স্বপ্নবাজ মানুষ নিজ নিজ স্বপ্নপূরণে কত কিছুই না করে! কেউ জয় করে এভারেস্ট। কেউ হয়তো ডুব দেয় মারিয়ানা ট্রেঞ্চের অতলে। কিন্তু স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে দেশ প্রতিষ্ঠা করে বসেন কেউ- এমনটি শুনেছেন কখনও? লিখেছেন শাহরিয়ার জাওয়াদ
পশ্চিমের ফেইরি টেলস আর দেশীয় ঠাকুরমার ঝুলির রাজা-রানীর রূপকথা শৈশবে আমাদের কল্পনার জগৎকে সাজিয়েছিল নানান রঙে। পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চেপে উড়ে চলা ডালিম কুমার কিংবা অতিকায় দানবের সঙ্গে যুদ্ধ করে বিজয়ী কোনো বীরের গল্প পড়ে ‘রাজা’ হওয়ার সাধ জাগেনি- এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুস্কর। কখনও পিঠে কাপড় ঝুলিয়ে, মাথায় কাগজের তৈরি মুকুট পরে ‘রাজা’ সেজেছি আমরা। স্টিল, কাঠের রোলার কিংবা গাছের সরু ডালকে তলোয়ার বানিয়ে যুদ্ধ করেছি কল্পিত শত্রু আর দৈত্য-দানোর সঙ্গে। সুর করে গেয়েছি রবিঠাকুরের লেখা- ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে-/ নইলে মোদের রাজার সনে মিলব কী স্বত্বে?’
এসব ছিল শুধু আমাদের শিশুসুলভ কল্পনার অংশ। তবে পৃথিবীতে এমনও মানুষ আছেন যাঁরা এই রাজা হওয়ার ইচ্ছেটাকে কখনও হেঁয়ালি বলে উড়িয়ে দেননি। নিজেরা রাজা সাজবার জন্য বানিয়ে নিয়েছেন গোটা একটা রাজ্য! সেই রাজ্যের স্বীকৃতি কেউ দিক বা না দিক, স্বপ্নবাজ মানুষগুলো রাজা হয়েছেন।
খোদ মার্কিন মুল্লুকের দু’জন বন্ধুর কথা জানা যাক প্রথমে। নেভাডা অঙ্গরাজ্যের কেভিন ব’ আর জেমস স্পিলম্যান নামের দু’জন কিশোর তাঁদের নিজেদের রাজ্য বানাতে বেশ উঠেপড়ে লাগেন। এই ঘটনা ১৯৭৭ সালের মাঝামাঝি সময়ের। চারপাশের সবার কাছে এটা নিতান্ত ছেলেখেলা মনে হলেও কেভিন আর জেমস তাঁদের পরিকল্পনা থেকে সরে আসেননি। বহু বছর পর, ২০১৬ সালের এপ্রিলে অবশেষে কেভিন তাঁর নিজের রাজ্যের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। রিপাবলিক অব মোলোশিয়া- কারসন নদীর কাছে ডেটন ভ্যালির প্রায় ১.২৮ একর জায়গা পরিচিতি পায় একটা স্বতন্ত্র অণুদেশ বা মাইক্রোনেশন হিসেবে। যে দেশের নাগরিক সংখ্যা বত্রিশ। যেখানে আছে নিজস্ব পতাকা, জাতীয় সংগীত, স্বতন্ত্র মুদ্রা- ভ্যালোরা।
আছে স্বতন্ত্র আইনকানুন, স্থানীয় সময়। কেভিন ব’ নিজেই এখানকার প্রেসিডেন্ট। মোলোশিয়ার মতো পৃথিবীজুড়ে প্রায় একশরও বেশি মাইক্রোনেশন কিংবা অণুদেশ আছে, যাদের আয়তন কয়েক বর্গমিটার থেকে কয়েক বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত হয়। তবে পৃথিবীর বৃহত্তম মাইক্রোনেশনটি অবস্থিত অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে। ২০০১ সালের ১ নভেম্বর ট্রেভিস ম্যাকহেনরি নামের এক আমেরিকান ব্যবসায়ী জনমানবহীন এই অঞ্চলের প্রায় ১৩ লাখ ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাকে ‘ওয়েস্টার্টিকা’ নামের স্বতন্ত্র দেশ হিসেবে ঘোষণা করেন।
মাইক্রোনেশন বলতে সেইসব অঞ্চলকে বোঝায়, যেখানকার অধিবাসীরা অঞ্চলটিকে একটি স্বাধীন স্বতন্ত্র দেশ হিসেবে উল্লেখ করে। কিন্তু এসব দেশের স্বীকৃতি জাতিসংঘ বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা বা দেশ দেয় না।
বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত মাইক্রোনেশনের নাম হলো সিল্যান্ড। ৫৫০ বর্গমিটারের এই স্বীকৃতিহীন দেশটির অবস্থান উত্তর সাগরে, ব্রিটিশ সমুদ্র উপকূল থেকে মাত্র দশ কিলোমিটার দূরত্বে। প্রকৃতপক্ষে, প্রিন্সিপালিটি অব সিল্যান্ড একটি পরিত্যক্ত সমুদ্র দুর্গ। ইস্পাত নির্মিত বড় দুটো পাইপের ওপর এই দুর্গটি সমুদ্রস্রোতের ওপর ভাসমান অবস্থায় আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, শত্রুদের ওপর নজরদারি করতে, বিশেষত জার্মান বিমান ও নৌ হামলা প্রতিহত করতে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী এই দুর্গ নির্মাণ করে। বিশ্বযুদ্ধের পর, এই দুর্গের স্বত্বাধিকারী হন রয় বেটস নামের একজন ইংরেজ ভদ্রলোক। ১৯৬৭ সালে এই দুর্গের মালিকানা লাভের পর সংশ্নিষ্ট এলাকাটিকে স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করে বেটস পরিবার।
অতিসম্প্রতি বেলিজের উপকূলবর্তী দ্বীপ ‘কফি কায়ে’ বেশ পরিচিত হয়ে উঠছে। মার্শাল মেয়ার নামের একজন ভদ্রলোকের উদ্যোগে ২০১৮ সালে ‘লেটস বাই অ্যান আইল্যান্ড’ শিরোনামে একটি ফান্ড সংগ্রহ শুরু হয়, যার প্রধান লক্ষ্য ছিল সম্মিলিতভাবে একটি দ্বীপ কিনে নেওয়া। এক বছরের মাথায় এই উদ্যোগের অধীনে বেলিজ সরকারের কাছ থেকে ‘কফি কায়ে’ কেনা হয়। অংশীদারদের পরিকল্পনামাফিক দ্বীপটির নতুন নাম হয় ‘প্রিন্সিপালিটি অব আইল্যান্ডিয়া’। ঘোষণা করা হয় স্বতন্ত্র সরকার ব্যবস্থা, জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় সংগীত। প্রবাল দ্বীপটি জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ।
মাইক্রোনেশনটির দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিচালনা পরিষদ একটি দারুণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এই অণুদেশে সব ধরনের প্লাস্টিক পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ। কফি কায়ে এবং এর আশপাশের অঞ্চলকে দূষণমুক্ত রাখতে, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের তাগিদে বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নিয়েছে এই পরিষদ। বিনিয়োগকারীরা চাইছেন বিশ্ববাসীর সামনে একটি অনুকরণীয় আদর্শ তৈরি করতে। পরিবেশ দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ-সংঘাত আর মহামারি-পরবর্তী বিধ্বস্তপ্রায় পৃথিবীতে তাঁরা ছড়িয়ে দিতে চাইছেন একতার বার্তা, সাম্যের বার্তা। পৃথিবীবাসীকে বোঝাতে চাইছেন, একসঙ্গে থেকে, পাশাপাশি কাজ করে গড়ে তোলা সম্ভব একটা বিদ্বেষহীন নির্মল পৃথিবী। তাঁদের উদ্যোগের সঙ্গী হতে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারী। এগিয়ে আসছেন অনেক সাধারণ মানুষ।
মাইক্রোনেশন প্রতিষ্ঠার ভাবনাগুলো বেশ উদ্ভট। অন্য রকম। এটা হতে পারে নিতান্ত ছেলেমানুষি। তবে এই ভাবনাগুলো নতুন করে চিন্তা করতে শেখায়। নিজ নিজ স্বপ্নের পেছনে ছুটতে শেখায়। আমরা আরও একবার বুঝতে পারি, স্বপ্নের চেয়ে বড় কিছু আর হয় না!