১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ প্রণীত হয়েছিল, যাহা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি টার্নিং পয়েন্ট বলে বিবেচিত হয়। বিশ্বদরবারে এই ঘোষণাপত্র ঐতিহাসিক ও অনন্য দলিল হিসেবে সমাদৃত।
ঢাকায় পাকিস্তান পার্লামেন্টারি পার্টির লিডার ও আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সমঝোতা নাটক ব্যর্থ হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। ঐ কালরাতে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক ও কোর কমান্ডার লে. জেনারেল টিক্কা খানের নির্দেশে জেনারেল রাও ফরমান আলীর নেতৃত্বে ঢাকায় এবং জেনারেল খাদিমের নেতৃত্বে অন্য ১০টি শহরে রাত ১১টা ৩০ মিনিটে শুরু হয়ে যায় পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নির্মম হত্যাযজ্ঞ।
’৭১-এর ২৬ মার্চ ১২টা ২০ মিনিটে (প্রথম প্রহর) পাকিস্তান পার্লামেন্টের মেজরিটি পার্টির লিডার আওয়ামী লীগের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওয়্যারলেসের মাধ্যমে বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। “ইহাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো (অনূদিত) শেখ মুজিবুর রহমান। অতঃপর রাত ১টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারকৃত অবস্থায় ঢাকা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের লয়ালপুর জেলে স্থানান্তর করা হয়। (সূত্র:উইটনেস অব স্যারেন্ডার, লেখক:সিদ্দিক সালিক)।
প্রখ্যাত সাংবাদিক সায়মন ড্রিংই প্রথম ২৫ মার্চের পরিকল্পিত গণহত্যার খরবটি ৩০ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বকে অবহিত করেন, যার শিরোনাম ছিল ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান। প্রতিবেদনে তিনি বলেন, আল্লাহর নামে আর অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে ঢাকা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত এবং সন্ত্রস্ত এক নগরী।
তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার কেন্ট ব্লাড ২৭ মার্চ ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টে একটি টেলিগ্রাম পাঠান, যার শিরোনাম ছিল ‘সিলেক্টিভ জেনোসাইড’। ৬ এপ্রিল দ্বিতীয় টেলিগ্রামের শিরোনাম ছিল ‘ব্লাড’। ২৫ মার্চ থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত যে নৃশংস গণহত্যা চালানো হয়, সেখানে মানবতা ও গণতান্ত্রিক কাঠামো ভূলুণ্ঠিত হয়।
২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নিরাপত্তাবিষয়ক আর্কাইভ তাদের অবমুক্তকৃত দলিল প্রকাশ করে। সেখানে বাংলাদেশের নারকীয় হত্যালীলাকে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস ‘দ্যা রেপ অব বাংলাদেশ’ বইয়ের মুখবন্ধে বলেন, হিটলারের নাৎসি বাহিনীর অমানবিক কার্যকলাপে পড়েছি। কিন্তু ইস্ট বেঙ্গলে যা দেখলাম, তার চেয়েও ভয়ংকর ও যন্ত্রণাদায়ক। গ্রন্থের ‘গণহত্যা’ অধ্যায়ে লিখেছেন, সারা প্রদেশে হত্যাযজ্ঞের সুব্যবস্থার নমুনার সঙ্গে জেনোসাইড শব্দটির অভিধানিক সংজ্ঞার হুবুহু মিল রয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স স্পট রিপোর্ট ৪৩-এর অনুচ্ছেদ ১-এ বলা হয় :পাকিস্তানের পূর্ব অংশকে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করেন।
২ এপ্রিল ভোরে একটি সামরিক কার্গো বিমানে তাজউদ্দীন আহমদ, ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলাম, বিএসএফের ডিজি কে এফ রুস্তমজি ও আঞ্চলিক প্রধান গোলক মজুমদার দিল্লির উদ্দেশে কলকাতা বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। ৪ এপ্রিল তাজউদ্দিন আহমেদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। ‘হাউ ইজ শেখ মুজিব? ইজ হি অল রাইট? জবাবে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। তিনি তার স্থান থেকে আমাদের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের বিশ্বাস, তিনি আমাদের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন’ (সূত্র:মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, লেখক:ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলাম)। উভয়ে প্রবাসী সরকার গঠনের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছান।
১০ এপ্রিল স্বাধীন গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলো। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী জনগণকর্তৃক আমাদিগকে প্রদত্ত কর্তৃত্বের মর্যাদা রক্ষার্থে, নিজেদের সমন্বয়ে যথাযথভাবে একটি গণপরিষদরূপে গঠন করিলাম এবং পারস্পরিক আলোচনা করিয়া এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্দ্ররূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করিলাম এবং তদ্বারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ’৭১-০এর ২৬ মার্চ ঘোষিত স্বাধীনতা দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করিলাম।’ যাহা বিশ্বের ইতিহাসে আজও অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে চির অম্লান হয়ে আছে।
