পুরাতন বছর ২০২২কে বিদায় জানিয়ে নুতন একটি বছর ২০২৩-এ পদার্পণ করেছি আমরা। আশা করব, নতুন বছর আমাদের জন্য সুখের ও আনন্দের হবে, বিশেষ করে বৈশ্বিক মহামারি-উত্তর স্বাস্থ্য খাতে।
একটি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোর মধ্যে একটি হলো এই স্বাস্থ্য খাত। বলা হয়ে থাকে, কোনো দেশে স্বাস্থ্যের দিক থেকে মানুষের অবস্থার উন্নতি দেখা গেলে বোঝা যায় দেশটি অর্থনৈতিকভাবে ভালো অবস্থায় আছে। স্বাস্থ্য খাতে আমাদের অনেক অর্জন সত্ত্বেও বেশ কিছু সমস্যার কারণে স্বাস্থ্যব্যবস্থা আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
এই যেমন ধরুন, উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে পদ থাকলেও অনেক পদ শূন্য রয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি রোগীরা বিনা মূল্যে ওষুধ পায়, অথচ বহির্বিভাগের রোগীরা প্রধানত এ ধরনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। বিপুলসংখ্যক রোগীর চাপের কারণে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও বিশেষায়িত হাসপাতালে মানসম্মত চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।
রোগীরা সাধারণত উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসক পায় না, তাই তারা জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল ও বিশেষায়িত হাসপাতালে আসে। বিপুলসংখ্যক রোগীর ভিড়ের কারণে জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল ও বিশেষায়িত হাসপাতালগুলো রোগীদের মানসম্মত চিকিৎসা দিতে ব্যর্থ হয়।
জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে চিকিৎসার মান উন্নত করা গেলে ঐ সব হাসপাতালে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ রোগীর মানসম্মত চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব। তাই উপজেলা, ইউনিয়ন ও কমিউনিটি ক্লিনিকে চিকিৎসার মান নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
আশার কথা, বিভিন্ন খাতে আমরা অনেক ইতিবাচক জিনিস অর্জন করেছি, কিন্তু সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে স্বাস্থ্য খাতে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছি। তাই স্বাস্থ্য খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে এখন দরকার সঠিক ব্যবস্থাপনা।
আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় পদ সৃষ্টির কথা বলা হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। দেশে ১ হাজার ৫৮১ জনের জন্য মাত্র এক জন নিবন্ধিত চিকিৎসক রয়েছেন। গ্রামীণ, প্রত্যন্ত ও দুর্গম এলাকায় চিকিৎসকের অনুপস্থিতি আরো বেশি।
প্রশিক্ষিত নার্সের সমস্যাও রয়েছে। অনেক হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জাম থাকলেও সেখানে টেকনোলজিস্টের পদ শূন্য রয়েছে। জনবল নিয়োগের ব্যবস্থাপনা (ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিক, ল্যাব-টেকনিশিয়ান) বিকেন্দ্রীকরণ না হলে এ ধরনের অব্যবস্থাপনার কোনো সমাধান হবে না।
শুধু চিকিৎসক নিয়োগ দিয়ে সমাধান হবে না, তাদের নিজ নিজ কর্মস্থলে ধরে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়াটাও জরুরি। পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। দেখা গেছে, যোগ্য কর্মীর অভাবে আধুনিক স্বাস্থ্য সরঞ্জামের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। ধীরে ধীরে এজাতীয় সরঞ্জাম অকেজো হয়ে যায় এবং রোগীরা অবহেলায় মারা যায়।
রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধিকারী স্বাস্থ্যসেবা স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ। আফসোস করে বলা যায়, আমাদের দেশে এখনো এ ধরনের স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। তাই চিকিৎসায় শিক্ষাব্যবস্থাকে চারটি ধাপে শ্রেণিবদ্ধ করা উচিত যেমন : চিকিৎসক, শিক্ষক, প্রশাসন ও রোগ প্রতিরোধ। এ ধরনের চার স্তরের স্বাস্থ্যব্যবস্থা থেকে একজন শিক্ষার্থী তার ভবিষ্যৎ কার্যক্রম নির্ধারণ করবে এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় অংশগ্রহণ করবে।
