সাহিত্য-সংস্কৃতিমনা হওয়া জ্ঞানৌজ্জ্বল্যের অনুষঙ্গ, যা মনোবৈকল্য দূর করে। সুস্থ-সুন্দর জীবন গড়ে তোলে। এরকম জীবনের সমন্বয়ে সুস্থ পারিবারিক বলয়ও তৈরি হয়। পাপহীন সমাজ বিনির্মাণ এই পথেই সম্ভব। মনের সুস্থতা আনা জীবনের প্রথম করণীয় কাজ। বিনয়-ভদ্রতা পাপহীন জীবনের প্রবহমান ধারা, যা মনকে নির্মল-মোহিত রাখে। জীবনের পবিত্র ভাবের আবহ-ই আভিজাত্য।
পুণ্যময় জীবনের প্রবহমানতা সমাজের জন্য কল্যাণকর। সুন্দর মন মানুষকে তার মজ্জাগত কুচিন্তা থেকে সরিয়ে আনে। কল্যাণের সুন্দর মনই পুণ্যের পথ তৈরি করে দেয়। যুগে যুগে ঈশ্বরও মানুষের পাপমুক্তির জন্য মহাকল্যাণকামী দূত পাঠিয়ে থাকেন। মহাসংকটকালে সে দূতগণ কালে কালে এসেছেন, গেছেন। মমত্ব-মনুষ্যত্বহীন মানুষ তখন হাজারো অপকর্মে লিপ্ত থাকে। গভীর তমসায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। থাকে লোভ-লালসায় আবিষ্ট। হীনস্বার্থপরতা-মিথ্যাচার থেকে সে সরতে পারে না। সত্য বলা, সুপথে চলা তার হয়ে ওঠে না। মানুষ হয় না সে। বঞ্চনা আর বৈষম্য সৃষ্টির অসম প্রতিযোগিতা তার নিত্যদিনের কাজ হয়ে পড়ে। সে মনে করে, তার পায়ের তলায় কতক মনুষ্যসন্তান গড়াগড়ি না খেলে, সে কীসের বড়। সে মানুষকে সস্তা শ্রমের দাস বানায়। প্রতি মুহূর্তে তার বড়ত্বের বড়াই দৃশ্যমান।
সম্পদ কুক্ষিগত রাখা অধর্ম। কবি নজরুলের বাণীসদৃশ কবিতার একটি লাইন—‘আপনারে তুই বিলাইয়া দে আসমানি তাগিদ’। এজন্য ধর্মে জাকাত-ফিতরা-দান-খয়রাতের বিধান রাখা হয়েছে। অসহায় মানুষের স্বাবলম্বীর জন্য ধনীদের কাছ থেকে এই অর্থ নেওয়া যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত। এ থেকে বেশ অর্থও সংগ্রহ হয়ে থাকে; কিন্তু অব্যবস্থাপনার জন্য এই অর্থ স্বাবলম্বী করার কোনো কাজেই আসে না। নানা ছলছুতায় এই অর্থ সুবিধাভোগীদের পেটে যায়। এ কারণে রাষ্ট্রের উদ্যোগই এখানে শতভাগ ফলপ্রসূ হবে, এমন আশা করা যায়। এর সঠিক কার্যকারিতার জন্য স্বতন্ত্র অধিদপ্তর থাকাও আবশ্যক। কল্যাণকর তহবিল গঠন তাই দরকার। এছাড়া সর্বজনীন কল্যাণকর এই কাজ সুচারুরূপে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। অসহায় মানুষের তালিকাই এই ব্যবস্থাটা চলমান রাখবে, যাতে করে কালে কালে একটি মানুষও হাতপাতা না থাকে। সমাজের বিত্তবানরা অনুপ্রাণিত হয়েই এই কাজে সম্পৃক্ত হবেন। অংশীদার হবেন। আশঙ্কার কথা, প্রজ্বলিত আশার আলোর শিখাটি যদি নিভে যায়; তার ক্ষমতাকালীন পর্যন্ত যদি এর স্থায়িত্বকাল হয়; তাহলে তো অসহায়দের স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ আর চলমান থাকবে না। দীপশিখাটি নিভে যাবে। এটাকে কল্যাণকর জীবনব্যবস্থার সর্বজনীন একটি আইনই চলমান রাখতে পারে। সুবিধা-স্বস্তি-শান্তি—এই তিনটি অধিকার সমুন্নত রেখে কল্যাণকর জীবনব্যবস্থার বিধানই আভিজাত্য। অসম-অন্যায় চিন্তার ধারকবাহক যে সমাজ, সে সমাজ অভিজাত নয়।
