওঠা সুদান সংকটকে নিজের স্বার্থে কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে পারে! সহজ কথায়, সংশ্লিষ্ট বহিরাগত শক্তিগুলো নিজেদের ফায়দা হাসিলের জন্য সুদানের চলমান সংঘাতে অযাচিত হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। এ কথা সবার জানা, একটি পক্ষের সুদানের প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণের দীর্ঘ অভিলাষ রয়েছে, যেখানে আরেকপক্ষের টার্গেট নীলনদের ওপর! এই দ্বিমুখী লক্ষ্য পূরণের জন্য শক্তিগুলো যে অবিরত চেষ্টা চালিয়ে আসছে—এ কথা কে না বলবে? বাস্তবিক অর্থে দেখা যায়, বেশ কিছু আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তি সুদানের ওপর তীক্ষ্ম দৃষ্টি রেখে চলে। মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করলে দেখা যায়, সুদানের রাজনীতিতে বেশ খানিকটা প্রভাবও তৈরি করেছে কিছু দেশ। এদিক থেকে দেখলে, সুদানের দুর্বল মুহূর্তের সুযোগ নিয়ে এসব দেশের কিছু একটা করে বসার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না! অন্ততপক্ষে, সুদানের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ দলগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে সংকটকে টেনে লম্বা করার চেষ্টা করতে পারে কেউ না কেউ—এমন চিন্তা অবান্তর নয়!
আমরা দেখেছি, সংকটকালে প্রক্সি নন-স্টেট অ্যাক্টর ব্যবহার করা হচ্ছে বর্তমানে। যেমন, রাশিয়ার ‘ওয়াগনার’। রাশিয়ার এই ব্যক্তিগত সামরিক কোম্পানি বর্তমানে ইউক্রেনের মাটিতে লড়াই চালাচ্ছে পুতিন বাহিনীর পক্ষে। ভুলে গেলে চলবে না, চলমান সামরিক সংঘাতের কারণে সুদানে বড় ধরনের মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে। নাগরিক অস্থিরতা বেড়েই চলেছে, যা থেকে বড় আকারে মানবিক সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত শতাধিক মানুষ প্রাণ হারালেও সংঘাত বন্ধের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সশস্ত্র দুই বাহিনীর মধ্যে এভাবে যুদ্ধ চলতে থাকলে তা হাজার হাজার নিরীহ মানুষের প্রাণ ঝরাবে। এসব বিষয় মাথায় রেখে শক্তি ও পক্ষগুলোকে সুদানের রক্তপাত ও আশু বৃহৎ সংঘাত বন্ধে এগিয়ে আসতে হবে। সুদান এমনিতেই খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ও দরিদ্র জনগণের মুখে দুবেলা খাবার তুলে দিতেই হিমশিম খাচ্ছে। এই অবস্থায় সেই দেশের যুদ্ধ কিংবা প্রক্সি যুদ্ধের ঘেরাটোপে পড়ে যাওয়াটা হবে বিশ্ব রাজনীতির জন্য ‘চরম অমানবিকতা’। সংঘর্ষ, যুদ্ধ চলতে থাকলে অস্ত্র ও মানব পাচার বাড়বে। এর ফলে স্বভাবতই অবনতি ঘটবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির। আঞ্চলিক অস্থিরতাও বৃদ্ধি পাবে ক্রমাগতভাবে। সুতরাং, সুদানে যুদ্ধ কিংবা প্রক্সি যুদ্ধ কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়।