এবার স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে পাকিস্তানি হানাদার কর্তৃক বাঙালি নিধন তথা গণহত্যার বিশ্বস্বীকৃতি নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ অনেকেই সোচ্চার হয়েছেন। জাতীয়ভাবে এই স্বীকৃতি ইতিমধ্যেই দেওয়া হয়েছে। বিশ্বস্বীকৃতি পেলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক অফিসারদের গণহত্যা ও নৃশসংতা ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ ও লোমহর্ষক। আমরা ইতিহাসের দিকে গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করলে জানতে পারি, চিফ অব স্টাফ জেনারেল হামিদ ১৯৭১ সালের ২১ মার্চ ঢাকায় আসেন এবং তিনি মফস্বল ঘুরে বেড়ান। জেনারেল নিয়াজি, খাদিম হোসেন রাজা এবং রাও ফরমান আলি আগে থেকেই ঢাকায় ছিলেন। মিঠা খান, খোদাদাদ খান, আনসারি প্রমুখ জেনারেলও পূর্ব পাকিস্তানে এসেছিলেন। তাদের তৎপরতায় সারা দেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
এরপর ‘সোয়াত’ জাহাজে করে রসদ আসে ২৮ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু বন্দরের কর্মচারী ও শ্রমিকরা এই জাহাজ খালাস করতে আপত্তি জানান। ২৪ মার্চ চট্টগ্রামের বাঙালি অফিসারকে বদলি করে সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসের আয়োজন করা হয়। বিহারিদের এলাকায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিয়ে তাদের মধ্যে অস্ত্রশস্ত্র বিলি করতে থাকে। ফলে বাঙালিদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করে। ২২ মার্চ অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সেনাসদস্যরা ঢাকায় র্যালি বের করে। ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসকে প্রতিরোধ দিবস ঘোষণা করা হয়। সেদিন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। সেনাবাহিনীর মধ্যে বাঙালিদের দমনের সূক্ষ্ম প্রচেষ্টা চালানো হয়। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম এবং অষ্টম ব্যাটালিয়নই ছিল পূর্ব পাকিস্তানে এবং এতে সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় ৬ হাজার। আর ইপিআরে ছিল প্রায় ১২ হাজার সৈন্য। কিন্তু তাদের মাত্র কয়েক জন অফিসারই ছিলেন বাঙালি। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালিদের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা কার্যকরী করা হয় মার্চের শুরুতেই। বাঙালি অফিসারদের সৈন্যদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ারও অপচেষ্টা চলে। এসব আলামত ছিল খুবই নেতিবাচক।
জেনারেল টিক্কা খান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি তাদের প্রস্তুত হওয়ার নির্দেশ দেন। টিক্কা খান এ নির্দেশ পাওয়ার পর জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজাকে সামনের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য বলেন। মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি জিওসির সদর দপ্তরে মিলিত হন। রাও ফরমান আলি অফিস প্যাডের হালকা নীল কাগজে পেনসিলে হস্তাক্ষরে রচনা করেন ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক বাঙালি নিধনযজ্ঞের নীলনকশা। জেনারেল টিক্কা খান ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ খান কিছুটা পরিবর্তন করে ২০ মার্চ এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৩ মার্চ তা অনুমোদন করেন। মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ২৪ মার্চ চট্টগ্রামে আসেন। সেনানিবাসের সিও ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে সঙ্গে করে তিনি ঢাকায় নিয়ে যান এবং অপারেশন সার্চলাইটের কপি চট্টগ্রামে রেখে যান। এ প্রসঙ্গে Pakistan’s Crisis in Leaderhip গ্রন্থে জেনারেল ফজল মুকিম খান বলেন, ‘২৩ মার্চ (১৯৭১) দুপুরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জেনারেল টিক্কা খানের (পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক, যিনি বেলুচিস্তান প্রদেশে কসাই নামে পরিচিত) বাসায় যান এবং জরুরি অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হতে আদেশ দেন। তাঁর (ইয়াহিয়া) নির্দেশ অনুসারে ২৪ মার্চ (১৯৭১) সিনিয়র সামরিক অফিসারদের বিভিন্ন সেনানিবাসে পাঠানো হয় কমান্ডারদের হাতে আদেশ পৌঁছে দেওয়ার জন্য। এভাবেই জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঢাকা অবস্থানকালেই বাঙালিদের ন্যায্য আন্দোলনকে ধূলিসাৎ করে দেওয়ার জন্য সামরিক বাহিনীর প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন এবং ২৫ মার্চ (১৯৭১) অতি গোপনে করাচি যাওয়ার প্রাক্কালে জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব বাংলায় গণহত্যা চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় ও চূড়ান্ত নির্দেশ প্রদান করেন।’
একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে বাঙালির অস্তিত্বকে পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে মুছে ফেলার জন্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক নীলনকশা অনুযায়ী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও গণহত্যা চালায়। একই সঙ্গে বাঙালি ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রতিরোধ আসতে পারে ভেবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের নির্মূল করার জন্য আক্রমণ চালায়। সেনানিবাস, সীমান্ত ফাঁড়ি ও পুলিশ লাইনগুলোতে পাকিস্তানি বাহিনী সরাসরি হামলা চালিয়ে অস্ত্রাগারগুলো দখল করে নেয়। এ বর্বরোচিত হামলাকে প্রতিহত করার জন্য দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে ব্যাপক প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তোলে, যার নাম ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকা মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই মন্তব্য করেছিল, ‘এই গৃহযুদ্ধ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হলেও গেরিলা যুদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করলে বিপজ্জনক আন্তর্জাতিক পরিণতির সৃষ্টি করবে। এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের রাষ্ট্রবর্গের উচিত তারা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে আহ্বান জানাবেন যেন মানবতা ও শুভ বুদ্ধির ভিত্তিতে তিনি রক্তপাত বন্ধ করেন এবং জনগণের নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেন।
লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফের সংবাদদাতা সাইমন ড্রিং এক সাক্ষাত্কারে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী যে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে তার একটি বর্ণনা দিয়েছেন, ‘২৫ মার্চ রাত ১০টার দিকে আমাদের হোটেলের সামনে দিয়ে সৈন্যদের প্রথম দলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যায়। সৈন্যদের মধ্যে তিনটি গ্রুপ ছিল—আর্টিলারি, ইনফ্যান্ট্রি এবং আর্মড। এর কিছু সময় পর থেকেই শুরু হলো গোলাগুলি। দেখলাম শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে আগুনের শিখা ওপরে উঠছে। মানুষের আর্তচিত্কারের শব্দও পাওয়া যাচ্ছিল।’ নিউ ইয়র্ক টাইমসের সংবাদদাতা সিডনি শনবার্গ ২৫ মার্চ রাতে ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থান করছিলেন। তিনি বলেন, ’৭৫ মিলিয়ন মানুষের পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন ধ্বংস করার জন্য নিরস্ত্র সাধারণ নাগরিকদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী কামান ও ভারী মেশিনগান ব্যবহার করছে।’ ওয়াশিংটন পোস্ট এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে স্বদেশের নাগরিক হত্যার জন্য ইয়াহিয়াকে দায়ী করে। দি পিপল পত্রিকায় প্রকাশের জন্য ২৫ মার্চ রাতে ‘অবরুদ্ধ বাংলাদেশ :কণ্ঠরুদ্ধ সংবাদপত্র’ শিরোনামে একটি রিপোর্ট প্রস্তুত করার সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পত্রিকার অফিস আক্রমণ করে। বোমা আর গোলার আঘাতে অফিসটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় এবং ছয় জন সাংবাদিক নিহত হন। ২৬ এপ্রিলের নিউজ উইক ম্যাগাজিন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নৃশংসতা প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছিল :অভিযানের নৃশংসতা ও তিক্ততা দেখে মনে হয় যে, পশ্চিম পাকিস্তানিদের শুধু সামরিক বা নিরাপত্তা টার্গেট ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনকে পুরোপুরি ধ্বংসের উদ্দেশ্য শহরের পর শহরে সৈন্যরা দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ও ভিত্তি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে ছিল বদ্ধপরিকর।
সে সময়ের অবরুদ্ধ পরিস্থিতি সম্পর্কে লন্ডনভিত্তিক দ্য সানডে টাইমস পত্রিকার পাকিস্তান সংবাদদাতা অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের বর্ণনা থেকেও ধারণা পাওয়া যায়। এ পত্রিকায় বাংলাদেশের গণহত্যার ওপর তার লেখা বিস্তারিত রিপোর্ট ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ জুন ‘Genocide : Full Report’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। সাংবাদিক জন পিলজারও Daily Mirror পত্রিকায় পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা নির্বিচারে বাঙালিদের হত্যা ও নির্যাতনের এক ভীতিজনক বিবরণ প্রদান করেন। এছাড়া বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে ১৯৭১ সালের ২ আগস্ট নিউজউইক ও টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ কাহিনি হয়। নিউজ উইকের শিরোনাম ছিল ‘বাংলা—একটি জাতির হত্যা’। টাইমের শিরোনাম ছিল ‘পাকিস্তান—সোনার বাংলার ধ্বংসসাধন’। ২৫ অক্টোবর টাইম ম্যাগাজিনে প্রচ্ছদকাহিনি হয় ‘পাকিস্তান—এমনকি আসমানও কাঁদছে’।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-শিশুদের ওপর যে অবর্ণনীয় নির্যাতন, অত্যাচার, নিপীড়ন চালিয়েছিল হিটলারের পর থেকে এ পর্যন্ত এমন পৈশাচিক দৃষ্টান্ত আর এ বিশ্বে দেখা যায়নি। অতএব, এই গণহত্যার বিশ্বস্বীকৃতি আজ সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।