১৯৭১ সালের সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ। চাই অবকাঠামোগত পুনর্নির্মাণ, জনগণের কর্মসংস্থান, আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সরকারপ্রধান হলেন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনরায় বিনির্মাণের জন্য কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিসহ এমন কোনো খাত নেই যেখানে পরিকল্পিত উদ্যোগ ও কার্যক্রম তিনি গ্রহণ করেননি। বর্তমান সময়ের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নের প্রাথমিক সূচনা হয়েছিল তারই হাত ধরে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ১৯৭৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতিসংঘের ১৫টি সংস্থার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) সদস্যপদ লাভ করে। আর্থসামাজিক জরিপ, আবহাওয়ার তথ্য আদান-প্রদানে আর্থ-রিসোর্স টেকনোলজি স্যাটেলাইট প্রোগ্রাম বাস্তবায়িত হয় তারই নির্দেশে। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বঙ্গবন্ধু বেতবুনিয়ায় স্যাটেলাইটের ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধন করেন। তারই দিকনির্দেশনায় বিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা ও কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে ড. মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট প্রণয়ন করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর শুরু করা প্রযুক্তিগত উন্নয়ন পরিপূর্ণতা পায় তারই সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে। তিনি ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের ঘোষণা দেন। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বিস্ময়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ও আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের তত্ত্বাবধানে গড়ে উঠেছে ডিজিটাল বাংলাদেশ। সবার জন্য কানেকটিভিটি, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন, ই-গভর্নমেন্ট ও আইসিটি ইন্ডাস্ট্রিজ প্রমোশন—এই চার সুনির্দিষ্ট স্তম্ভের ওপর বাস্তবায়িত হয়েছে ডিজিটাল বাংলাদেশ।
জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে বর্তমানে সারা দেশে প্রায় ৮ হাজার ৮০০ ডিজিটাল সেন্টারে ১৬ হাজারের বেশি উদ্যোক্তা কাজ করছেন। বর্তমানে ডিজিটাল সেন্টার থেকে প্রতি মাসে গড়ে ৭০ লাখেরও অধিক সেবা প্রদান করা হচ্ছে। পেপারলেস কমিউনিকেশন চালু করার লক্ষ্যে সরকার ই-নথি চালু করেছে। ই-নামজারি সিস্টেমে আগত ৫২ লাখেরও অধিক আবেদনের মধ্যে ৪৫ দশমিক ৬৮ লাখেরও অধিক আবেদনের নিষ্পত্তি করা হয়েছে অনলাইনে। বর্তমানে দেশব্যাপী সাড়ে ৬ লাখ ফ্রিল্যান্সার কাজ করেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসেও ইন্টারনেটের মাধ্যমে আউটসোর্সিং করে তারা কয়েক শ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করছেন। বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষামতে, অনলাইন শ্রমশক্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে দ্বিতীয়।
এমন সফলতার মাহেন্দ্রক্ষণে ২০২২ সালের ১২ ডিসেম্বর ডিজিটাল দিবসের উদ্বোধনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার রূপকল্প-২০৪১-এর ঘোষণা করেন। স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি এই চারটি মূল ভিত্তির ওপর গড়ে উঠবে স্মার্ট বাংলাদেশ। ১১ জানুয়ারি, ২০২৩ জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে এই সংকল্পের পুনরাবৃত্তি করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘উন্নত বাংলাদেশের অভিযাত্রায় প্রথম ধাপ হিসেবে ইতিমধ্যে আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছি। বাংলাদেশ ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে এবং মাথাপিছু গড় আয় হবে ৫ হাজার ৯০৬ ডলারের ওপরে এবং ২০৪১ সালে বাংলাদেশ হবে একটি উন্নত দেশ, যেখানে মাথাপিছু আয় হবে ১২ হাজার ৫০০ ডলারের অধিক।’
