শিশুকালে রূপকথার গল্পে সোনার থালা-বাসনে খাবার খাওয়ার মধ্যে একধরনের বিলাসিতা ও বাহাদুরির কথা শুনেছিলাম। মূলত, অচিনপুরের রাজা ও রাক্ষস-খোক্কস এবং আরব্য উপন্যাসে সোনা, রুপা, হীরা, মতি, চুণি-পান্না, জহরত ইত্যাদির তৈরি প্রাসাদ, পোশাক, খাবারের অলীক কথা শুনেছি। এরপর কিছু বড় হয়ে অনেক ধনী দেশের রাজা-বাদশাহর মধ্যে সোনার সিংহাসন, স্বর্ণমুকুট, সোনার সুতাখচিত পোশাক, পালঙ্ক, তৈজসপত্র নানা কিছু ব্যবহারের কথা শুনেছি। এরপর রাজা-বাদশাহ ছাড়াও যুগে যুগে অতি বিত্তশালী, জমিদারদের বিলাসব্যসনে সোনা-রুপা, হীরা, মতি, চুণি-পান্না ব্যবহারের কথা জানা যায়।
ষোড়শ শতাব্দী থেকে মিশরের বিখ্যাত হাকিমগণ রাজকীয় দাওয়াই তৈরি করতে স্বর্ণ ব্যবহার শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে ধনী ব্যক্তিরা পৌরুষ বাড়াতে বোতলের মধ্যে কস্তুরি, স্বর্ণভষ্ম ইত্যাদির মিশ্রণ করা সিরাপ গ্রহণে উত্সাহী হয়ে পড়ে। সেই থেকে আধুনিক কালেও কোনো কোনো কবিরাজি, আয়ুর্বেদি ওষুধে এসব ব্যবহূত হয়ে থাকে। তবে এতে কারো আয়ু বৃদ্ধি হয় কি না, তা জানা নেই।
কিন্তু অতীতে কোনো মানুষ সোনাকে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করেছেন বলে শোনা যায়নি। কালের পরিক্রমায় বর্তমানে সোনা একশ্রেণির মানুষের খাবারের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। সম্প্রতি জাপানে সোনা মেশানো আইসক্রিম বিক্রির কথা বেশ সাড়া জাগিয়েছে। বাংলাদেশে ৫ এপ্রিল ২০২৩ সালের রমজান মাসে একটি পাঁচ তারকা হোটেলে সোনায় মোড়ানো জিলাপি বিক্রির কথা বেশ রসালো হয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিল।
জাপানের এক আইসক্রিম কোম্পানির নাম সিলাটো। তারা ‘বিয়াকুয়া’ নামক একধরনের আইসক্রিম তৈরি করেছে। এর একেকটি আইসক্রিমের দাম ধরা হয়েছে ৬ হাজার ৬৯৬ ইউএস ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় সাড়ে ৬ লাখ টাকা। এর কারণ হলো, এই আইসক্রিম বানাতে পাতলা সোনার পাতা ব্যবহূত হয়। এটাতে একধরনের ছত্রাক ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি ইটালি থেকে আমদানি করতে হয়। আইসক্রিমটি একটি বড় কাপের মধ্যে থাকে এবং সঙ্গে একটি রুপালি চামচ ব্যবহার করাতে হয়। সেই চামচ একটি পাত দিয়ে মোড়ানো থাকে। ঢাকার হোটেল সারিনা তাদের ১৯তম বর্ষপূর্তিতে সোনার আইসক্রিম তেরি করেছিল, যার একেকটির দাম ছিল ৯৯ হাজার ৯৯৯ টাকা মাত্র।
ঢাকার হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল গত রমজান মাসে ইফতারিতে সোনায় মোড়ানো জিলাপি বিক্রি করেছিল। এই জিলাপিতে ভক্ষণযোগ্য পাতলা সোনার আস্তরণ দেওয়া হতো। সেটা জিলাপির শেষ অংশের দিকে উজ্জ্বল সোনার আভায় জ্বল জ্বল করে সোনার উপস্থিতি জানান দিত। সেই সোনার জিলাপি বিক্রির অর্ডার নেওয়ার জন্য ব্যবস্থা ছিল। তারা রমজানে ইফতার বিক্রির বিশেষ আকর্ষণ তৈরি করতে এই জিলাপি তৈরি করেছিল। প্রতি কেজি জিলাপির দাম ধরা হয়েছিল ২০ হাজার টাকা।