হাসপাতালের পরিবেশের উন্নতির জন্য পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা অপরিহার্য। হাসপাতাল ও তত্ত্বাবধানে প্রদত্ত পরিষেবা সম্পর্কে তথ্য দেওয়ার জন্য মানবিক বোধসম্পন্ন জনবল নিয়োগ করা উচিত।
অব্যবস্থাপনা এমন একটি বিষয়, যা গত ৫০ বছরে দেশের স্বাস্থ্য খাতের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ। প্রকৃত অর্থে দেশে এখনো পেশাদার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে তাদের জিডিপির ৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ করার পরামর্শ দিয়েছে। গত ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ১ শতাংশেরও কম বরাদ্দ করা হয়েছে। বরাদ্দকৃত অর্থের প্রায় ৭০ শতাংশ ব্যয় হয় বেতন-ভাতা বাবদ, বাকি অর্থ ব্যয় হয় স্বাস্থ্যসেবার জন্য, যা খুবই অপর্যাপ্ত।
স্বাস্থ্য খাতের সার্বিক উন্নয়নের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এই খাতে আর্থিক বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এই খাতকে দুর্নীতিমুক্ত রেখে বর্ধিত বরাদ্দের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
তাই নিয়মিত গবেষণা, সঠিক কর্মপরিকল্পনা এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। আমাদের জনগণের সর্বাত্মক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ত্রুটিগুলো দূর করে স্বচ্ছতার সঙ্গে সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং এর বাস্তবায়ন সময়ের প্রয়োজন।
চিকিৎসার জন্য অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে দেশের অনেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। অন্যদিকে সরকারি হাসপাতালগুলোতে যথাযথ চিকিৎসা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে রোগীরা।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও জেলা পর্যায়ের জেনারেল হাসপাতালের মতো চিকিৎসার প্রতিটি পর্যায়ে জনবলের সংকটের কারণে সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
গড় আয়ু বাড়লেও মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা না পাওয়ায় দেশের বয়স্ক ব্যক্তিরা জীবনের শেষ ভাগে বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন। তাই স্বাস্থ্য কমিশন গঠন জরুরি।
দেশে কার্যকর কোনো স্বাস্থ্যনীতি নেই। এখন আমাদের আগামী ৫০ বছরের জন্য স্বাস্থ্য খাতের রূপরেখা নিয়ে ভাবতে হবে। বৈষম্যমুক্ত সমাজ গঠনের অন্যতম প্রধান কাজ হলো বৈষম্যমুক্ত স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা। আমাদের জাতীয় সংবিধানেও বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা একটি জটিল বিষয়। এই খাতকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য স্বাস্থ্য বিষয়ে ভালো জ্ঞানের পাশাপাশি প্রশাসনিক দক্ষতা থাকা প্রয়োজন। দেখা গেছে, উচ্চ পদে অধিষ্ঠিতদের মধ্যে খুব কমই এই গুণের অধিকারী। সুতরাং, যাদের স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন স্তরে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে এবং জনস্বাস্থ্য, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার মতো বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন, তাদের এই খাতে উচ্চ পদে পদায়ন করা উচিত।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি হয় মূলত ক্রয়-বিক্রয়কে কেন্দ্র করে। তাই ক্রয় প্রক্রিয়া আরো স্বচ্ছ করা জরুরি।
বিশ্বের অনেক দেশেই সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সংস্কারের মাধ্যমে দুর্নীতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব হয়েছে। স্বায়ত্তশাসিত বিশেষ অডিট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার ফলে সেই সব দেশে ক্রয় ও অব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত দুর্নীতি কমাতে সাফল্য এসেছে।
এছাড়া তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণা সমীক্ষায় দেখা গেছে, যখন খাতভিত্তিক বরাদ্দ (ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত ব্যয়ের বিশদ পরিমাণ উল্লেখসহ) সহজে পাওয়া যায়, তখন দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।