উল্লেখিত বিশেষ অধিবেশনে, ’৭০ সালে জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত মোট ১৬৭ সদস্য এবং প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত মোট ২৯৮ সদস্যের সমন্বয়ে গণপরিষদ গঠন করা হয়। উক্ত সংবিধান উপস্থিত ৪০৪ গণপরিষদ সদস্য কর্তৃক স্বাক্ষরিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করা হয়। এম মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী, এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়, যা মুজিবনগর সরকার হিসেবে পরিচিতি পায়। গণপরিষদের চিফ হুইপ ইউসুফ আলী ‘প্রক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স’ (স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র) পাঠ করেন। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি বাংলাদেশের প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান ও স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রক্রিয়ায় আইনি দলিল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
২৬ মার্চ, স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত জনপ্রতিরোধ শুরু হলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়, উক্ত যুদ্ধে সহায়তাকারী বন্ধুপ্রতিম ভারত সরকার ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে উক্ত সরকারের ভূমিকা ছিল অনন্য। এম এ জি ওসমানীকে সশস্ত্র বাহিনীর অধিনায়ক এবং এম এ রবকে চিফ অব আর্মি স্টাফ নিয়োগ দেওয়া হয়। সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয় এবং ১১ জন সেক্টর কমান্ডার নিয়োজিত হন যথাক্রমে জিয়াউর রহমান, কে এম সফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফ, আবু তাহের, রফিকুল ইসলাম, মীর শওকত আলী, সি আর দত্ত, আবু ওসমান চৌধুরী (আগস্ট পর্যন্ত), এম এ মঞ্জুর, এম এ জলিল, এ এন এম নূরুজ্জামান, এম এ বাশার। ১৯৭৬ সালের ৪ জুলাই পেনসিলভানিয়ার ফিলাডেলফিয়ার দ্বিতীয় মহাদেশীয় কংগ্রেসে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুমোদিত হয়। ১৭৭৬ সাল থেকে অদ্যাবধি স্বাধীনতার ১২১টি ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণাপত্রের আংশিক অনুকরণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কেবিনেটের সঙ্গে পরামর্শ-পূর্বক উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন এবং মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, মনি সিং ও মোজাফ্ফর আহমদকে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল, কলকাতায় পাকিস্তান মিশনের ডেপুটি হাইকমিশনার হোসেন আলীর নেতৃত্বে সব কর্মকর্তা পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। উক্ত হাইকমিশনে চ্যান্সেরিতে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ৬ এপ্রিল দিল্লিতে পাকিস্তান হাইকমিশনের দ্বিতীয় সচিব কে এম শেহাবুদ্দিন আহমেদ ও আমজাদুল হক পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ভারতীয় ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ তার গ্রন্থ ‘ইন্ডিয়া আফটার গান্ধী’তে লিখেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্র শক্তি যেভাবে ইংল্যান্ডের মাটিতে চার্লস দ্য গলের নেতৃত্বাধীন ‘ফ্রি ফ্রেঞ্চ ফোর্স’কে মদত দিয়েছিল, ঠিক সেভাবেই ভারতের সমর্থন পেয়েছিল বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার। ১৯৭১-এর ২ এপ্রিল সোভিয়েট ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে একটি পত্রে লিখেছিলেন, ঢাকায় আলোচনা ভেস্তে যাওয়া এবং সামরিক বাহিনীর শক্তি প্রয়োগ নিয়ে সোভিয়েট ইউনিয়ন গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
১৯৭১ সালের জুলাই মাসে ইউএস সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার গোপনে ওয়াশিংটন থেকে রাওয়ালপিন্ডি হয়ে পিকিং সফর করেন। চীন-মার্কিন সম্পর্ক উন্নয়নে পাকিস্তান মধ্যস্থতা করে। ফলে ৯ আগস্ট দিল্লিতে ২০ বছর মেয়াদি ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়ন মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভারতের পক্ষে দলিলে স্বাক্ষর করেন তত্কালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকো। হিমালয়ের তুষার ও সোভিয়েটের বন্ধুত্ব ছিল চীনের বিরুদ্ধে ভারতের রক্ষাকবচ। ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিজয়কে ত্বরান্বিত করে।
পর্বতপ্রমাণ কফিনের নিচে অখণ্ড পাকিস্তানের কবর রচিত হয়েছে। ৩০ লাখ শহিদের তপ্ত তাজা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা উপাখ্যানের পশ্চাতে রয়েছে মুজিবনগর সরকারের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানের কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ও অপরিসীম আত্মত্যাগ। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ে। অতঃপর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ নিয়াজির নেতৃত্বে পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সৈন্য অস্ত্রশস্ত্রসহ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল জগজিত সিং আরোরা ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপপ্রধান গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারের উপস্থিতিতে বিকাল ৪টা ৩১ মিনিটে অত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। বিশ্বের মানচিত্রে ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। কোনো আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসেনি, একটি সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ।