আসন্ন পবিত্র ঈদুল আজহায় প্রয়োজনীয় কোরবানির পশুর শতভাগ জোগান এবারও দেশের পশুতেই সম্ভব হবে। দেশে চাহিদার চেয়ে কোরবানিযোগ্য পশু বেশি রয়েছে। তবে পশুখাদ্যের দাম বাড়ায় বাজারে এবার পশুর দামও কিছুটা বেশি হতে পারে। চাহিদার চেয়ে বেশি পশু থাকায় দেশের বাইরে থেকে পশু আনা বন্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
বিজ্ঞাপন
উৎপাদন বৃদ্ধি ও দেশের খামার বিকশিত করার লক্ষ্যে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চলতি বছর দেশে এক কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৯টি কোরবানিযোগ্য পশু রয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় দুই লাখ সাত হাজার বেশি। এ বছর কোরবানিতে পশুর চাহিদা ধরা হয়েছে ৯৭ লাখ ৭৫ হাজার। সেই হিসাবে এ বছর চাহিদার চেয়ে ২৩ লাখ ৪৯ হাজার ৩৮৯টি গবাদি পশু বেশি রয়েছে।
চার বছর আগেও কোরবানির হাটে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিদেশি পশু দেখা যেত। তবে দিন দিন দেশে গবাদি পশুর উৎপাদন বাড়ছে। কোরবানিতে পশুর চাহিদার সবটুকু পূরণ হচ্ছে দেশের গবাদি পশু দিয়ে। এ কারণে কোরবানির পশু আমদানি পুরোপুরি নিরুৎসাহ করা হয়েছে।
জানতে চাইলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ বছর কোরবানিযোগ্য এক কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজারের বেশি গবাদি পশু প্রস্তুত রয়েছে। গত বছর এক কোটি ১৯ লাখ গবাদিপ শু প্রস্তুত ছিল, তার মধ্যে প্রায় ৯১ লাখ গবাদি পশু কোরবানি হয়েছে। এ বছর চলাচলে কোনো বিধি-নিষেধ না থাকায় গত বছরের চেয়ে কোরবানি বেশি হবে বলে আমরা আশা করছি। ’ তিনি আরো বলেন, ‘এবার কোরবানিযোগ্য পশুর মধ্যে গরু-মহিষ রয়েছে ৪৬ লাখ ১১ হাজার ৩৮৩টি, ছাগল-ভেড়া রয়েছে ৭৫ লাখ ১১ হাজার ৫৯৭টি এবং অন্যান্য পশু রয়েছে ১৪ হাজার ৯টি। ’ তাঁর মতে, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের গবাদি পশু ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগে অতি সহজেই নেওয়া সম্ভব হবে। ফলে এসব অঞ্চল থেকে এবার ঢাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলে প্রচুর গবাদি পশুর জোগান হবে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, এ বছর দেশের আটটি বিভাগের ছয় লাখ ৮১ হাজার ৫৩২টি খামার থেকে ৭৫ লাখ ৯০ হাজার ৬৪২টি গবাদি পশু আসবে। তার মধ্যে ঢাকা থেকে ছয় লাখ ৩৭ হাজার ১৯৬টি, চট্টগ্রাম থেকে ১৫ লাখ ১২ হাজার ১১৪টি, রাজশাহী থেকে ২৭ লাখ ২৮ হাজার ৪৬০টি, খুলনা থেকে আট লাখ ৭৯ হাজার ২৫১টি, বরিশাল থেকে তিন লাখ ৭৪ হাজার ৫৪৩টি, সিলেট থেকে এক লাখ ৬৬ হাজার ৩৫৩টি, রংপুর থেকে ১০ লাখ তিন হাজার ২৮১টি এবং ময়মনসিংহ থেকে আসবে দুই লাখ ৯ হাজার ৩৪৪টি পশু। আর গৃহপালিত গবাদি পশু আসবে ৪৫ লাখ ৩৩ হাজার ৭৪৭টি।
জানতে চাইলে ফরিদপুর ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও মার্শ অ্যাগ্রোর মালিক মীর কাশেম আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘খামারিদের পর্যাপ্ত গরু রয়েছে, গত বছরের অবিক্রীতও অনেক গরু আছে। আমার খামারে কোরবানিযোগ্য ৩৫টি গরু রয়েছে। খাদ্যের দাম বাড়ায় এবার কিছুটা বেশি দামে গরু বিক্রি হবে। ’ তিনি বলেন, ‘কোরবানির জন্য এরই মধ্যে গরু বিক্রি শুরু হয়েছে। যেসব গরু বিক্রি হচ্ছে সেগুলোতে মোটামুটি ভালোই দাম পাওয়া যাচ্ছে। সে হিসাবে আমরা আশা করছি, এবার ভালো দাম পাওয়া যাবে এবং গরু বিক্রিও হবে বেশি। ’