প্রতিটি বৃহত্ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ থেকেই যায়। তেমনি স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের ক্ষেত্রেও প্রধান চ্যালেঞ্জ দক্ষ জনশক্তি। পরিসংখ্যান বলে, কোনো দেশ বা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের ২০ শতাংশ অবকাঠামোর ওপর নির্ভরশীল। আর ৮০ শতাংশ নির্ভর করে দক্ষ জনশক্তির ওপর। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা এখনো পিছিয়ে আছি। স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য স্মার্ট জনশক্তি তৈরিতে মনে-প্রাণে ও কর্মে হতে হবে গণিতনির্ভর জাতি। কেন? এর যৌক্তিক ব্যাখ্যা তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
সম্প্রতি এক আত্মীয় আমার অফিসে বেড়াতে এসেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য ইলেকট্রনিকস সংযোজন কোম্পানিতে কাজ করেন। তার কথা থেকেই বিষয়টি জানলাম, তার কর্মস্থলে উৎপাদন শাখায় আমাদের দেশের জনবলের প্রাধান্য নেই। সেখানে পার্শ্ববর্তী দেশের দক্ষিণের লোকেরা একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। খোঁজ নিয়ে দেখুন, পার্শ্ববর্তী দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর গণিতে ভালো করা বেশির ভাগ লোক দক্ষিণের। এই পরিসংখ্যানের মধ্যেই নিহিত রয়েছে আমাদের স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণের রূপরেখা।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়েছে গণিত। প্রোগ্রামের অ্যালগরিদম মানেই কোনো সমস্যা গাণিতিক প্রক্রিয়ায় সমাধানের ধাপসমূহ। প্রযুক্তির শিক্ষক হিসেবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যে কোনো নতুন শিল্পের উন্মেষ ঘটে গণিতকে নির্ভর করে। যুগের অগ্রগতির সঙ্গে গবেষণা ও শিল্পায়নের নাম ও বৈশিষ্ট্য ভিন্ন হলেও এর শেকড়ের শক্তি কিন্তু গণিত। গবেষণা জগতে দৃষ্টিপাত করলে দেখবেন যে, মানসম্মত গবেষণার সঙ্গে গণিতের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। পৃথিবীতে ঘটা যে কোনো ঘটনাবলিকে গাণিতিক সমীকরণের মাধ্যমে প্রকাশ করার সামর্থ্যই হলো গবেষণার সবচেয়ে শক্তিশালী স্তর।
প্রোগ্রাম ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট (পিআইএসএ)—ইকোনমিক করপোরেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি)-এর উদ্যোগে পৃথিবীর ৮০টি দেশের ১৫ বছর বয়সের শিক্ষার্থীদের গণিত ও বিজ্ঞানবিষয়ক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের প্রতিযোগিতা। এটি প্রতি তিন বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হয়। এই প্রতিযোগিতায় ২০১৮ সালে চীন প্রথম স্থান আর আমেরিকা ৩৭তম স্থান অধিকার করে। এতে তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভীষণভাবে হতাশ ও উদ্বিগ্ন হন। তিনি তার উদ্বিগ্নতার বহিঃপ্রকাশ ঘটান তার টুইটার একাউন্ট থেকে টুইট করে, ‘জেগে ওঠো আমেরিকা, আমাদের খাবার চাইনিজরা খেয়ে নিচ্ছে।’ ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক লাইনের এই টুইটই গবেষণা ও শিল্পে গণিতের অপরিহার্যতা প্রকাশ করেছে।
চাঁদে অবতরণকারী তিন জন নভোচারীর নাম আমরা প্রায় সবাই জানি। কিন্তু চাঁদে সফলভাবে রকেট উেক্ষপণের জন্য যে গণিতবিদগণ দিবারাত্রি পরিশ্রম করেছেন, তাদের নাম লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে গেছে। এরা হলেন ক্যাথেরিনা জনসন, ডারোথি ভাউগান ও মেরি জ্যাকসন। গণিতবিদ ক্যাথেরিনা জনসনের একটি উক্তি সর্বকালেই গ্রহণযোগ্যতা পাবে, ‘প্রযুক্তি আসে এবং যায়। রাজনীতির পালাবদল হয়। কিন্তু গণিত সর্বদাই আস্থার স্থল।’
২৪ মে ২০২২ একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার খবরের শিরোনাম ‘ইংরেজি-গণিতে এখনো দুর্বল শিক্ষার্থীরা’। গবেষণাধর্মী এই রিপোর্টে দেখানো হয়েছে, মাধ্যমিক পর্যায়ে ইংরেজিতে ৬১ শতাংশ ও গণিতে ৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থীর অবস্থা হতাশাব্যঞ্জক। গণিতের প্রতি অনুরাগ বাড়াতে গণিতের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টিসহ গণিতকে জয় করার সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা থাকতে হবে। ভবিষ্যতের এমন সচেতন পদক্ষেপই আমাদের উন্নত ও সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশে পরিণত করবে।