স্রোতের মতো আসছে মরক্কানরা। কাতারের দোহায় আজ ফ্রান্সের বিপক্ষে মরক্কোর সেমিফাইনাল দেখতে মুসলিম দেশগুলো থেকে স্রোতের মতো সমর্থকেরা ছুটে আসছে দোহার মাটিতে। কারো হাতে টিকিট থাকুক কিংবা না থাকুক, মরক্কোর খেলার সময় তারা দোহার মাটিতে পা রাখতে চায়। খেলা হবে দোহার মূল শহর থেকে একটু দূরে। আল খোর এলাকায়, আল বাইয়াত স্টেডিয়ামে। খেলার আগেই সেখানে জড়ো হওয়ার জন্য লাখো মানুষ প্রবেশ করছে দোহায়।
মরক্কোর রাজধানী কাসাব্লাংকা থেকে ৩০টা বিশেষ ফ্লাইট দুই দিনের জন্য চালু করেছে মরক্কো। আজকে খেলার দিন এবং আগামীকাল ফিরে যাওয়ার জন্য এই বিশেষ ফ্লাইট চালু করা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ও ফুটবল ফেডারেশনের যৌথ উদ্যোগে মরক্কোর বিমান প্রতিষ্ঠান ২৪ ঘণ্টার জন্য এমন উদ্যোগ নিয়েছে। তাতে সর্বোচ্চ সংখ্যায় আসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যেন সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় দর্শকদের পাঠানো যায় দোহায়।
এবারের আসরে মরক্কো তাদের ফুটবলে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। বর্তমান ফুটবলাররা গৌরব করা ইতিহাস লিখেছে। তাদের সাফল্যে ফিলিস্তিনিরা সাফল্যের গান লিখেছে। ফিলিস্তিনের রাজধানী রামাল্লায় চলছে উৎসব। মধ্যপ্রাচ্যের যেসব দেশ রয়েছে, সেখান থেকে নারী-পুরুষ ছুটে আসছেন দোহায়। কেউ আসছেন পরিবার নিয়ে। সোমালিয়া, সুদান, তিউনিসিয়া, ইরাক, মিশর, জর্ডান, আরব আমিরাত, ইয়েমেন, লিবিয়া, লেবানন, ওমান, বাহরাইন, মউরিতানিয়া, কমোরোস, আলজেরিয়াসহ মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর নাগরিকেরা ছুটে আসছে দোহায়।
বউ, শাশুড়ি, বউয়ের বোন—কেউ বাদ যাননি মরক্কো থেকে আমির সালতাউতের পরিবারের। ছোট বাচ্চা কোলে নিয়ে ইমানে বোরানি, পাশে শাশুড়ি ফাতেমি আমিরি, ছোট বাচ্চা মালেখ সালতাউত। মরক্কোর কাসাব্লাংকা থেকে ৮ ঘণ্টার ফ্লাইটে চড়ে চলে এসেছেন দোহায়। উঠেছেন হোটেলে। দিনে ৬০ হাজার টাকা ভাড়ায় হোটেল নিয়েছেন। খেলা দেখতে এসেছেন। কীভাবে কত টাকা দিয়ে টিকিট কিনলেন জানতে চাইলে ভবন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে কাজ করা এই মরক্কান জানালেন, তাদের নাকি টিকিটই নেই। টিকিট ছাড়া পুরো পরিবার নিয়ে চলে আসা হয়েছে? ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বললেন, ‘এখানে টিকিট কোনো বিষয় নয়। দোহায় খেলছে আমাদের জাতীয় দল। আমরা মুসলিম বিশ্বে ফুটবলে ইতিহাস সৃষ্টি করেছি। এমন সময়ে ঘরে বসে থাকা যায় না। আমরা যতটুকু পেয়েছি, সেটা কল্পনাও করিনি। এখন পুরো দুনিয়া জানবে মরক্কো ফুটবলে কী করতে পারে।’
সুদান থেকে ইব্রাহিম জানালেন, ২ লাখ মানুষ এসেছে। সবার লক্ষ্য ফুটবল দলের পাশে থাকা। আজিম আদেল এসেছেন ইরাক থেকে। ‘দেখুন, মরক্কো বিশ্বকাপ ফুটবলে যেটা করেছে, তা ইতিহাস। আপনি যদি এই ইতিহাসের সাক্ষী হতে না পারেন, সেটা আপনার ব্যর্থতা। আমরা দেশ ছেড়ে ছুটে এসেছি, কারণ ফুটবলে মুসলিম দেশকে নিয়ে যেভাবে অবজ্ঞা করা হতো, সেটার একটা জবাব দিয়েছে মরক্কো।’ বললেন আজিম আদেল। দোহায় সব উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু কর্নিশ। এখানেই বিশাল খোলা জায়গায় ফিফা ফ্যানফেস্ট করা হয়েছে। হাজারো মানুষের বিনোদনের জায়গা এটি। ঢাকার রমনা পার্ক কিংবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মতোই। বিশ্বকাপ চলাকালীন প্রতিদিন বিকাল হলে সবাই এখানে জড়ো হচ্ছে।
মুসলিম দেশে সবার ভাষা আরবি। ইংরেজি বলে খুব কম। ভেঙে ভেঙে বলে। কিছু মানুষ খুবই ভালো বলে। ১৩ বছরের মেয়ে নাদিন। ছুটে বেড়াচ্ছে কর্নিশে। সে-ও একই। ইংরেজি বলে না। প্রথমে ভয় পেয়েছিল, কেন কথা বলতে চাইছি। পরে নিজেই বোঝানোর চেষ্টা করেছে। মরক্কোর ফুটবল জয়ে তাদের এই উৎসব। আনন্দে ছুটে চলা। গুয়াংজু আল গ্রাফি ট্রেডিং কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার ইঞ্জিনিয়ার ইব্রাহিম এলামিন খালাফ আলা এসেছেন দোহায়। শহর জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন স্ত্রীকে নিয়ে। তারাও রয়েছেন মরক্কোর ম্যাচ দেখার অপেক্ষায়।
দোহা এখন মরক্কানদের দখলে। মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানেরাই মরক্কানদের সম্মান করছেন। বিশ্বকাপ ফুটবলে আসা আন্তর্জাতিক সাংবাদিকেরা আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ফ্রান্স, জার্মানি, ক্রোয়েশিয়াসহ শক্তিশালী দেশগুলো নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। মরক্কো নামের একটি দেশ খেলতে এসেছে। তা নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের আগ্রহ ছিল না। কেউ ফিরেও তাকায়নি। শুরুতেই তারা গ্রুপ পর্বে ২০১৮ বিশ্বকাপ রানার্সআপ ক্রোয়েশিয়ার মতো দেশের বিপক্ষে ড্র করে তাক লাগিয়ে দেয়। ক্রোয়েশিয়াকে গোল করতে দেয়নি। বেলজিয়ামকে হারিয়ে জানিয়ে দেয়, মরক্কোর দিকে তাকাবে কি না বলো। কানাডাকে হারিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে এড়িয়ে যাওয়া সংবাদমাধ্যমকে নিজেদের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। এরপর শেষ ষোলোর লড়াইয়ে স্পেনকে হারিয়ে দেয় মরক্কো। আর কোয়ার্টার ফাইনালে পর্তুগালকে হারিয়ে আজ সেমিফাইনালে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের মুখোমুখি তারা। এমন সাফল্যে খেলার টিকিট থাকুক বা না থাকুক, তারা দোহার আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে খেলোয়াড়দের পাশেই থাকতে চায়।