তবে পবিত্র রমজান মাসে কৃচ্ছ্রসাধনের সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সোনার জিলাপির অর্ডার নিয়ে ব্যাপক আলোচনা, বিতর্ক শুরু হলে অল্প দিনেই তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ‘গোল্ড জিলাপি সোল্ড আউট’ নামে নোটিশ দেওয়া হয়। সেটা আর চালু হয়নি।
এর আগে সোনায় মোড়ানো ডোনাট, পিত্জা ও বার্গার বিক্রির খবরে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সাড়া পড়েছিল। সেগুলোও ছিল অন্যান্য বাণিজ্যিক পণ্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বিশেষ আয়োজন বা মেলায়। পৃথিবীর আর কোনো দৈনন্দিন রসনা তৃপ্তির খাবার সোনা দিয়ে তৈরি হয় কি না, আমার জানা নেই। তবে সোনার গাড়ি, বাড়ি, মসজিদ, মন্দির, চেয়ার, ঘড়ি, কলম, খাট, সোফা, সিঁড়ি, বিছানা ইত্যাদি কমন। রাশিয়ায় সোনার টয়লেট নিয়ে কিছুদিন আগে বেশ সমালোচনা হয়েছিল। সৌদি যুবরাজ ও ব্রুনাইয়ের বাদশাহর সোনাপ্রীতি খুবই মুখরোচক আলোচনার জন্ম দেয়। তাদের কারো প্রাইভেট জেট বিমানের সিঁড়ি এবং কারো ঘোড়ার জিনও সোনার পাত দিয়ে মোড়ানোর সংবাদ পাওয়া যায়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের টয়লেট ও সুইমিংপুলে সোনার কাজ কারা রয়েছে বলে শোনা গেছে।
তবে এসব ধনী মানুষ সোনাকে উদরপূর্তি করার জন্য খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করেছেন বলে শোনা যায়নি। কারণ, সোনা আদতে কোনো খাদ্যবস্তু নয়। এটা একটা ধাতু। সোনা দুষ্প্রাপ্য ও মূল্যবান ধাতু। এই ধাতুতে মরিচা ধরে না, সহজে নষ্ট হয় না। তাই এর রং বা বর্ণ উজ্জ্বল থাকে, শোভা বাড়ায় এবং মানুষের মন কাড়ে। সোনাকে যত ঘষা যায়, ততই চকচকে রূপ ধারণ করে। এজন্য মানুষ এটাকে দামি জ্ঞানে মূল্যবান জিনিস হিসেবে সংরক্ষণ করে থাকে।
সোনা কি মানুষের খাদ্য? এই প্রশ্নের উত্তর মানুষই দিয়েছে। গহনার জন্য সোনা ও খাদ্যের জন্য সোনা আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যের। খাবারের মধ্যে সোনাকে উপযোগী করতে ভোজ্য স্বর্ণের পাত ‘২৪ ক্যারেট এডিবল গোলাড লিফ’ তৈরি করা হয়েছে। এজন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কারখানা চালু করে বিক্রির প্রচলন শুরু হয়েছে বাণিজ্যিকভাবে। অনলাইন শপে ৪০০ মিলিগ্রাম ভোজ্য সোনার লিফের দাম ধরা হয়েছে ৬০ ডলার বা প্রায় ৭ হাজার টাকা।
সোনা অ্যাসিডে গলে না। তাই পেটে গেলে শোষিত হয় না এবং শরীরের কোনো পুষ্টি সাধন বা ক্ষতি করে না। পেট থেকে বেরিয়ে যায়। তবে ভোজ্য সোনা গ্রহণের জন্য কিছু সতর্কতা রয়েছে। ইউরোপীয় খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ ভোজ্য সোনার জন্য ১৯৭৫ সালে ই-১৭৫ নামক একটি নিয়ম চালু করে দিয়েছে। ২০১৬ সালে সেই মাত্রা পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, কত ওজনের মানুষের জন্য কতটুকু স্বর্ণ ভক্ষণ নিরাপদ।