পৃথিবীর চলমান দিনগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, ধনৈশ্বর্যমণ্ডিত ধনাঢ্য পবিবারগুলোর একসময় কিছুই থাকে না। কালস্রোতে সব ভেসে যায়। মুছে যায়। এই নিয়মের ব্যত্যয় নেই। সামষ্টিক কল্যাণের পথই মনুষ্যত্বের পথ। এই পথই অসহায়ত্ব ঘুচে যাওয়ার পথ। এই যে লাখ লাখ আকাশছোঁয়া দালানকোটা, দামি দামি গাড়ি, প্রাচুর্যে ভরা জীবনযাপন, এর পাশে পড়ে থাকা কত অসহায়-নিঃস্ব-হাতপাতা মানুষ। উন্নয়নের এই সমাজব্যবস্থায় সামষ্টিক কল্যাণের কিছু নেই। সুন্দর মনের আভিজাত্যের কিছু নেই এখানে।
জীবনের প্রবহমান দিনগুলো যদি সুন্দর মনের ঐশ্বর্য্যে মোড়ানো থাকে, তাহলেই সুন্দর মনের পরিবার পাওয়া যায়। ধনী-গরিবের বিভাজনটা প্রকট হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। সহনীয় পর্যায়ে থাকাটাই ধর্ম। আভিজাত্যবোধসম্পন্ন মানুষ তৈরি তাই জরুরি। বিশাল জনারণ্যে সে দৃষ্টান্ত তো কোথাও দেখা যায় না। ধনৈশ্বর্য্যে নেশাগ্রস্ত আত্মকেন্দ্রিক মানুষের জীবনযাপন মনকে বিষাদগ্রস্ত করে তোলে।
এটা সত্য, মনুষ্যত্ব-মানবিকতাহীন পৃথিবীতে গরিবরা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার। এর অজস্র দৃষ্টান্ত জীবন্ত। এই অসহায়ত্বের পেছনে অনেক অপকৌশল কাজ করে। ধনী-গরিবের আকাশ-পাতাল বিভাজন সুন্দর মনের আভিজাত্যের সমাজ তৈরি করে না। এখানে ধনবানে ধনবানে বন্ধুত্ব। বিশ্বটা যেন ধনীদের, যুদ্ধবাজদের হয়ে গেছে। এদের দৌরাত্ম্যে এক দেশের লাখ লাখ নাগরিক অন্য দেশের শরণার্থী। কত লাখ লাখ নারীশিশু মানবেতর জীবনে অত্যাচারিত। এদের আভিজাত্য বোধই ‘বড়ত্বের অহংকার’। এ বড়াই-ই ওরা করে থাকে। ওদের শোষণ-অপকৌশল লাগামহীন। ওদের ঐক্যই শোষণের শক্ত বলয়। একটা ঘোরের মধ্যেই সাধারণ জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন হয়ে থাকে। এদের বলা হয়, ধনী-গরিব স্রষ্টার সৃষ্টি। এই বলে ওরা সুখের পাহাড় গড়ে তোলে। কিন্তু ধর্ম বলেছে, সুখ-দুঃখ সমভাগ করে নেওয়াই ধর্ম। সামষ্টিক কল্যাণের ধারণই ধর্ম। ব্যক্তিগত অঢেল সঞ্চয়ের অধিকার ধর্ম কখনো দেয় না। কর্তৃত্ববাদী, আধিপত্যবাদী ও আত্মাহংকারী ধনাঢ্য ব্যক্তি অভিজাতসম্পন্ন নয়। ওদের মধ্যে সীমাহীন আধিপত্যের জৌলুস। ওদের অমানবিক চর্চা লাগামহীন। রাষ্ট্রযন্ত্রেও ওদের কলকাঠি শক্ত অবস্থানে, ওখানেই ওদের স্বার্থের ভিত। ধনৈশ্বর্যের আধিপত্য আত্ম-অহংকারের বহিঃপ্রকাশ। শ্রেষ্ঠত্বের আত্ম-অহংকার, আধিপত্যবাদের চূড়ান্ত রূপ। সাধারণের কষ্টের দুনিয়া ওদেরই সৃষ্টি। ওদের বিভাজিত এবং কথিত নিম্নশ্রেণির মানুষগুলো কতটা অবহেলিত তা দৃশ্যমান সবখানে।
জ্ঞানৌজ্জ্বল্য আভিজাত্যের কল্যাণকর অভিব্যক্তি, সমাজহিতকর। জ্ঞানসমৃদ্ধ মানুষই অভিজাত। সমাজজীবনে সুখ-শান্তি ও কল্যাণ এরকম মানুষই এনে থাকে। তার বোধই জগেপ্রমের উজ্জ্বল নিদর্শন। এই বোধসম্পন্ন মানুষই জগত্কল্যাণের প্রতিভূ। জ্ঞানসমৃদ্ধ ব্যক্তিই অভিজাতসম্পন্ন। সুন্দর মনের জীবনযাপনের নানা অনুষঙ্গে আভিজাত্যের পরিচয় পরস্ফুটিত। অহংকারবর্জিত সুন্দর মনই আভিজাত্যের অভিব্যক্তি। সেটাই আভিজাত্য। কল্যাণপ্রসূ নয়, এমন কিছু আভিজাত্য নয়। বৈষম্যের কদর্য অপকৌশল আভিজাত্য নয়। কল্যাণের ধারণ যে সমাজে রহিত, সে সমাজ অভিজাত নয়।