পশুর বাণিজ্যিক খামারিরা বলছেন, দেশে পর্যাপ্ত গবাদি পশুর জোগান থাকলেও পশুখাদ্যের দাম প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়েছে। পশুর জন্য অন্যান্য ক্ষেত্রেও ব্যয় বেড়েছে। তাই এবার কোরবানি পশুর দাম গত বছরের তুলনায় কিছুটা বেশি থাকবে।
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সাধারণ সম্পাদক শাহ ইমরান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কোরবানিতে গবাদি পশুর যে চাহিদা, তার পর্যাপ্ত জোগান দেশেই আছে। তবে গত এক বছরে পশুখাদ্যের দাম প্রায় ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার কারণে এবার গরুর দাম কিছুটা বেশি হতে পারে। ’
এদিকে সিলেট, সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সাম্প্রতিক বন্যায় গবাদি পশুর খাবারের বেশ সংকট হয়। দাম বেড়ে যায় গোখাদ্যের। এর প্রভাব কোরবানির পশুর হাটে পড়তে পারে। যদিও কর্মকর্তারা এটা মানতে নারাজ। দেশের অন্যতম গোচারণভূমির এলাকা সিরাজগঞ্জ। এই জেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা গৌরাঙ্গ কুমার তালুকদার জানান, সরকারি হিসাবে সিরাজগঞ্জের ৯টি উপজেলায় খামারি ও কৃষকরা ৯ লাখ গরু, সাড়ে তিন লাখ ছাগল এবং দুই লাখ ভেড়া ও মহিষ প্রতিপালন করছেন। কোরবানির জন্য এক লাখ ৭০ হাজার ২৮৬টি গরু, দুই হাজার ৮৯৫টি মহিষ, এক লাখ ৯২ হাজার ৪৬৬টি ছাগল ও ২৫ হাজার ৫২০টি ভেড়া প্রস্তুত হয়েছে, যা জেলার চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ অন্যান্য জেলায় বিক্রি হবে।
শেরপুরে চলতি বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে গরু কিংবা গবাদি পশুর তেমন একটা ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তবে কিছু চারণভূমি ডুবে যাওয়ায় খাবারের সংকটে ভুগতে হচ্ছে। জেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের হিসাব মতে, চলতি বন্যায় কোনো গবাদি পশুর মৃত্যু ঘটেনি।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেছেন, ‘কোরবানির পশুর জন্য আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি। অন্যান্য বছরের মতো এবারও কোরবানির পশুর চাহিদা নিরূপণ করা হয়েছে। কোরবানির চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত পশু প্রস্তুত আছে। ফলে কোরবানির জন্য কোনো রকম সংশয়, সংকট বা আশঙ্কার কারণ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে পরিপূর্ণ প্রস্তুতিও রয়েছে। ’ তিনি বলেন, ‘সিলেট-সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন অঞ্চলে সাম্প্রতিক বন্যায় গবাদি পশু কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে গবাদি পশুর খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে, চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করার বিষয়টিও চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। কোরবানির সময় যাতে ওই অঞ্চলে দেশের অন্য অঞ্চল থেকে পশু যেতে পারে, সে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’