প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে অদ্যাবধি সোনার কদর বিরাজমান। আদি স্বর্ণমুদ্রা ও দ্রব্য বিনিময়ে সোনা ছিল। আজকাল কোনো দেশের মুদ্রার সমপরিমাণ মূল্যমান সোনা সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। কখনো কখনো বৈদেশিক বাণিজ্যের সময় ডলারের ঘাটতি মেটাতে রিজার্ভের সোনা বিক্রি করে লেনদেন করা হয়ে থাকে। উপমহাদেশে নির্ভরশীল নারীদের স্বর্ণালংকার একটি বিশেষ নিরাপত্তার প্রতীক। এজন্য বিয়ের গহনায় সোনা, নারী নিরাপত্তায় সোনার গহনা দান খুব প্রচলিত রীতি। বিয়ের যৌতুকে সোনা, বাজিতে, কৌতুকে সোনাকে গুরুত্ত্ব দেওয়া হয়। আমাদের দেশে ছোট বাচ্চাদের সোনামণি নামে ডাকা হয়। সোনার পদক, সোনালি যুগ, সোনার খনি ইত্যাদি বলে আমাদের কৃষ্টিতে সোনাকে অনেক মহামূল্যবান জিনিস হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
তবে মানুষ কবে থেকে সোনা খাওয়া শুরু করেছে, তার কোনো সঠিক দিনক্ষণের উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে প্রাচীন মিশরকে সর্বপ্রথম সোনাকে ওষুধের মাধ্যমে খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের দিক থেকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা জানা যায়। স্বর্ণ চোরাচালনিরা বিদেশে সোনা খেয়ে পেটে ভরে দেশে ফিরে কাস্টমসের হাতে ধরা পড়ে বিমানবন্দরের ডিটেক্টর মেশিনে নিশ্চিত হওয়ার পর টয়লেটে ব্যায়াম করে সোনার ডিম পাড়ার কাহিনি কত কৌতুকের জন্ম দিয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আমাদের দেশে সোনার চেইন চুরি করে হাইজ্যকাররা ধরা পড়ার ভয়ে গিলে খেয়ে ফেলে।
মানুষ সর্বভূক প্রাণি। পৃথিবীতে এমন কোনো প্রাণি নেই, যা কোনো না কোনো দেশের মানুষের খাদ্যতালিকায় নেই। তবু খাবারের অভাবে প্রতিদিন হাজারো মানুষ মৃত্যুবরণ করে থাকে। এই মায়ার পৃথিবীতে বিত্তশালী মানুষ দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে চায়। তাই যখন ধনীরা অবগত হয়েছে যে স্বর্ণ ভক্ষণ করলে দূরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্ত থেকে দীর্ঘায়ু লাভ করা সম্ভব, তখন থেকে তাদের আয়ুবর্ধক ওষুধে সোনা স্থান করে নিয়েছে। পরবর্তী সময়ে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ২৪ ক্যারেটের খাঁটি সোনার পাতা তৈরি করে ভোজ্যস্বর্ণ হিসেবে ধনীদের বিলাসী খাবারের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। বর্তমানে বাণিজ্যিক চিন্তায় এর ব্যবহার শুরু করেছে। যদিও ধর্মে সোনা খাওয়া দূরে থাক, সোনা-রুপার পাত্রে খাদ্য খাওয়াটাও নিষিদ্ধ।